পাটাকাটা থেকে অস্ত্র উঠালো ইলিয়াস | রূপান্তরের গল্প ১৬২ | Rupantorer Golpo 162 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৬২ : খেউ খেউ করে ডাকছে কী যেন! সন্ধ্যাবেলা নিরিবিলি সুন্দরবনে সেই শব্দ বুকে কাঁপন ধরায়। কুকুরের মতো ডাকে মায়া হরিণ। ইংরেজিতে যার নাম- বার্কিং ডিয়ার। সুন্দরবনে দুই ধরনের হরিণ আছে। চিত্রা আর মায়া। সুন্দরবনের এই অঞ্চলে হরিণের আনাগোনা বেশ ভালো।
শিবসা নদীর পশ্চিমের খাল পাটাকাটা। ভয়ঙ্কর সুন্দর বলতে যা বুঝায়, খালটি ঠিক তাই। মাঝারি আর ছোট খাল দিয়ে ঘেরা জঙ্গল। হরিণ শিকারীদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। সেখানে একটি খালের ঠোঁটা বরাবর মাটির নিচে ইলিয়াসের অস্ত্রগুলো চাপানো। দুইটি বাইন গাছের সাথে নিশানা রাখা ছিলো। কিন্তু একটি গাছ ভাঙ্গনে হারিয়ে গেছে। তাই সঠিক জায়গাটি বের করা সহজ হবে না। একটা ডিঙ্গি নৌকা থাকলে ভালো হতো।
পাটাকাটার ভিতর থেকে একটি নৌকা বের হলো আমাদের দেখে দ্রুত নৌকা ঘুরিয়ে পালানোর চেষ্টাকরলো। কিন্তু ইলিয়াসের এক ডাকে থমকে গেলো তারা। ইলিয়াস চিৎকার করে শুধু তার নামটি বললো। বাঁকীটুকু নিজের চোখে দেখলাম! ইলিয়াসের কথা শুনে আর পালানোর সাহস পায়নি। নৌকা ঘুরিয়ে ফেললো। এই জঙ্গলে ডাকাতের ভয়ের চেয়ে বড় ভয় আর নাই।
ট্রলার নোঙ্গর করলাম। জেলে দুইজনকে দেখে মনে হলো ভুত দেখছে। ইলিয়াস ডাকাতকে তারা চিনে। কিন্তু খালি হাতে ইলিয়াসকে দেখেনি কখনও। কাছে বসিয়ে ভয় ভাঙ্গালাম। বললাম, একটু সময় দিতে হবে। এরপর দস্যুনেতাকে নিয়ে খালের ভিতর ঢুকে পড়ে তারা। আধা ঘন্টার মধ্যে একটি পলিথিন দিয়ে বাঁধা প্যাকেট নিয়ে ফিরলো তারা। ভিতরে সাতটি বন্দুক আর কয়েকশ’ গুলি।
পাটাকাটা থেকে ফিরতে হবে। রাতের মধ্যে পৌঁছাতে হবে মুন্সিগঞ্জ। সেখান থেকে RAB সদস্যরা আলাদা ট্রলারে আমাদের বহরে যোগ দিবে। এএসপি জসীম উদ্দীনের নেতৃত্বে তারা থাকবে আমাদের সাথে। ঠিক সাথে নয়, বড় নদীতে অবস্থান করবেন তাঁরা।
মজনুর সাথে দেখা হবে সেই কালির খাল বা এর আশেপাশের কোনো খালে। তারা অপেক্ষা করবে। শুনেছি ওদিকে ত্রিকাঠি নামে একটি খাল আছে, সেখানেও থাকতে পারে তারা। পশুরতলার নিচেও দেখা হতে পারে। সুবিধা মতো জায়গা নির্ধারণ করে জানাবেন দস্যুনেতা মজনু।
ইলিয়াসের স্ত্রী-সন্তানরা বাড়ি চলে গেছে। আর দস্যুনেতা তার অস্ত্র-গুলিসহ আমার সাথে। অস্ত্রের প্যাকেটটি আমাদের ট্রলারের পাটাতনের নিচে রাখা।
বিকালের জোয়ারে ট্রলার ছাড়লাম। মুন্সিগঞ্জে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো। পথে কয়েকটি বন টহল ফাঁড়ী পড়লো। কেউ সিগন্যাল দিলো না। দুশ্চিন্তার শেষ নাই। পথে টহলের নৌকা পড়লো কয়েকটি। তবে ভাগ্যক্রমে তারাও সিগন্যাল দিলো না। কেন দিলো না জানি না। এ দফায় ভাগ্য সহায় হচ্ছে। অবশ্য সামনে কী হবে জানি না। লম্বা পথ।
মুন্সিগঞ্জের কলবাড়ি ঘাটে ট্রলার ভিড়লো। রাত তখন প্রায় ১১টা। সেখানে অপেক্ষায় RAB-এর বহর। ট্রলারে উঠলেন সেই আলমগীর ভাই। মজনুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন তিনি। কিছু জিনিষপত্র নিয়ে উঠে পড়লেন। ট্রলার ছাড়লো। ছাড়লো RAB-এর ট্রলারও। ভিতরের কেবিনে চুপচাপ বসা ইলিয়াস। বসলাম তার পাশে।
ইলিয়াস ভয়ঙ্কর এক বনদস্যু। অথচ বন উপকূলের অতি দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম কয়রার মহেশ্বরীপুরে। ছোটবেলা থেকে ডানপিটে স্বভাবের। লবণ পানির কর্কষ জীবন তাকে ঠেলে দিয়েছে জঙ্গল জীবনে। ছোটবেলায় বড়দের সাথে সুন্দরবনে যেতো সে। বৈঠা বাইতে বাইতে হাত দুটি শক্ত হয়েছে। সেই সাখে কঠিন হয়েছে মনটাও। কৈশোরে এক মহাজনের ভরের নৌকায় চাকরি নেয় ইলিয়াস। ভরের নৌকা মানে যে নৌকা করে বড়ফ পরিবহন করা হয়। এই নৌকা ঘুরে ঘুরে জেলেদের কাছে থেকে মাছ সংগ্রহ করে, পৌঁছে দেয় আড়তে। কিশোর ইলিয়াস সেই নৌকার সহকারী ছিলো। নাম মাত্র বেতনে নৌকার পানি ফেলাসহ নানা কাজে সহযোগিতা করতো। সেই জীবন থেকে ইলিয়াসের ভয়ঙ্কর দস্যু হয়ে ওঠার গল্প সিনেমাকেও হার মানায়।