রূপান্তরের গল্প ১৮২ | Rupantorer Golpo 182

রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি শান্ত বাহিনীর | রূপান্তরের গল্প ১৮২

রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি শান্ত বাহিনীর | রূপান্তরের গল্প ১৮২ | Rupantorer Golpo 182 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৮২ : হাতের দোনলা বন্দুকটির দিকে না তাকালে তিনি একজন অতি সাধারণ মানুষ। অস্ত্রটি হাত থেকে সরিয়ে দিলে উনাকে বনদস্যু বা ডাকাত বলার উপায় থাকবে না। নাম বারেক তালুকদার। বাড়ি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ। সুন্দরবনের শান্ত বাহিনীর প্রধান। পূর্ব বাদায় এই দস্যু দলের নাম ডাক বেশ শোনা যায়।

নৌকা থেকে উঠে আসলেন বারেক ভাই। করমর্দন হলো, কোলাকুলি হলো। তারপর একে একে উঠে আসলো বাঁকী দস্যুরা। ওদের সবার বাড়ি মোড়েলগঞ্জ। শুধু জুয়েল নামের এক তরুন জলদস্যুর বাড়ি কয়রা। ট্রলার থামাতেই তার দিকে নজর যায়। কোথায় জানি দেখেছি দেখেছি মনে হলো। ট্রলারের ছাদে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়লাম। চা জ্বালানো হলো তাদের নৌকায়। সেই কালো রঙ-এর কড়া লিকারের চা। প্লাস্টিকের কাপটি হাতে নিয়ে গল্পে বসলাম। দলের সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিলেন বারেক তালুকদার। বললেন, এরা সবাই সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরতো। অভাবে পড়ে দস্যু হয়েছে। বললাম, বনদস্যুর খাতায় নাম লিখিয়ে সেই অভাব কি কাটলো? উত্তর নাই।

শান্ত বাহিনী এমনিতে ছোট গ্রুপ। ৮/১০ জন সশস্ত্র দস্যু দল। নাম শান্ত বাহিনী হলেও এই ডাকাত দলের লিডার সেই শান্ত মারা গেছে অনেক আগে। সমির তালুকদার ছিলো সেই দলের প্রধান। অভ্যন্তরীন বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। তারপর অস্ত্রগুলো নিয়ে দুইটি ভাগে ছড়িয়ে পড়ে তারা। সমির তালুকদারের ভাই নমির তালুকদার ভিড়ে যায় বড় সুমন বাহিনীতে। পরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চাপে পড়ে উঠে পড়ে নমির। সে সময় কয়েকটি অস্ত্র বিক্রি করে দেয় অন্য দলের কাছে।

বারেক তালুকদার কয়েকজনকে নিয়ে যোগ দেয় বিল্লাল বাহিনীতে। ফিরাউন বিল্লাল নামে জানতো সবাই। সেই বিল্লালের মৃত্যু হয় RAB-এর ক্রসফায়ারে। তারপর দলেন নেতৃত্বে আসেন বারেক তালুকদার। দল ছোট করে আনে। স্থানীয় কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ডাকাতি করে বেড়ায় পূর্ব সুন্দরবনে। সেলা নদীর দুই পাশ আর দক্ষিণে হরিণটানা পর্যন্ত তার এলাকা। মাঝে মাঝে হাড়বাড়িয়া থেকে হরমল হয়ে চরাপুঁটিয়া, ঘসিয়াঙ্গাড়ীর ভিতরেও চলে যায় তারা। তবে ওদিকে বড় সুমন বাহিনী থাকে। একটু বড় বাহিনী, দুর্ধর্ষও।

বারেক তালুকদারের বয়স পঞ্চাশ হবে। অন্যদের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছর। অস্ত্র বলতে সবগুলোই একনলা ও দোনলা বন্দুক। গুলি খুব বেশি নাই। অবশ্য এদের খুব একটা গোলাগুলির প্রয়োজন পড়েও না। দস্যুরা সবাই আমার সোর্স বশিরের কথায় ওঠে-বসে। তাদের মধ্যে সম্পর্ক বেশ গভীর, পুরনো। বাড়িঘরের খোঁজ খবরও আদান প্রদান করছে তারা।

ট্রলারের রান্নাঘরে তখন মহাযজ্ঞ চলছে। আলু দিয়ে পাতলা খিচুরি রান্না করা ছিলো। কিন্তু দস্যুদের সবাইকে নিয়ে খাওয়া যাবে না। নতুর করে তাই ভাত চড়ানো হলো। মনির নামের একজন দস্যু এসে বসলো পাশে। বললো, বৃষ্টির জন্য রান্নাবান্না করতে পারেনি তারা। রাতের খাবার তাই আমাদের ট্রলারের রান্নাঘরে চলছে। বললাম আমাদের সরদারকে সব বুঝিয়ে দেন। বললেন, নৌকায় কয়টা গলদা চিংড়ি ছিলো। কেটে বেছে রাখা ছিলো কিন্তু রান্না করতে পারিনি। বেলায়েত ভাই সেগুলোর একটা ব্যবস্থা করছে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে গলদা চিংড়ি ভেজে নিয়ে আসলেন বেলায়েত সরদার। দস্যুনেতা ও আমার চেয়ারের মাঝখানে চেয়ার টেনে বসলেন। মাছের প্লেটটি এগিয়ে দিলেন দস্যুনেতার সামনে। বারেক তালুকদারকে বললাম, চিনতে পারছেন?

আলো-ছায়ার মধ্যে ভালো করে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ছোট টর্চটি সরদারের মুখে মারলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চিনি ভাই, ভালো করে চিনি! একবার তাকে অপহরণ করছিলাম। কিন্তু তারপর যে জ্বালান জ্বালালো! সরদার মনে করিয়ে দিলেন সেই তিন হাজার টাকার কথা! গল্পটা শুনলাম।

২০০৮ সালের কথা। বেলায়েত সরদার কয়েকটি নৌকা নিয়ে মাছ ধরতেন। ছোট খাটো মহাজন। তবে জেলেদের সাথে পার্টনারশিপে চলতো মাছের ব্যবসা। সুন্দরবনের কবরখালী থেকে কোকিলমনির মধ্যে তারা মাছ ধরছিলো। এক রাতে এসে হামলা চালায় শান্ত বাহিনী। টাকা দাবি করে। একজনকে অপহরণ করে নিয়ে যেতে চায়। তখন বেলায়েত সরদার নিজেই দস্যুদের নৌকায় উঠে যায়। বলে, জেলেরা বাড়ি ফিরে যাক। টাকা পয়সার ব্যাপার পরে মিটমাট করবোনে। বলেই শান্ত বাহিনীর নৌকা বহরে উঠে পড়ে।

এর পরের গল্প বললেন বারেক তালুকদার। বেলায়েত সরদার তখন আরও ছোট খাটো। অপহরণ করলাম আমরা। কিন্তু সে আমাদের উল্টো কমান্ড করে। এই খাবো না, সেই করবো না করতে করতে দলের সবাইকে অতীষ্ট করে ফেলে। অপহৃত মাঝি বেলায়েত সরদার বলে তার হাতে অস্ত্রও দিতে হবে, সে নৌকা বাইতে পারবে না, ভালো খাবার দিতে হবে, বিড়ি দিলে চলবে না- সিগারেট দিতে হবে ইত্যাদি ইতাদি। দস্যুরা তাকে রাখতেও পারে না, ছাড়তেও পারে না। সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও বেলায়েত সরদারকে ছাড়াতে ফোন দেয় না কেউ। মুক্তিপণ হিসাবে শুরুতে তিন লাখ টাকা দাবি করে শান্ত বাহিনী। পরে দর কষাকষি করে সেটা নামে ত্রিশ হাজারে। কিন্তু সেই টাকাও যখন পাচ্ছে না, তখন বিনা মুক্তিপণে

একটা সময় এসে বেলায়েত সরদারকে ছাড়ার চিন্তা করে ডাকাতরা। যাওয়ার সময় উল্টো বনদস্যুদের কাছে ফিরে যাওয়ার খরচ হিসাবে তিন হাজার টাকা চেয়ে বসে। বলে, বাড়ি ফিরে সেই টাকা ফেরত পাঠাবে। সময় নষ্ট না করে সেই টাকা হাতে দিয়ে বিদায় করে শান্ত বাহিনী। বারেক তালুকদারকে বললাম, সেই ধারের টাকা তো ফেরত দেয়নি সরদার! সবাই মিলে হেঁসে উঠলো। সরদারকে বললাম, দেনা শোধ না করলে আপনাকে রেখে যাবো। দস্যুরা বললো, না ভাই, এই যন্ত্রণা আবার মাথায় দিয়েন না। আপাতত আমাদের সারেন্ডারের ব্যবস্থাটা করে দেন।

বললাম, দেখা করতে আসলাম এজন্যই। আত্মসমর্পণ করতে চাইলে আপাতত দস্যুতা বন্ধ করবেন। কাউকে অপহরণ করবেন না। কোনো অভিযোগ নতুন করে যেন না শুনি। অস্ত্র-গুলিগুলো যেভাবে আছে সেভাবেই যেন থাকে। সদস্যদের মধ্যে অবিশ্বস্ত কেউ থাকলে তাকে বের করে দিবেন। আমি ফিরে আপনাদের সারেন্ডারের আবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে পৌঁছে দিবো। তারপর সময় সুযোগ মতো এসে নিয়ে যাবো আপনাদের।

রাত ১২টা পেরিয়ে গেছে। আকাশ পরিস্কার এখন। জোলা খালের ভিতরে আমরা। বাতাস নাই। বেড়ে পোকায় কামড়ে আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। বাতাস নাই বলে গরম লাগছে খুব। বড় নদীর খুব কাছে বলে বেশি আলো জ্বালানো হয়নি। ট্রলারের ভিতরে বসে সবাই একসাথে খেতে বসলাম।

সারা রাত খালের মুখে পালা করে ডিউটি করছে দু’জন করে সশস্ত্র বনদস্যু।

(ছবি: বারেক তালুকদার, শান্ত বাহিনীর প্রধান, আগস্ট ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top