দস্যুদের ডেরায় ঘুমহীন আরেক রাত | রূপান্তরের গল্প ১৮৩ | Rupantorer Golpo 183 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৮৩ : বনদস্যু মনিরের বাড়িও মোড়েলগঞ্জ। সাধারণ কৃষি কাজ আর মাছের ঘের করে কোনো রকমে সংসার চলতো। তবে স্থানীয় বিরোধ আর গ্রাম্য রাজনীতির খপ্পরে পড়ে মামলা খেয়েছে। তারপরের গল্প এক। মামলা চালাতে গিয়ে হিমসিম অবস্থা। জেলখানা, জামিন নেওয়া, হাজিরা দিতে দিতে জমানো টাকা সব শেষ। মোড়েলগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বাগেরহাট জেলা সদরে যাওয়া আসা করাটাও লম্বা সময়ের ব্যাপার, ব্যয়বহুলও। এরপর আদালতে গরহাজির। জামিন কেটে যায়।
কিন্তু জেলখানায় ঢুকলে সংসার চালাবে কে? জেলের খরচও আছে। উকিল-মুহুরির খরচ দেওয়ার সামর্থ নাই। গ্রামের প্রান্তিক যে পরিবার মামলায় পড়ে, তার আর পরিবার নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো হয় না। গ্রামের ওই পরিবেশে সেটা সম্ভবও না। এরপর যোগাযোগ হয় শান্ত বাহিনীর দলনেতা বারেক তালুকদারের সাথে। জঙ্গলে নেমে অস্ত্র হাতে নিয়ে বনে যায় বনদস্যু। আসার সময় মনির মেয়েটাকে বলে এসেছিলো, আর হয়তো ফিরা হবে না।
নাও ফিরতে পারি, কথাটি সুন্দরবনে প্রবেশের সময় প্রতিবারই বলে আসেন জেলে-বাওয়ালীরা। জঙ্গলের জীবনটাই এমন। দস্যু জীবন আরও বেশি অনিশ্চয়তায় ভরা। বললাম, এর চেয়ে জেলখানায় থাকা ভালো না? মনিরসহ অন্য দস্যুরা বলে উঠলো, টাকা পয়সা ছাড়া জেলখানায় বাঁচা যায়? প্রতি পদে পদে খরচ করতে না পারলে পঁচে মরতে হবে। এছাড়া মামলা চালানোর খরচ কে দিবে? ডাকাতি করে মাসে ৫/১০ হাজার টাকা পাঠাই বাড়িতে। অনেকে মনে করে আমরা লাখ লাখ টাকার উপর শুয়ে থাকি। কিন্তু টাকা থাকলে আমাদের এই অবস্থা থাকে?
রাতভর জঙ্গলে বসে গল্প হচ্ছে বনদস্যু শান্ত বাহিনীর সদস্যদের সাথে। এক এক জনের জীবনের গল্প শুনলে মনে হয় আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই এদের ঠেলে দিয়েছে অপরাধের জীবনে। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ নিজের ভুল বুঝে আইনের কাছে নিজেদের সমর্পণ করবে, সেই সুযোগও নাই। জেল থেকে জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরলে আবার নতুন মামলায় পড়ে। অথবা জলদস্যু হিসাবে ধরা পড়তে হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। বনদস্যু মনির বলছেন, এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ার আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে বনদস্যু জীবন বেশি নিরাপদ।
সুন্দরবনের দস্যুদের সঙ্গে যতো মিশছি, জানতে পারছি ওই অন্ধকার জীবনের অলিগলি সম্পর্কে। কী করুণ এক একটা কাহিনী! আমিও ভাবতাম যে বনদস্যু-জলদস্যু মানেই কোটি কোটি টাকার কারবার। কিন্তু ওই জগতে প্রবেশ করে দেখছি ভিন্ন চিত্র। জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা ও মুক্তিপণ নেয় তারা। কিন্তু টাকাগুলো তাদের পকেটে থাকে না। নগদ টাকাগুলো চলে যায় নির্দিষ্ট কয়েকজনের পকেটে। বাঁকীটা খরচ হয়ে যায় দল চালাতে। ছোট ও মাঝারী বনদস্যু দলের অবস্থা আরও করুণ। না চলে সংসার, না চলে মামলা, না চলে জীবন। দারিদ্রকে সঙ্গে নিয়েই ওদের জীবন চলে। শুধু নামের সাথে যোগ হয়- বনদস্যু, জলদস্যু বা সুন্দরবনের ডাকাত!
রাত তখন তিনটা পেরিয়েছে। দস্যুনেতা বারেক তালুকদার আমাকে বিশ্রাম নিতে বললেন। সত্যিই তো, বিশ্রাম নেওয়া দরকার। কিন্তু বনদস্যুদের ডেরায় এসে আমার তো ঘুম হয় না। তাছাড়া এই বদ্ধ পরিবেশটাও কষ্ট দিচ্ছে। ছোট্ট খালের ভিতরের এই জঙ্গল জীবন মোটেই স্বাচ্ছন্দের নয়। গরমে ঘামছি দরদর করে। আর থেমে গেলে বাইড়ে পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। তাছাড়া এই অতি ক্ষুদ্র পোকা বোধ হয় আমাকে বেশি পছন্দ করে। খালে ঢোকার পর থেকে সামনে কামড় খাচ্ছি। এই পোকাটি সাধারণ ভাবে চোখে দেখা যায় না। তবে যেখানে কামড়ায় সেই জায়গা ফুলে যায়। প্রচুর চুলকায়। এর প্রভাব আমার ত্বকে থেকে যায় পরের এক/দুই সপ্তাহ।
বাইড়ে পোকা বা বেড়ে পোকা থেকে বাঁচতে মশার কয়েল জ্বালানো হয়েছে কয়েকটা। কাজ হচ্ছে না। বনদস্যু জুয়েল তার পোসেস থেকে মিনিপ্যাক শ্যাম্পু বের করলো। তেল বা লোশনের মতো করে মাখিয়ে দিলো হাত-পায়ে। পুরো শরীরে চিটচিটে অনুভূতি নিয়ে কি ঘুমানো যায়? বিশ্রাম হয়? সবাইকে বিশ্রামে যেতে বললাম।
বেলায়েত সরদারের ইদানিং ঘুম বেড়েছে। যেখানে সেখানে, যখন-তখন ঘুমিয়ে পড়ে। পাশে রাখা বনদস্যুদের একটি নৌকায় শুয়ে পড়েছেন উনি। সুন্দরবনের এই বৈরী আবহাওয়া কিংবা বাইড়ে পোকার কামড়ে কিছু আসে যায় না তাদের। আসলে পরিশ্রান্ত শরীর যখন ঘুম চায় তখন এই জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সুন্দরবনের মানুষেরা। আমার সঙ্গে আসা স্বপন আর তার দুলাভাই দস্যুনেতা আরেকটি নৌকায় বসে গল্প করছেন। পাশে বশির বসা। সহকর্মী ভিডিওগ্রাফার দীপু ভাই, ইয়ামীন ভাই ও মংলার সাংবাদিক নিজাম উদ্দীনও ঘুমিয়ে পড়েছেন। জেগে আছি আমি। সঙ্গ দিচ্ছে বনদস্যু মনির ও জুয়েল।
জুয়েলের বাড়ি খুলনার কয়রায়। দার সাথে প্রথম দেখা রাজু বাহিনীতে। তারপর দেখা হলো ইলিয়াসের দলে, ২০১৩ সালে। কৈশোর পেরোতেই অপরাধ জগতে হাতে খড়ি তার। লোকালয়ে থাকলে যশোর-খুলনার মটরসাইকেল চুরির সিন্ডিকেটের সদস্য এই জুয়েল। আর সুন্দরবনে থাকলে জলদস্যু। গডফাদারদের কাছে এ ধরণের অপরাধপ্রবণ তরুনদের চাহিদা অনেক।
এই জুয়েলদের ব্যবহার করে পকেট ভারী করে শহরের ভদ্রলোকেরা। অন্যদিকে অপরাধ জীবনের শেষ পরিণতি মৃত্যু। এটা জেনেও জীবনে ফেরার সুযোগ মিলে না জুয়েলদের। লোভে পড়ে এই অন্ধকার জগতে এসে আটকে যায় ক্রসফায়ারের জালে। দস্যুবিরোধী যে টাস্কফোর্সটি কাজ করছে তা যথেষ্ট কার্যকর। কোণঠাসা হয়েছে বনদস্যুরা। কিন্তু একই সাথে ফিরতে না পারা নামসর্বস্ব বনদস্যু দলগুলোর সংখ্যা বাড়ছে। অভিযানে বড় বড় দস্যুনেতাদের মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু একই সাথে টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছে দলগুলো। ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সুন্দরবনে। আগে দুই তিনটি বড় জলদস্যু দলকে চাঁদা দিলেই হতো। এখন খালে খালে দেখা মিলে বনদস্যুদের। আকারে ছোট হলেও জেলেদের প্রতি তাদের দাবি কিংবা অত্যাচারের তীব্রতা ছোট ছিলো না। বরং কোনো কোনো সময় এরাই বেশি অত্যাচার করে মাছ-কাঁকড়ার জেলেদের।
জুয়েল কি আত্মসমর্পণ করবে? তার অতি উৎসাহ আমাকে প্রথম থেকেই সন্দেহপ্রবণ করে। তার আচরণ অনেকটা সেই রাজনের মতো। ছোট দলগুলোর জন্য জুয়েলের মতো সদস্য বেশ ঝুঁকির কারণ হতে পারে। মনের কথা মনেই রাখলাম।
ভোর রাতে দেখা হলো একটি সবুজ সাপের সাথে। এই প্রাণিটি অনেকের কাছে খুব সুন্দর! প্রাণবৈচিত্রের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণও বটে। কিন্তু আমি ওদের ভয় পাই। ভোরবেলা ট্রলারের লগিতে পেঁচিয়ে থাকা সবুজ রঙ-এর সাপটি দেখে রীতিমতো ভড়কে গেছি। আর আমার অবস্থা দেখে বনদস্যুরাও একটু ভড়কে যায়। পরে সাপটিকে তাড়ানো হয়। ট্রলারটি জঙ্গলের সাথে ঘেঁসে ছিলো। সরিয়ে মাঝখানে আনা হলো। গল্পে গল্পে কাটলো ভোরবেলাটাও।
সুন্দরবনের সকালটা অন্যরকম। ডিঙ্গি নৌকায় বসে সূর্যোদয়টা আরও সুন্দর। আর সে সময় ভরা জোয়ার থাকলে চারপাশের সৌন্দর্য ছাপিয়ে যায় রাত জাগার ক্লান্তিকে। সুন্দরবনে এমন সকাল অনেক দেখেছি। এর মধ্যে জেগেছে সবাই। দস্যুনেতা বারেক তালুকদারের ঘুম ভেঙ্গেছে। চুলা জ্বলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে আমাদের মূল কাজ।