পালাতে পালাতে জীবন শেষ! | রূপান্তরের গল্প ১৮৪ | Rupantorer Golpo 184 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৮৪ : সকাল সাড়ে ছয়টার মতো বাজে। সূর্যোদয়টা অনন্য ছিলো। সাথে একটু বাতাস হচ্ছে। ভরা জোয়ারে আমরাও খানিকটা উঁচুতে ভেসে উঠেছি। বেশ ভালো লাগছে। হাল্কা মেজাজে গল্প করছি। এর মধ্যে দেখি কান খাড়া করে কিছু একটা বুঝার চেষ্টা করছেন দস্যুনেতা বারেক তালুকদার।
স্পিডবোটের শব্দ পাচ্ছি। কারা জানি সেলা নদী ধরে আসছে। চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কোস্টগার্ড হতে পারে। আবার বন বিভাগও হতে পারে। দুটোই বিপজ্জনক হতে পারে। শিঁড়দাঁড়া বেয়ে শিরশির করে কিছু একটা বয়ে যাচ্ছে। সবাই চুপ করে গেলাম। জোয়ারে বাদায় পানি উঠে আছে। প্রায় কোমড় পানি ডাঙ্গায়। সেই পানি ভেঙ্গে রওনা দিলো জুয়েল। পিছনে হাঁটা দিলো ভান্ডারী।
জোয়ারের সময় এই নদীতে স্পিডবোট বা ট্রলার আসা মানে ভালো কিছু না। দুশ্চিন্তা হবেই। কারণ ছোট খালে এখন পানি বেশি। স্পিডবোট নিয়ে বনের ভিতরে অনেক দূর ঢুকে পড়তে পারবে তারা। কোনো অভিযান যদি জোয়ারের সময় হয় তাহলে ধরে নিতে হবে যে পরিকল্পনা করেই চলছে অভিযান। অবশ্য জোয়ারে দস্যুরাও সতর্ক থাকে। জঙ্গলে সতর্ক থাকলে, কাউকে এড়িয়ে চলা কিংবা পালিয়ে যাওয়া খুব সহজ। আমাদেরও অসংখ্য বার পালাতে হয়েছে এবং প্রতি বারই সফল ভাবে পালিয়েছি। দুশ্চিন্তা বাড়ে যদি বনদস্যুরা থাকে আমার সঙ্গে। অন্য দস্যুদল কিংবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে মুখোমুখি হলে তখন গোলাগুলি ছাড়া উপায় থাকে না।
স্পিডবোটের শব্দ এগিয়ে আসছে। পশ্চিম থেকে আসছে। তার মানে পশুর নদীর ওদিক থেকে ছুটছে স্পিডবোট! যদি ওদের লক্ষ্য আমরা না হই তাহলে দুশ্চিন্তা নাই। জায়গাটি লোকালয়ের কাছে বলে ঝুঁকি বেশি। আবার দিনে দুপুরে এসেছি আমরা। কেউ অনুসরণ করতেও পারে। সকাল সকাল কী ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি তাহলে?
জুয়েল আর ভান্ডারী পৌঁছেছে নদীর ধারে। এদিকে খালের গোঁড়ায় পাহাড়ায় থাকা নৌকাটি ফিরেছে। ওরা বললো, কোস্টগার্ডের স্পিডবোট আসছে। মনে হয় নন্দবালা ক্যাম্প থেকে রওনা দিয়েছে ওরা। ওদিকে আপনাদের সোর্স নাই? বারেক তালুকদারকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, সোর্স তো খালি চোখ পাল্টি দেয়! টাকা পয়সায় একটু টান পড়লেই ওরা বেঈমানী করে। এদিকে স্পিডবোট আরও এগিয়ে আসলো। আমরা ট্রলার থেকে নৌকায় নেমে দাঁড়িয়েছি।
ওদিক থেকে সিগন্যাল আসলেই আমরা নৌকা নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে পড়বো। এক নৌকা ভর্তি মানুষ আমরা। সাথে ব্যাগ, ক্যামেরাসহ যন্ত্রপাতি নিয়ে পালানোর জন্য প্রস্তুত! ঘুম থেকে টেনে তুলেছি আমার সহযাত্রীদের। চোখ ডলতে ডলতে নৌকায় উঠে বৈঠা নিলেন সরদার। সবাই বসে পড়লাম। নৌকাটা একটু এগিয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকানো হলো। চারপাশে জঙ্গল! ভাগ্যিস জোয়ার ছিলো। না হলে আবার কাঁদা-জঙ্গল ঠেলে দৌড়াতে হতো। পূর্ব সুন্দরবনের এদিকটায় সুন্দরী গাছ বেশি। সুন্দরীর শ্বাসমূলগুলো পায়ের তালুর নিচে পড়লে জীবনটা বেরিয়ে যায়! হেঁতাল, হরগজা কিংবা প্রেমকাঁটার কথা বাদই দিলাম। এবার অন্তত ওই জ্বালা সইতে হবে না। এমনিতেই বাইড়ে পোকার কামড়ে অতীষ্ট আমি!
পালানোর পজিশনটা নিয়ে রাখি ভাই। বলতে বলতে বেলায়েত সরদার নৌকা বেয়ে একটু ঢুকে পড়লেন ভিতরের দিকে। বললাম, জোলা খাল এটা, চিনে যেতে পারবেন তো? না কী ওদের কাউকে সাথে নিবো? বললাম, বনদস্যুদের একটা নৌকা সামনে থাকলে হয় না? সরদার বললেন, এই বন্যা জোয়ারে ছোট খাল, মাঝারি খাল কিংবা ডাঙ্গা- সবই এক লেভেলে চলে আসে। নৌকা বেয়ে যাবো যতদূর যাওয়া যায়! ওরা স্পিডবোট এনে নাগাল পাবে আমাদের?
দস্যুনেতা বললেন, আপনারা এতো দুশ্চিন্তা করবেন না ভাই। যদি আসেও আমাদের পার করে কেউ আপনাদের কাছে পৌঁছাতে পারবে না। বলেই তার দলের সবাইকে বন্দুক আর গুলি চেক করে নিতে বললেন। গুলি ভরে সেফটি লক টেনে নিলো তারা। এই দলে ৫/৭ জন ফাইটার আছে বলে মনো হচ্ছে।
স্পিডবোট একদম কাছে চলে এলো। আমাদের খাল বরাবর আসার আগেই শব্দ কমে আসলো। মানে স্পিডবোটের গতি কমেছে। এবার সত্যি সত্যি ভয় পেলাম। প্রকাশ না করে সবাইকে সাহস দিচ্ছি। বললাম, অ্যাথলেটদের মতো পজিশনে আছেন বেলায়েত ভাই! কথা পানিতে পড়তে দিলেন না। সাথে সাথে বললেন, রেফারি গুলি করলেই দৌড় দিবো আমরা। এই টেনশনের মধ্যেও কেউ না হেসে থাকতে পারলাম না। বললাম, হাসিটা জমিয়ে রাখলাম ভাই। আমার সহযাত্রীরা সবাই ঘুম থেকে উঠেই এই পরিস্থিতি দেখছেন। ঠিক বুঝতে পারছেন না কী হচ্ছে! বললাম, বুঝাবুঝির দায়িত্ব আমার। আপনারা চুপচাপ বসে থাকেন। এরকম পরিস্থিতিতে একটু চাপ দিয়ে রাখতে হয় সবাইকে।
গত কয়েক বছরে সুন্দরবনে পালাতে গিয়ে শিখেছি এসব। শুধু দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো ট্রলারটি নিয়ে। সত্যিই যদি এখানে এসে পড়ে কোস্টগার্ড, দস্যুদের পাবে না, আমাদেরও পাবে না। এই খালে ঢুকলে ট্রলারটি নিয়ে যাবে। ভাড়া করা ট্রলার। ফেরত নিতে গেলে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হবে। যা হবে পরে দেখা যাবে।
স্পিডবোটটি গতি কমিয়ে জঙ্গল থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে এগুচ্ছে। বন্দুকের গুলির রেঞ্জ-এর বাইরে দিয়ে যাচ্ছে, আমাদের অতিক্রম করলো। দেখছি না। শব্দ শুনে অনুমান করছি। মিনিট দুই চলার পর জোরে টান দিলো সেটি। মনে হয় আন্ধারমানিক ফরেস্ট অফিসের সামনে থেকে ঘুরিয়ে আবার রওনা দিয়েছে। আমাদের পাশ দিয়ে পূর্ণ গতিতে পার হয়ে গেলো স্পিডবোট। আবারও বাঁচলাম মনে হয়।
নৌকায় বসতে আমার খুব কষ্ট হয়। উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু স্পিডবোট তো যায়নি! আবার আসছে আমাদের দিকে! পার হয়ে গেলো! আবার ঘুরে আসলো। চলে গেলো পশ্চিমে। মিলিয়ে গেলো সে শব্দ বহুদূর! দস্যুনেতাকে বললাম, আমাদের আসার খবর পেয়েছে ওরা। অথবা আপনাদের অবস্থান জেনে গেছে। খালের গোঁড়ায় কোনো আলামত দেখলে ঠিক ঢুকে পড়তো। ভাগ্যিস পাহাড়ার নৌকাটি ওরা আসার আগেই ভিতরে চলে আসছে!
স্পিডবোট চলে গেলো! মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো সবার! আমার সহকর্মী দীপু ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ভাই? বললাম, একটু বিপদ গেছে ভাই। বললেন, কোস্টগার্ড নিয়ে ভয় পাওয়ার কী আছে? সামনে আসলে পরিচয় দিলেই হবে। পিছন থেকে সরদার বললেন, পরিচয় দেওয়ার সময় পাবেন? এটা সুন্দরবন! গুলিতে সাংবাদিক চিনবেনা! বললাম, সুন্দরবনে আমার সাথে প্রথম এসেছেন দীপু ভাই। তাই বিপদটা পুরো বুঝতে পারেননি। বললাম, কেবল ঘুম ভাঙ্গলো তো ভাই। সামনে বুঝবেন অনেক কিছু!
দুইজন সশস্ত্র দস্যু নৌকা নিয়ে নদীর মুখে খালের গোঁড়ায় গেলো। ওই নৌকা নিয়ে ফিরলো বনদস্যু জুয়েল ও ভান্ডারী। বললো, কোস্টগার্ড খবর ঠিকই পেয়েছে। কিন্তু সঠিক খালটা চিনতে পারেনি। নিচের দিকে আরেকটা খালের মুখে ব্রেকক করছিলো, কিছুক্ষণ দেখে আবার ফিরে গেছে। এই খাল সম্পর্কে ওদের ধারণা নাই। বারেক তালুকদার বললেন, কাল রাতে কোনো জেলে দেখছে আমাদের। ওরাই মনে হয় খবর দিয়েছে প্রশাসনকে! বললাম, বাঁচতে হলে দ্রুত সারেন্ডার করে ফেলেন। উনি বললেন, সেজন্যই তো আপনাকে জোর করে নিচে নিয়ে আসছি!
সবাইকে নৌকা ছেড়ে ট্রলারে উঠতে বললাম। ঝুঁকি আপাতত গেছে, তবে চলে যায়নি। আবার ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে আসতে পারে কোস্টগার্ড!
(ছবি: শান্ত বাহিনীর আস্তানা। কোস্টগার্ড চলে যাওয়ার পর সবাই ফিরেছিলাম ট্রলারে)