পরতে পরতে ষড়যন্ত্র, নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা উঠাতো দালালরা | রূপান্তরের গল্প ১৮৬ | Rupantorer Golpo 186 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৮৬ : মনে হচ্ছে দলের মধ্যে বড় কোনো ঝামেলা হতে পারে। আপনার সদস্যরা সবাই কি বিশ্বস্ত? দস্যুনেতা বারেক তালুকদারকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, একজন তো নতুন আসছে। তার কথা বলতে পারছি না। এছাড়া ও ছাড়া বাঁকী সকলেই আমার আত্মীয় অথবা প্রতিবেশি। বললাম, জুয়েলের কথা বলছেন তো? বললেন, জ্বি ভাই। আপনি বুঝে গেছেন? বললাম, ওকে দলে নিলেন কেন? এমনিতেই তো যন্ত্রণার শেষ নাই। বললেন, খুলনার এক মাছ ব্যবসায়ী পাঠিয়েছে। বলে ছেলেটা ডাকাত হিসাবে ভালো। অস্ত্র চালাতে পারে। কালেকশনের দায়িত্ব দিলে ভালো করবে।
সারেন্ডার নিয়ে আমাদের শ্যুটিং শেষ। এখন পরিবেশ খুব সুন্দর। বাতাস বেড়েছে। রাত জাগা শরীরটা যেন একটু স্বস্তি পেলো। পানি অনেক কমেছে। ভাটা তিন পোয়া। দুই পাশের ডাঙ্গা জেগেছে। ছোট খালটি এবার স্পষ্ট। চওড়ায় খুব বেশি হলে তিন ফুট। একটি নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দস্যুনেতা বারেক তালুকদার আর আমি। আর কেউ না।
কিছু ব্যক্তিগত ও গোপন কথা বলবেন বারেক ভাই। আলাদা করে একটু সময় দেই। অনেক খবর পাই। অন্য দস্যু দলের খোঁজ খবর থাকে তাদের কাছে। জানতে পারি লোকালয়ের কারা তাদের সহযোগিতা করে, কারা তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়! গল্পে গল্পে আরও অনেক গোপন তথ্য বেরিয়ে আসে। বিশ্বাস করে এমন তথ্য দিয়ে দেন তাঁরা যেগুলো বুকে বন্দুক ধরলেও অন্যদের বলবে না। আমি সেই কথাগুলো শুনি। মাথার ভিতরে মজুত করে রাখি। সেই তথ্যের ব্যবহার করি বা করি না।
নৌকার ঠিক মাঝখানে বসলাম। গলুই-এ বসে বৈঠা হাতে নিলেন দস্যুনেতা। এবার যা করলেন তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। একটা বন্দুকে গুলি ভরে আমার হাতে দিলেন। বললাম, বন্দুকের দরকার নাই। দরকার হলে আরেকজন আসেন। কিন্তু সরদারের নির্দেশ, কেউ উঠলো না। শুধু গুলি ভর্তি একটি বন্দুক রাখলো আমার পাশে। দস্যুনেতা বললেন, ওটা থাকুক ভাই।
রওনা দিলাম আমরা। ওই তিনফুটি জোলা খালে সম্ভবত পানি ভালোই আছে। দুই পাশে হরজগা গাছ। অচেনা কিছু ঝোপঝাড় আছে। আর আছে হেঁতালের ঝোপ। মিনিট পনেরো গেলে এই খাল পড়েছে আরেকটি ছোট খালে। ওখান থেকে আন্ধারমানিক যাওয়া যায়। আবার হাড়বাড়িয়াতেও যাওয়া যায় নৌকা নিয়ে। সেজন্য কয়েকটি খাল আর ভাড়ানী পাড়ি দিতে হবে। কিছু দূর আসার পর মূল গল্প শুরু হলো। মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর পর তারা আমার সাথে যোগাযোগ করতে চায়। নাম্বার খুঁজতে গিয়ে ফোন দেয় ঘনিষ্ঠ এক মাছ ব্যবসায়ীকে। সেই ব্যবসায়ী নিজে মাছ ধরে না, দাদনের জেলেও নাই। কিন্তু লোকালয়ে বসে বেশ রোজগার করেন। ডাকাতদের বিশ্বস্ত হিসাবে জেলেদের কাছ থেকে চাঁদার টাকা তোলাই তার প্রধান কাজ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স। আবার আমারও সোর্স।
সাদা ফতুয়া আর সাদা লুঙ্গি পড়ে সেই ব্যবসায়ী ঘুরে বেড়ান। বারেক ভাই তার কাছে আমার ফোন নাম্বার চান। শান্ত বাহিনী সারেন্ডার করতে চায় শুনেই বলেছে আমার সঙ্গে কথা বলে তারপর নাম্বার দিবে। তারপর দিনের পর দিন চলে গেছে। আমি তখন ব্যস্ত মজনু আর ইলিয়াসের সারেন্ডার নিয়ে। ওই সোর্স কাম ব্যবসায়ী আমার সাথে কথা বলাবে বলে টাকা দাবী করে এই দস্যুনেতার কাছে। শুনে হেঁসে দিলাম। জানতে চাইলাম, আমাকে কতো টাকা দিলেন?
বারেক বললেন, কয়েক দফায় লাখ দুই তো দিছি ভাই। পাননি আপনি? বললাম, সে হিসাব পরে হবে তারপর কী হলো বলেন? তারপর সে বলে যে সারেন্ডার করতে অনেক টাকা লাগে। মাস্টার বাহিনী নাকী ২৫ লাখ টাকা দিয়ে সারেন্ডার করছে। বললাম, আমার কাছে তো অতো টাকা নাই। তখন সেই ব্যবসায়ী বলেছে, মোহসীন ভাইকে পাঁচ লাখের মধ্যে রাজি করাবে সে। তবে টাকা উনি সরাসরি নেন না। তার মাধ্যমে দিতে হবে। তারপর? বললেন, তারপর আমার সন্দেহ হলো। এরপর একদিন একটা অস্ত্রসহ জুয়েলকে পাঠালো। বললো, জুয়েলও সারেন্ডার করবে। তারপর বললো, জনপ্রতি চল্লিশ হাজার টাকাও দিতে হবে প্রশাসনকে।
একটানা কথাগুলো শুনলাম। আমার নামে টাকা-পয়সার লেদনেদ হয় শুনি। কিন্তু সেটা এই পর্যায়ে চলে গেছে? সেই সোর্সকে আমি বিশ্বাস করতাম না, তবে ব্যবহার করতাম। যোগাযোগ ছিলো। ফোনে কথা হতো প্রায়। সেই কথোপকথন রেকর্ড করা থাকতো। কিছু কিছু কল রেকর্ড অন্যদের শোনাতো। আমার সাথে তার সম্পর্কের গভীরতা প্রমাণের জন্য সেটি ব্যবহার করতো। মোবাইল ফোনে আমার সাথে তোলা ছবি ব্যবহার করতো জায়গায় জায়গায়।
নৌকা চলছে। আমি স্তব্ধ হয়ে শুনছি দস্যুনেতার কথা। উনি বললেন, বন্দুকটা একটু হাতে নেন ভাই। সেফটি লক খোলা আছে। নলটা বাইরের দিকে রাখেন শুধু। এখানে দুইপাশ শুকনো। ঘন হেঁতাল বন দুই পাশেই। টাইগার ফার্ণ-এর ঝোপগুলো দেখেই ভয় লাগে। মনে হয় যেন বাঘ লুকিয়ে আছে ওর ভিতরে। বারেক তালুকদার বললেন, এই জায়গায় বাঘের চাপ বেশি। বেশি মানে খুব বেশি।
বারেক ভাই বললেন, এদিকে তিনটা বাঘ ঘোরাঘুরি করে। হাতে কেন বন্দুক দিয়েছে তারা এবার বুঝলাম। তবে কিছুতেই বন্দুক ব্যবহার করতে চাই না। সেটি আইনসিদ্ধও না। আবার দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বললাম, নৌকা ঘুরান। বললাম, বাঘের আক্রমণে মরলে আমার আর লোকালয়ে ফিরা হবে না। আমি না ফিরলে ওই সোর্স কাম মাছ ব্যবসায়ীর সাথে দেখা হবে না। তার সাথে আমার হিসাবগুলো নেওয়া হবে না।
দস্যুনেতা বলছেন, সেভাবেই চলছিলো। আমি তো বিশ্বাস করে দশ হাজার, বিশ হাজার করে টাকা পাঠাচ্ছি। সে বলে, মোহসীন ভাই ঢাকায়, বেশি ব্যস্ত। তবে উনি আসবেন। আমাকে ইমোতে কিছু কল রেকর্ডও পাঠাইছে আপনার। তারপর দেখি মজনু-ইলিয়াস বাহিনী আত্মসমর্পণ করলো। ওই ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, আরও দুই বাহিনী সারেন্ডার করে ফেললো, আমাদের কিছু জানালেনও না। কল রেকর্ডগুলো ছিলো নানা বিষয়ে সাধারণ কথোপকথন। তাতে শান্ত বাহিনীর সারেন্ডার সংক্রান্ত কোনো কথা ছিলো না।
দস্যুনেতাকে বললাম, আপনার সাথে প্রতারণা করেছেন উনি। উনি বললেন, সন্দেহ হইছে। তারপর বশিরকে বললাম। সে বললো যে সারেন্ডার করতে এক টাকাও লাগে না। এরপর সে আপনার সাথে যোগাযোগ করলো।
ঘটনাগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছে। চাপ দিয়ে, অন্ধকারে থাকা দস্যুদের ব্ল্যাকমেইল করে অঢেল টাকা রোজগার করে এই দালালরা। আমার নামে টাকা ওঠে। আমার নামে সুন্দরবনের খাল বরাদ্দ হয়। আবার কখনও আমার নামে কোনো কোনো জেলে দস্যুদের হাত থেকে রেহাইও পায়। অদ্ভুত এক সমীকরণ। হিসাব মিলাতে পারি না। বুঝতে পারছি, সারেন্ডারের প্রক্রিয়ায় ভিতরে এই টাকা পয়সার লেনদেনটাকে থামাতে হবে। জনে জনে কী করে বুঝাবো যে সারেন্ডার করতে টাকা লাগে না?
নৌকা বাইছেন দস্যুনেতা বারেক তালুকদার। অস্ত্রটি কোলে রাখা। এদিকে আমার ঘুমহীন শরীরটা আরাম চাইছে। নৌকায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। গহীন সুন্দরবনের ভিতরের এই সরু খাল, গা ছমছম করা পরিবেশটা ভালো লাগছে। নির্মল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। দুই চোখ জুড়ে ঘুম চলে আসছে। পাশে রাখা দস্যুদের বন্দুকটি পানিতে পড়ে যেতে পারে। তাই সেটি উঠিয়ে আমার কোলে নিলাম। বারেক তালুকদার কথা বলেই যাচ্ছেন। নৌকা যাচ্ছে আমাদের ট্রলারের দিকে। ঘুমের ঘোরে শুনছি, বন্দুকের নলটা নিজের দিকে রাখছেন কেন? সেফটি লক কিন্তু খোলা! চাপ লাগলে গুলি বের হয়ে যেতে পারে!
(ছবি: রাত জেগে ক্লান্ত শরীর, বনদস্যুদের ডেরায়)