জেলেদের মাছ কেড়ে নিতো দস্যুরা | রূপান্তরের পল্প ০৬ | Rupantorer Golpo 06 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের পল্প ০৬ : একটা গলদা ধরতে কতো হাজার বার যে আল্লাহকে ডাকি। সেই মাছ যদি ডাকাইতে নিয়ে যায়! কী দীর্ঘশ্বাস সেই কণ্ঠে! কথাগুলো বলছিলেন খুলনার এক প্রবীণ বইশেল (বড়শির জেলে)। বলছিলেন, বনদস্যু শান্ত বাহিনী আসছিলো। কিছু বলেনি, শুধু মাছগুলো নিয়ে গেছে। সুন্দরবনের হারবাড়িয়া খালের ভিতরের ঘটনা। মনে মনে সেই শান্তকে খুঁজছিলাম সেদিন থেকেই।
এক বছর পরের ঘটনা। তখন সারেন্ডার শুরু হয়ে গেছে। মাস্টার, ইলিৃযাস আর মজনু বাহিনী সারেন্ডার করে ফেলেছে। তখন কথা চলছিলো সেই শান্ত বাহিনীর সঙ্গে। আমরা দেখা করবো পূর্ব সুন্দরবনের সেই দস্যু বাহিনীর সঙ্গে নির্দিষ্ট দিনে।
মংলা খেয়া ঘাট ধরে চুপচাপ হাঁটছিলাম। এমন সময় বাচ্চাসহ এক নারী সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখে মুখে কান্না। শান্ত বাহিনীর প্রধানের স্ত্রী সন্তান তাঁরা। হাত ধরে কথা দিলাম ফিরিয়ে আনবো শান্ত বাহিনীকে।
দুপুরের পর রওনা হলাম মংলা থেকে। পশুর নদী পেরিয়ে সেলা নদীতে ঢুকতে সন্ধ্যা হয় হয়। উজান ঠেলে এগুচ্ছি। কথা ছিলো আন্ধার মানিক ফরেস্ট অফিস ফেরিয়ে যাওয়ার পর আমাদের আলোর ইশারা দেয়া হবে। চাঁদপাই ফরেস্ট অফিস পার হলাম। মৃগামারি পার হয়ে একটু বিশ্রাম নিতে ট্রলারের ভিতরে গেলাম। আন্ধার মানিক খাল আসতে আরও এক দেড় ঘন্টা। এই ভেবে একটু বিছানায় গেলাম। কিন্তু শার্ত বাহিনী অবাক করে দিলো আমাদের। আগেই এলো ইশারা। বের হয়ে পাল্টা ইশারা দিলাম। ডান পাশের ছোট্ট একটা খাল থেকে নৌকা বেরিয়ে এলো। ট্রলার ঘুরিয়ে ঢুকলাম সেই খালে। জোলা খাল। ঝোপঝাড়ে ভরা। কোনো রকমে ট্রলার বাঁধলাম সেখানে।
দুটি নৌকা। ছয়/সাত জন সশস্ত্র ডাকাত। প্রথম দেখা। ভেবেছিলাম সেই শান্ত নিশ্চয়ই দেখতে ভয়ঙ্কর হবে। আবারও ধোঁকা খেলাম। সাদামাটা একজন মানুষ এগিয়ে এলেন। উনিই দস্যুদলের নেতা- শান্ত। শুরুতেই বলে ফেললাম সেই বইশেলের কথা। উত্তরে আবার অবাক হলাম। বললেন, তিনি বারেক তালুকদার। সেই শান্ত মারা গেছে বন্দুক যুদ্ধে। তারপর সবাই মিলে তাকে নেতা বানিয়েছে। বললাম, তাহলে দলের নাম বারেক বাহিনী দিলেন না কেন? পাশ থেকে আরেক দস্যু মনির বললেন, পুরনো নামেই কালেকশন ভালো হয়।
আজকের রূপান্তের গল্পটি একটু বড় হয়ে গেলো। আসলে লিখতে বসলে খুঁটিনাটি অনেক কথা মনে পড়ে যায়। যাই হোক। সারা রাতের গল্পে বুঝলাম এলাকার মামলা আর শত্রুতা সামাল দিতে না পেরে দস্যুতায় নেমেছেন তারা। সারেন্ডারের সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। কিছুদিন পরেই সারেন্ডার করলো শান্ত বাহিনী। সেই সারেন্ডারও বেশ ঘটনাবহুল ছিলো। আরেকদিন লিখবো। ফিরে আসার আগে বারেক তালুকদারকে বললাম সেই বইশেলের গলদা মাছের টাকা পরিশোধ করে দিবেন। মাস খানেক পরে ফোনে জানিয়ে ছিলেন যে সেই টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। অবশ্য সেই প্রবীন বইশেলকে আর খুঁজে পাইনি। চার মাস পর বারেক তালুকদারকে জঙ্গল থেকে ফিরিয়ে এনেছিলাম। পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলাম আমার দায়িত্ব শেষ। এবার ভালো মতো চলার দায়িত্ব আপনাদের। একটা মুদির দোকান দিয়ে নতুন জীবন শুরু হয়। এখন সেই দস্যুনেতা মাছ ধরছেন সুন্দরবনে।
সুন্দরবনের বইশেলদের মাছ এখন আর কেউ কেড়ে নেয় না। কিন্তু মহাজনে দামও দিতে চায় না। এখানে রূপান্তরটা হচ্ছে খুব ধীরে।