সেলার জঙ্গল খুব খারাপ, বাঘ-কুমিরে হামলা করে যখন তখন | রূপান্তরের গল্প ১৮৯ | Rupantorer Golpo 189 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৮৯ : একবার বাঘের সামনে পড়লাম। ভাবলাম, জীবনটা বোধ হয় গেলো এবার। চোখের সামনে সুন্দরবনের বাঘের বিশাল ওই মুখ। হাত-পা অসাড় হয়ে গেলো। বউ-বাচ্চার কথা মনে পড়লো শুধু। ভাবছিলাম, আর দেখা হবে না ওদের সাথে… নৌকায় বসে বাঘ দেখার গল্প করছেন মঠবাড়িয়াে এক জেলে। বনদস্যু শান্ত বাহিনীর ডেরায় বসে শুনছিলাম সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা। যতদূর মনে পড়ছে ওই জেলে ভাইয়ের নাম কাশেম ফরাজী, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে।
চরপাটা জাল পাতা ছিলো ওই হরিণটানার উল্টা দিকের চর-এ। বললাম, ওই জায়গা তো কুমিরের কারখানা! কাশেম ভাই বললেন, সেলা গাঙ-এর মধ্যে কুমির আছে না হলে কয়েকশ’। এদের মধ্যে জয়মনির এদিকের কুমিরগুলো মানুষ মারে। নিচের দিকেরগুলো মানুষ দেখলে সরে যায়, ডিসটার্ব করে না। জেলেরাও এড়িয়ে চলে কুমির। কিন্তু মাছ ধরতে হলে তো পানিতে নামাই লাগে। কপালে যদি কুমিরের মুখে মরণ থাকে তাহলে তো করার কিছু নাই। সুন্দরবন ছাড়া তো পেট চলবে না। কললাম, ওই বাঘের কাহিনী বলেন।
সবাই চুপ হয়ে গেলো। কাশেম বলছেন বাঘের মুখে পড়ে কী করে বেঁচে ফিরলেন! বললাম, মামায় টার্গেট করছিলো কাকে? বললেন, কাকে আবার? আমার থেকে চার হাত সামনে দাঁড়ানো মামা। সে কী চেহারা তার! আপনেরা সামনে দাঁড়াতে পারবেন না, জ্ঞান হারাবেন। চরপাটার মাছ কুড়াচ্ছিলাম। সেদিন ভাটার মতিগতি বুঝতে বুঝতে একটু দেরি হলো। জোয়ারের পানি আসার আগেই মাছগুলো ধরতে হবে। তাই শুধু বড় মাছগুলো তুলতে তুলতে আগাচ্ছিলাম। এমনিতে জঙ্গলের দিকে খেয়াল রাখি।
কিন্তু তাড়াহুড়োয় সেদিন বাঘের কথা মাথায় ছিলো না। মাছও পড়লো সেই জালে। বড় মাছগুলো ধরি আর ড্রামের মধ্যে রাখি। এর মধ্যে হঠাৎ মামা বলে চিৎকার দিলো পাশের জন। পিছনের জনও বললো, ও কাশেম, তোমার সামনে বাঘ। মুখটা তুলে দেখি মামা। বিরাট খারাপ সে চেহারা। হা করে হুসহুস করছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে ঝরঝর করে। আক্রমণ করবে, দেখি লেজও বাড়ি দিচ্ছে কাঁদার ওপর।
মনের সাহস সব একসাথে করলাম ভাই! ও হুঙ্কার দিচ্ছে, আমিও চিৎকার দিচ্ছি। জালের একটা কচা (খুঁটি) টান দিয়ে তুলে কাঁদার উপর বাড়ি দিতে থাকলাম। ততোক্ষণে সাথের লোকজন একটু সাহস পাইছে। কচা তুলে নিয়ে সবাই চিৎকার করতে করতে আগায়ে আসলো। বাঘ ভেচকি দিচ্ছে। আমরাও ভেচকি দিচ্ছি। এক সেকেন্ডের জন্য ওর চোখ থেকে চোখ সরাইনি। একটু অন্য দিকে তাকালেই বাঘ হয় অ্যাটাক করবে, না হয় জায়গা পরিবর্তন করবে। তারপর অন্য দিক থেকে আক্রমণ করবে।
তারপর কী হলো? কাশেম ভাইয়ের চোঁয়াল শক্ত হয়ে আসলো। বললেন, বাঘের সামনে পড়ে যদা ভয় পান তাহলে আপনি শেষ। আমরা সবাই মিলে প্রচুর চিৎকার করলাম। লাঠির বাড়ি দিলাম। তর্জন গর্জন করতে করতে মামা পিছু হটলো। তারপর মিলিয়ে গেলো জঙ্গলে। এরপর আর কিছু মনে নাই। অজ্ঞান হয়ে কাঁদার উপর পড়ে গেছি। রাতে অনেক জ্বর আসলো। আমরা মাছ ধরা বন্ধ করে বাড়ি ফিরলাম। কাশেম বললেন, তারপর প্রায় এক বছর করিনি ভাই।
বনদস্যুদের সাথে বাঘের দেখা হয় না? বারেক ভাই বললেন, জঙ্গলে থাকবো আর মামার সাথে দেখা হবে না? ওই যে বড় ডাকাত ছিলো জাহাঙ্গীর বইশেল, তাকেও তো বাঘে নিলো। ওই দুবলার চরের জঙ্গল থেকে নিছে তাকে। সাথে তার ভালো অন্ত্র ছিলো। গেছিলো একা একা হরিণ মারতে। সেই আশির দশকের কথা। সেই ডাকাত সরদার বাঘও মারতো। কিন্তু সেইবার শিকারে গেলো, আর ফিরলো না। জানতে চাইলাম, দুবলার চরের কোন দিকে ঘটলো সেটা? বললেন, আলোর কোল আর মেহের আলীর চরের মাঝখানে জামতলা আছে। সেখানে নৌকা রেখে শিকারে গিয়ে বাঘের সামনে পড়ে জাহাঙ্গীর। আসতে দেরি দেখে অন্যরা তাকে খুঁজতে যায়।
সেখানে রক্ত আর বইশেলের ছেঁড়া কাপড় পড়ে ছিলো। সবাই মিলে খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া যায় তার লাশ। গলার কাছে শুধু কামড়ের দাগ ছিলো। বাঘ তাকে খায়ওনি। আরেক দস্যু ভান্ডারী বললো, লোকে বলে ওটা বাঘ ছিলো না। অন্য কিছু। সুন্দরবনের বইশেল (বড়শির জেলে) থেকে সে বড় ডাকাত হইছিলো। কিন্তু জেলেদের ওপর অতিরিক্ত অত্যাচার করতো। সেজন্যই নাকী তাকে বাঘেও খায়নি।
একই গল্প অনেকের মুখে শুনেছি। কেউ কেউ তো বলে সুন্দরবনে অনেক রহস্য আছে। পোরো নামের এক প্রকার অশরীরী কিছু আছে, জ্বীন-ভুতের মতো। জাহাঙ্গীর বইশেলকে নাকী ওরাই মেরেছে। বাঘ মারলে তো শরীরের কোথাও থেকে মাংস খেতো। লাশটা ছিলো অক্ষত। এসময় মনির বললো, বাঘেও এভাবে মানুষ মারে। তোমরা জানো না। বললো, যেসব বাঘের বয়স কম। ওরা শিকার করা শিখে। বিড়ালের মা যেমন বাচ্চাকে শিকার করা শিখায়। বাঘেও তার বাচ্চাদের শিখায় কী করে শিকার ধরতে হবে। এক দেড় বছরের বাঘের বাচ্চা গায়ে গতরে বড় হয়। কিন্তু পরিপূর্ণ শিকার করতে পারে না। মানুষ হোক, হরিণ হোক লাফ দিয়ে পড়ে। ঘাড় মটকে শিকার মেরে হাঁটা দেয়। আসলে বাঘ নিয়ে সুন্দরবনে গল্পের শেষ নাই। শুনতে ভালোও লাগে।
আপনারা বাঘ দেখেননি? বলতেই দস্যুদলের সবচেয়ে তরুণ ছেলেটা মুখ খুললো। বললো, এদিকে বাঘের চাপ মেলা। জঙ্গলে নামতেই ভয় লাগে। যেখানে নামবেন সেখানেই দেখবেন পায়ের ছাপ। মাঝে মাঝে ডাকাডাকিও করে। বললাম। হাতে বন্দুক থাকলে ভয় কীসের? বললো, বাঘ সামনে পড়লে বন্দুকের কথা মনে থাকে না ভাই! এবার বেলায়েত সরদারের বাঘ দেখার গল্প শুনলাম। তারপর কুমিরের গল্প শুনলাম বশিরের মুখে। ভয়ঙ্কর সেই ঘটনা।
আগেই জানতাম সেলা নদীর কুমিরের কথা। জয়মনির ওদিকে নাকী হামলে পড়ে জেলেদের উপর। আর কিছু না হলেও নদীর পাশে চড়ে বেড়ানো ছাগল, ভেড়া ও গরু টেনে নিয়ে যায়। সুযোগ পেলে মানুষকেও ছাড়ে না। বশিরের মুখে শুনলাম পুরো গল্পটি। বলছেন, জেলে বহর নিয়ে মাছ ধরতে এসেছিলো তার ভাই। মৃগামারী খালের উল্টো দিকের চরে পাটা জাল দিতো তারা। এই জাল পাততে হয় চর জুড়ে। খুঁটি পুঁতে পুঁতে জাল টেনে দিতে হয় ভাটায়। জাল থাকে নিচের দিকে। পুরো জোয়ার হলে পানিতে নেমে সেই জাল টেনে দেয় জেলেরা। ভাটার সময় পানি সরে গেলে মাছগুলো সব আটকা পড়ে কাঁদা ও চরের মধ্যে।
বশিরের ছোট ভাই সেবার জোয়ারের সময় জাল টানতে নদীতে নামে। বিশাল এক কুমিরে টেনে নিয়ে যায় ছোট ভাইকে। সবকিছু চোখের পলকে ঘটে গেলো। পাল্টা আক্রমণ করার আগেই পানিতে ডুব দেয় কুমির। মিনিট খানেক পর নদীর আরেক পাশে ভেসে ওঠে। বিশাল কুমির! তার দুই চোঁয়ালের ভিতর বশিরের ছোট ভাই। বলতে বলতে বশিরের চোখে পানি চলে আসলো। আমাদেরও মনটা খারাপ হলো খুব। এরপর কী হলো? জানতে চাইতেই বেলায়েত সরদার স্টিলের থালায় চামচের বাড়ি দিলেন। বললেন, বাঁকী গল্পটা খেতে বসে শুনবেন। এখন সবাই বসে পড়েন, খাবার রেডি।
খেতে বসলাম সবাই মিলে। কাউইন মাছের ওই স্বাদ কখনও ভুলতে পারবো না। সেই রান্না! খেতে বসেই দস্যুনেতা বারেক তালুকদার বললেন, আপনারা আমার মেহমান। কিন্তু কিছুই খাওয়াতে পারলাম না। বললাম, সারেন্ডার করে বাড়ি ফিরেন। রাজহাঁস দিয়ে একবার খাবো আপনার বাড়িতে গিয়ে। কথা ঘুরিয়ে বশিরকে বললাম, কুমির আর আপনার ছোট ভাইয়ের কাহিনীটা শেষ করেন।
(ছবি: মাছ ধরতে জঙ্গলে নেমে পড়ে জেলেরা। বাঘ কুমিরের খেয়াল থাকে না)