দুই-এ দুই-এ চার মিলানো সহজ না | রূপান্তরের গল্প ১৯২ | Rupantorer Golpo 192 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৯২ : ২০১৬ সালের মধ্য আগস্ট। শান্ত বাহিনীর সাথে আমার দেখা হওয়র খবরটি তখনও চাউর হয়নি। কিন্ত খুলনায় খবর পৌঁছে গেছে। শান্ত বাহিনী পূর্ব সুন্দরবনের দস্যুদল। আবার মংলাও পূর্ব দিকে। দস্যুরা আমার সাথে যোগাযোগের বিষয়টি গোপন রেখেছে। কিন্তু খুলনায় যে কী ভাবে গেলো খবরটি? আমার সহযাত্রীরা কোথাও জানাননি। বারেক তালুকদারকে ফোন করে বললাম, আপনাদের ভিতর থেকে খবর বের হচ্ছে। দস্যুনেতা বেশ অবাক হলেন। খতিয়ে দেখবেন বলে ফোন রাখলেন।
ওদিকে পশ্চিম সুন্দরবনের দস্যুদল আলম বাহিনীর সাথে পরিপূর্ণ যোগাযোগ চলছে। কিন্তু দ্রুত সারেন্ডারের বিষয়ে তার আগ্রহ কম। বারবারই বলছেন, একটু গুছিয়ে তারপর সারেন্ডার করবেন। গোছোনের অর্থ ঠিক বুঝতে পারছি না। ভালো করে আবার খোঁজ নিলাম। যা বুঝলাম, অস্ত্রশস্ত্র কেনাকাটা নিয়ে লেনদেন বাঁকী তার। এ দফায় সুন্দরবনে ডাকাতি করতে নামার সময় একজনের কাছে বেশ কিছু টাকাও অগ্রিম দিয়েছে। টাকাটা ফেরত নেওয়া বা অস্ত্রগুলোর ডেলিভারি নিয়ে চলছে দেন দরবার। বিষয়টি জটিল বলে তখন মাথায় নেইনি। শুধু বললাম, সময় হলে ডাক দিবো। সারেন্ডার করতে হলে তখনই আসতে হবে।
ক’দিন পর শান্ত বাহিনীও পিছুটান দিলো। দলের ভিতরে ঝামেলা শুরু হয়েছে। আত্মসমর্পণের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত তারা। মূল সমস্যা সেই জুয়েল। ঢাকায় বসে ফোনে ফোনে সমাধানের চেষ্টা করছি। এদিকে RAB থেকে যোগাযোগ করছে ঘন ঘন। জলদস্যুরা প্রস্তুত না হলে পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সময় চুড়ান্ত করতে হবে। তার সাথে সমন্বয় করে দস্যুদের উঠিয়ে আনা অনেক ঝক্কির কাজ। এতো কিছু মাথায় নেওয়া যায় না।
কয়দিন পর জুয়েলকে নিয়ে আমার সন্দেহ বাস্তবে রূপ নিলো। সারেন্ডারকে ঘিরে দল ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করছে সে। এটুকু বুঝতে পারছি, শহরের বড় ভাইদের খেলাধূলা শুরু হয়ে গেছে। দস্যুদের ভিতরে এসব নিয়ে রক্তপাত না হয়, সেই দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এর সমাধান নাই। কিছুতেই দুই-এ দুই-এ চার মিলানো বোধ হয় সম্ভব না।
অসহায় লাগছে। পেশাদার সাংবাদিক আমি। অনেকেই বলছেন, অবৈধ অস্ত্রধারী বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ করানো সাংবাদিকের কাজ না। এবিষয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছে। সাংবাদিক মহলে আমাকে নিয়ে সমালোচনার শেষ নাই। এছাড়া সারেন্ডার করিয়ে দস্যুদের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার অপপ্রচারও চলছে। তবে একটি জায়গায় স্বস্তি ছিলো। আমার অফিস অর্থাৎ যমুনা টেলিভিশনের সমর্থন পেয়েছি সব সময়। নিউজ রুমের প্রধান ফাহিম আহমেদসহ অন্যরা কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
এক একটি দস্যুদলের কাছে যাওয়া, মধ্যস্ততা করা, সারেন্ডারের জন্য নিয়ে আসাসহ যাবতীয় কাজ বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। সময়ও দিতে হয়। সেই সুযোগ অফিস থেকে পাচ্ছি বলেই বাইরের সমালোচনা, অসহযোগিতাকে পাশ কাটিয়ে কাজ করছি। পাশাপাশি নিজের পরিবার অর্থাৎ স্ত্রী, বাবা-মাসহ সকলেই সমর্থন দিচ্ছে আমাকে। যদিও সুন্দরবনের দস্যুদের নিয়ে যে সংকটগুলো পার করছি তার কিছুই বাসা বা অফিসের কাউকে জানাই না। এসব নিয়ে আলোচনা করছি শুধু মাত্র বরিশাল RAB-এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবীর ও গোয়েন্দা প্রধানের সাথে।
কয়েকটি দস্যুদলের প্রধানদের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। তবে এই মুহুর্তে মানে ২০১৬ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে দু’টি দলের সাথে সারেন্ডারের কথা চলছে। অন্যদের এড়িয়ে চলছি। তবে হঠাৎ করেই আলিফ নামে আরেক দস্যুনেতা যোগাযোগ করছে ঘন ঘন। পশ্চিম সুন্দরবনে এই মুহুর্তে বড় ও ভয়ঙ্কর দস্যুদলটি চালায় সে, তার নামেই চলে দস্যুবাহিনী। আলিফের সাথে আগেও কথা হয়েছে। এখনও চলছে। কিন্তু সারেন্ডার নিয়ে কথা বলে না। সে বিষয়ে না বললেও আলম বাহিনীকে নিয়ে চমকপ্রদ তথ্য দিলো সে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর এক মাঝি আছে। সাগরে মাছ ধরার বিশাল একটি ট্রলার আছে। বঙ্গোপসাগরে এই ডাকাতি করতে মাঝে মাঝে সেই ট্রলারটি ভাড়া দেয় সেই মাঝি। দস্যু জগতে খোকন মাঝি নামে পরিচিত এই ব্যক্তির সাথে সুন্দরবনের দস্যুদের সাথে যোগাযোগ, সখ্য বেশ পুরনো। আগে থেকেই নামটি পরিচিত। তবে কী ভাবে দস্যুতায় সহযোগিতা করতো, সেবিষয়ে পরিস্কার ধারণা ছিলো না। আলিফের সাথে কথা বলতে গিয়ে রহস্যময় লোকটি সম্পর্কে জানছি।
আলিফের ১১টি অস্ত্র নাকী পটুয়াখালীর ওই মাঝির কাছে রাখা। রাঙ্গাবালীর চর মন্তাজে সোনার চর নামে ম্যনগ্রোভ বন আছে। সেই জঙ্গলের কোথাও লুকিয়ে রাখা সেগুলো। একই সাথে লুকানো আছে দেড় হাজারের বেশি বন্দুকের গুলি। ভাবছি আলিফ কেন এই তথ্যগুলো দিচ্ছে আমাকে? ঘটনাটি বেশ জটিল। তবে চমকপ্রদ।
এই খোকন মাঝির খোঁজ খবর নিলাম। জানলাম অনেক কিছু। কিন্তু আলিফের দেওয়া তথ্যগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ? আলিফ যে অস্ত্রগুলো নিজের বলে দাবি করছে সেগুলো ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে কেন? আর এই মুহুর্তে আমি কেন সময় দিবো? শান্ত আর আলম বাহিনীকে সামাল দিতেই তো হিমসিম খাচ্ছি!
পরের কয়েক ঘন্টা শুধু কথা বলে গেলাম। ফোন করছেন কখনও শান্ত, কখনও আলম, কখনও সাতক্ষীরার আলমগীর, কখনও মংলার বশির। এর মধ্যে আলিফ আর মেজর আদনানের সঙ্গে কথা বলছি ওই অস্ত্রগুলো নিয়ে। শেষ পর্যন্ত যা জানলাম তা হলো, খোকন মাঝির কাছে রাখা অস্ত্রগুলো আলিফের। তবে সেগুলো হারিয়ে গেছে বলে দাবি করছে সে। অন্যদিকে ওই অস্ত্রগুলো পশ্চিম সুন্দরবনের আলম সরদারের কাছে বিক্রির কথাবার্তা চুড়ান্ত হয়েছে। মোট ৮ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছে। দুই/একদিনের মধ্যে সেই অস্ত্র আলমের কাছে পৌঁছাবে। চার লাখ টাকা অগ্রিম লেনদেনও হয়ে গেছে।
সুনির্দিষ্ট নাম, ফোন নাম্বার, অস্ত্রের অবস্থান পেয়ে গেছি ততোক্ষণে। সন্ধ্যা নাগাদ সবকিছু নিশ্চিত হয়ে বরিশালে আদনান কবীরের কাছে পৌঁছে দেই। গভীর রাতে বরিশাল RAB-এর টিম রওনা দেয়। ওদিকে নদী পথই একমাত্র পথ। হলাচিপা থেকে আগুনমুখা নদী ধরে যেতে হবে রাঙ্গাবালী। তারপর চর মন্তাজ-এ খোকন মাঝির বাড়িতে অভিযান চালাতে হবে। ওদের আটক করে সোনার চরে জঙ্গলের ভিতরে লুকিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো বের করতে হবে। লম্বা কাজ। যথেষ্ট ঝুৃ্কিপূর্ণ। আবার সেই জায়গায় গিয়ে শেষ পর্যন্ত অস্ত্র-গুলিগুলো পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তাও নাই। পুরোটাই নদী পথ। আর চর সোনার চরের অবস্থান সাগরের মুখে। আগস্ট মাস। নদী-সাগরও বেশ উত্তাল। স্পিডবোট চালিয়ে রাতের বেলা রওনা দেয় RAB। ওই রাতে আর কিছু জানতে পারলাম না।
(ছবিতে আমার পাশে সেই সময়ের RAB কর্মকর্তা মেজর আদনান কবীর। বলেশ্বর নদী। ২০১৬)