রূপান্তরের গল্প ১০০ | Rupantorer Golpo 100

ধরা পড়লো প্রতিপক্ষের গুপ্তচর! পাখি মরতো! কুমির মরতো! বাঘও মরতো! | রূপান্তরের গল্প ১০০

ধরা পড়লো প্রতিপক্ষের গুপ্তচর! পাখি মরতো! কুমির মরতো! বাঘও মরতো! | রূপান্তরের গল্প ১০০ | Rupantorer Golpo 100 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১০০ : ভয় করতেছে মামা। আমাদের নিয়ে যাইয়েন না। এখানেই রাইখে যান। আমরা রাতের জোয়ার ধরে বাড়ি যাবো… কাঁকড়ার জেলেরা বলছিলো, আমরা নিরীহ জেলে, সামনে কী বিপদ হয় কে জানে। আমাদের ছাইড়ে দেন। আর জঙ্গলে আসবো না। জোন খাইটে চলবো, ভ্যান চালাবো, ইঁটের ভাটায় কাজ করবো, তবুও সুন্দরবনে আর আসবো না। গরগর করে বলে যাচ্ছে তারা। রান্না ঘর থেকে বের হতেই জেঁকে ধরেছে আমাকে। তারা দস্যুদেরকে বিশ্বাস করে না, ফরেস্টারদের বিশ্বাস করে না, আমাদেরও বিশ্বাস করছে না। তাহলে কি ওদের এখানে রেখে যাবো?

সুন্দরবনের জেলেরা নিজেদের নিরীহ বলে, আমরাও লিখি। কিন্তু কোনো নিরীহ মানুষওই গহীন বনের বৈরী পরিবেশে টিকে থাকতে পারবে? অসম্ভব। প্রচন্ড মানষিক শক্তি, সাহস আর ক্ষীপ্রতা নিয়ে জঙ্গল করে তারা। শারীরিক ভাবেও বেশ মজবুত। বাঘে আক্রমণ করলে আক্রান্ত সঙ্গীকে বাঁচাতে লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। বাঘের মুখ থেকে ছিনিয়ে আনে সহযাত্রীকে জীবিত অথবা মৃত। তাই জঙ্গলের মানুষদের আমি নিরীহ বলি না। অসহায় বলি ভিন্ন কারণে।

ওই যে তারা বলছিলো যে আর জঙ্গলে আসবে না, সেটি মিথ্যা কথা। ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথে তারা যে যার মতো করে খালে খালে ঢুকে পড়বে। অন্তত আরও ৭/৮ দিন জঙ্গলেই থাকবে। কাঁকড়া ধরবে, মন চাইলে হরিণ শিকার করবে, পাখি মারবে, কেউ নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করবে, কেউ বা বিষের বোতল নিয়ে ছুটবে সরু খালের খোঁজে। তারপর মাছ-কাঁকড়া বোঝাই নৌকা নিয়ে জোয়ার দিবে। জোয়ার দেয়া মানে স্রোতের সাথে রওনা দেয়া।

বাড়ি থেকে সুন্দরবনে যাওয়ার সময় জেলেরা ভাটার সময় রওনা দেয়। তখন পানি উত্তর থেকে দক্ষিণে নামে। আবার বাড়ি ফেরার সময় তারা জোয়ারের স্রোতে নৌকা ভাসায়। দূরের পথ হলে টানা ছয় ঘন্টা তারা বৈঠা বায়, স্রোতের সাথে নৌকা আগায়। ছয় ঘন্টা বিরতি নিয়ে আবার নৌকা ছাড়ে। এভাবে দুই/তিন জোয়ার অথবা ভাটা দিয়ে জেলেরা মাছ-কাঁকড়া ধরতে দূর সুন্দরবনে যায়। পাশাখালী থেকে কয়রায় ওই জেলেদের বাড়ি পৌঁছাতে সময় লাগবে দুই জোয়ার। মানে পুরো এক দিন।

কাঁকড়ার জেলেদের আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ মনে হয়। তবে আমি বাস্তবে তেমন দেখি না। এই যে জেলেরা বলছে যে বাড়ি চলে যাবে রাতেই, এমন ডাহা মিথ্যা কেন বলবে তারা? সারাদিন একসাথে থাকলাম, খেলাম, ভিডিও করলাম, দস্যুরা অস্ত্র গোছালো, তারপরও তাদের মনে সন্দেহ থাকে কী করে? সুন্দরবনে কাজ শুরুর আগে কোনো বিষয় নিয়ে জটিল ভাবে চিন্তা করতাম না। তবে এই রহস্য ঘেরা বনে ঢুকে সেভাবে ভাবতে শিখেছিলাম। সন্দেহ যা করেছিলাম একটু পরেই তার প্রমাণ পেলাম।

তরুন সেই জেলে। নামটা মনে পড়ছে না। কয়রায় হান্নান নামের এক বনদস্যুর বোনাই (বোন জামাই) সে। হান্নান আবার বনদস্যু জাহাঙ্গীরের মেয়ের জামাই। তার মানে এই জায়গায় ছেড়ে দিলে বা আমরা পাশাখালী ছাড়ার সাথে সাথে সে হান্নান বা জাহাঙ্গীরকে ফোন দিবে! কী সর্বনাশ! বলছিলাম না যে সন্ধ্যার আগে থেকেই মনটা কেমন করছে?

জেলেদের কাছে যে কয়টা ফোন ছিলো আগেই সব জব্দ করা ছিলো। সেগুলো আনালাম। ওই তরুণ জেলের তখন চেহারা শুকিয়ে গেছে। বললাম, তোমার ফোন কোনটা? বললো, তার কোনো ফোন নাই। হুট করেই কৌশল খাটালাম। বললাম, জেলেরা সবাই যার যার ফোন নিয়ে যান। আপনাদের ছেড়ে দিবো একটু পর। সবাই নড়ে চড়ে উঠে দাঁড়ালো। সম্ভবত ৭/৮ টা ফোন ছিলো তাদের। একটা ছাড়া বাঁকীগুলো নিয়ে গেলো।

এই ফোনটা কার? কোনো উত্তর নাই। ইতস্তত করে সেই ছেলেটি বললো, এটা আমার ফোন মামা। তার অনুমতির তোয়াক্কা না করে ফোন খুললাম। ডায়াল লিস্টে ঢুকলাম। নাম্বারগুলো দেখালাম দস্যুদের একজনকে। শেষের নাম্বারটি মিলিয়ে দেখি-দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরের নাম্বার! এবার মনে পড়লো, পরে যে কাঁকড়ার নৌকাটি এসেছিলো সেই নৌকার মালিক এই ছেলেটি! সকালের দিকে সবশেষ তাদের মধ্যে কথা হয়েছে! তার মানে মাস্টার বাহিনীর প্রতিপক্ষ দস্যুদল জাহাঙ্গীর বাহিনীর গুপ্তচর সে!

পিছন থেকে ধুম করে একটা বাড়ি দিলো একজন। আমি আগলে ধরলাম। বললাম এসব চলবে না। কেউ কারও গায়ে হাত তুলবেন না। সকাল থেকে ছেলেটা আছে। আমাদের সব খবর নিচ্ছে। সারাদিন তো কিছু টের পাওনি। এখন আমি ধরলাম, তোমরা এসে মারপিট শুরু করলে! যদি জাহাঙ্গীরকে এদিকের খবর দিয়ে দিতো? যদি কোনো ভাবে একটা ফোন করতে পারতো জাহাঙ্গীরকে তাহলে এতোক্ষণে আমাদের উপর আক্রমণ হয়ে যেতো। ওরা কিন্তু গত রাতে ভ্রমরখালীতে ছিলো। এখান থেকে বেশি দূর না। আসতে তিন ঘন্টা সময় লাগবে!

ছেলেটাকে ফরেস্ট অফিসের ভিতরে রেথে চললাম খাল পাড়ে। কয়রার ওই নৌকাটা টেনে আনলাম। ভালো করে চেক করতে বললাম। কোনো মূল্যবান সম্পদ বা টাকা পয়সা থাকলে হাত দিবে না। শুধু দেখো আর কোনো ফোন আছে কী না! পুরোটা খুঁজে কোনো ফোন পেলাম না। তবে যা পেলাম তা আরও ভয়ঙ্কর। জাহাঙ্গীর বাহিনীর চাঁদার স্লিপ। মানে দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরের বিশ্বস্ত সে, একদম নিজের লোক! একটু সুযোগ পেলেই পালিয়ে যেতো, অথবা ফোন করার সুযোগ পেলে আমাদের কথা জানিয়ে দিতো। সেই দায়িত্ব নিয়েই এসেছিলো সে। যদিও জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করলো না সে কথা।

এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিৎ? মাথা ঠান্ডা করে ভাবলাম। ছেলেটা ধরা পড়ে গেছে। ওই নৌকায় আরেকজন যে ছিলো তাকেও আলাদা করলাম। এরপর দু’জনকেই বেঁধে ফেলা হলো আমাদের ট্রলারে। শাস্তি দেয়ার জন্য না, তারা যাতে না পালায় সেজন্য। কারণ ধরা পড়ার পর ছাড়া থাকলে তারা পালাবেই পালাবে। ওরা জানে দস্যু দুনিয়ায় গুপ্তচরবৃত্তির শাস্তি একটাই, মৃত্যুদন্ড।

সন্ধ্যার পর এসব নিয়ে সময় কাটছিলো। বেলায়েত সরদার বলছিলো, ভাই, আপনি মানুষ না, আপনি হলেন জ্বিন! কেন কেন? কেমন করে সবকিছু বের করেন আপনি? এই সুন্দরবন থেকে যদি চোর-ডাকাত কেউ সরাতে পারে, সেটা আপনি। মনে মনে হাসলাম। বললাম, এই জগতে ঢুকছি যখন তখন কিছু একটা তো করতেই হবে। সেটা যতোদিন লাগুক, যতো ঝুঁকিই আসুক। বেঁচে থাকলে কিছু একটা করেই বের হবো। সরদার বললেন, সে কথা সবাইকে বলা যাবে না ভাই! বললাম, সে দেখা যাবে। এবার বলেন রাতে কী খাবো?

বেলায়েত সরদার থাকতে কোনো টেনশন নাই। বলতে বলতে সরদার হাঁটা দিলেন অফিসের দিকে। দেখি সেই বড়শিতে ধরা টেংড়া মাছগুলো কাটাকুটি চলছে। তার মানে আমার জন্য রান্না হচ্ছে সুন্দরবনের সেই দুটি টেংড়া মাছ, যেগুলো আমিই বড়শি দিয়ে ধরেছিলাম বিকালে।

অফিসে ঢুকে জেলেদের দিকে তাকিয়ে দেখি টেনশনে শেষ! সত্যি সত্যি নিরীহ চেহারা এক এক জনের। বললাম, আপনারা কি চলে যাবেন? একসাথে বলে উঠলো, না! আমিও ছাড়বো না তাদের। কারণ পাশাখালীতে রেখে গেলে তারা অবশ্যই কোথাও না কোথাও খবর দিয়ে দিবে। আর কোনো ঝুঁকিতে পড়ার মতো মানষিক শক্তি নাই। যদিও সামনে আরও বড় বড় ঝুঁকি অপেক্ষা করছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top