রূপান্তরের গল্প ১০১ | Rupantorer Golpo 101

গুপ্তচরের মিশন সফল হলে সবকিছু ভেস্তে যেতো | রূপান্তরের গল্প ১০১

গুপ্তচরের মিশন সফল হলে সবকিছু ভেস্তে যেতো | রূপান্তরের গল্প ১০১ | Rupantorer Golpo 101 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১০১ : সন্ধ্যার পর পরই বৃষ্টি হলো। ঝড়সহ বৃষ্টি। তবে থেমেছে অল্প সময়ে। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি এমনই। শেষ জোয়ার আর শেষ ভাটায় শুরু হয়। প্রথম ভাটা আর প্রথম জোয়ারে কমতে থাকে। নদী সাগরের এই পানির ওঠা-নামার সাথে আকাশের মেঘ এর কোনো সম্পর্ক আছে কী না জানি না। তবে সম্পর্ক তো কিছু একটা আছেই।

সন্ধ্যার পর আমাদের মধ্যেও বড় একটা ঝড়-বৃষ্টি গেলো। প্রতিপক্ষ বনদস্যুদের গুপ্তচর যদি তার কাজে সফল হতো তাহলে হয়তো গল্পটা ভিন্ন হতো। হয়তো এই গল্প লিখার সুযোগ পেতাম না। আমরা যে কেউ জাহাঙ্গীর বাহিনীর হামলার শিকার হতে পারতাম, হয়তো জীবনটাও যেতো। প্রাণে বাঁচলেও সারেন্ডারটি হতো কী না সন্দেহ! যাক, ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। সকালে পাশাখালীর শেষ কাঁকড়ার নৌকাটি নজরে না আসলে হতে পারতো বড় বিপদ!

RAB এর লঞ্চটির জন্য অপেক্ষা করতে তখন আর ভালো লাগছিলো না। সহযাত্রীদের বললাম, কেউ টেনশন নিবেন না। যে যার দায়িত্ব পালন করেন। দস্যুনেতা মাস্টারসহ অন্যদের বললাম, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর চলে গেলাম পুকুর পাড়ে, নেটওয়ার্ক পেলে ফোন করবো মেজর আদনানের কাছে।একটি সূতা দিয়ে তারের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম ফোন। আবহাওয়া ভালো থাকলে এখানেই পাবো নেটওয়ার্ক।

কোনো রকমে একটু নেটওয়ার্ক পেয়েছি। সাথে সাথে ফোন ঢুকলো। ওপাশ থেকে মেজর আদনান বললেন, আপনারা ঠিক আছেন তো ভাই? বললাম, সব ঠিকঠাক। তোমরা কতদূর? জানালেন, তারা সবাই মংলায়, নদীর ঘাটে।

তখন মংলায় অর্ধেক ভাটা হয়েছে। তাই সরাসরি লঞ্চ-এ উঠা যাচ্ছিলো না। বড় সমস্যা আমাদের লাইভ এর যন্ত্রপাতি। বিরাট বিরাট বাক্সগুলো বেশ ভারী। RAB সদস্যরা বেশ কসরৎ করে সেগুলো তুলেছে। তারপর রওনা। আদনানকে বললাম, দেরি করো না ভাই, তাড়াতাড়ি আসো। আবারও মনে করিয়ে দিলাম কোথায় এসে থামতে হবে, কোথায় নোঙ্গর করতে হবে আর আমাদের মধ্যে আলোর ইশারাগুলো কী ভাবে বিনিময় হবে।

RAB এর লঞ্চ এসে নোঙ্গর করবে ভদ্রা পেরিয়ে মাঝ নদীতে। সেখানে নেটওয়ার্ক থাকবে না। তাই ইশারার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি তারা যেন এমন কোনো আচরণ না করে যাতে বনদস্যুরা ভয় পায়। বললাম, এদিকে আমাদের সামনে কিছু ঝুঁকি আছে। তাই এদিকের ওরা সশস্ত্র অবস্থায় থাকবে। এদিকে ট্রলার থাকবে মোট তিনটি। সাথে বাঁধা থাকবে কয়েটা ডিঙ্গি নৌকা। যারা সারেন্ডার করবে না তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কি আগেরটাই আছে? আদনান বললেন, সাথে স্পিডবোট আছে ভাই। ওরা যেখানে নামতে চায় সেখানে নামিয়ে দিবো আমরা। ওদের কাউকে টাচও করা হবে না। বললাম, রাত ১২টার পর পর আমরা জায়গা মতো থাকবো। সুনির্দিষ্ট লোকেশনের কথা বললাম না। কারণ আমাদের যে কারও ফোন হয়তো ট্র্যাক করা হচ্ছে, হয়তো কথোপকথনও শুনছে।

এদিকে আমার ওপর একটু অসন্তুষ্ট মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা। জাহাঙ্গীর ডাকাতের গুপ্তচর ছেলেটাকে হাতের কাছে চায়। সেজন্য ছটফট করছিলো ওরা। কিন্তু সেই ভুল করা যাবে না। গুলি করে মেরে ফেলতে পারে। জানে না মারলেও ঝুঁকি আছে বলেই তাদের দু’জনকে আলাদা করেছি। রেখেছি আমাদের ট্রলারে। আবার ভয়ে পালিয়ে না যায় সেজন্য বেঁধেও রেখেছি।

সন্ধ্যার পর থেকে বিষয়টি শক্ত হাতে দেখভাল করছিলাম। আর এসব করতে গিয়ে থমথমে পুরো পরিবেশ। শেষ মুহুর্তের এই থমথমে পরিস্থিতি নতুন কোনো ঝামেলার কারণ হতে পারে। সুন্দরবনের এই একটি দিনে কতো ঘটনা ঘটলো! সতর্ক না থাকলে বড় বিপদ ঘটে যেতো। তাই বলে উত্তেজিত হওয়া যাবে না, অন্যদেরও ঠান্ডা রাখতে হবে। আর ঠান্ডা রাখতেই দস্যুদের স্ত্রী-সন্তানদের সেখানে নিয়ে আসা।

ফরেস্ট অফিসে ঢুকলাম। ভাবীদের ঘরে গিয়ে গল্পে বসলাম। বাচ্চাদের সাথে নিয়ে একটু হেঁটে বেড়ালাম অফিসের সামনে। ওদিকে টেংড়া মাছগুলো নিয়ে নতুন করে ধুতে বসেছেন বেলায়েত সরদার। গরম পানি দিয়ে ধুতে ধুতে একদম পরিস্কার করে ফেললেন তিনি। বললেন, মাছের গায়ে মাছের গন্ধ থাকলে সেটা খাওয়া যায়? আর আপনি তো রান্না একটু এদিক সেদিক হলে খাতি পারেন না। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, পরিবেশ ঘোলাটে হয়ে আছে। রান্না করতে করতে পরিবেশটা একটু হাল্কা করেন। সরদার বললেন, ও কুনো বিপার না ভাই, আমি দেখতিছি।

কোনো কিছুই ব্যাপার না। তবে ঝামেলা বাধলে সুন্দরবনের ওই জগতে মুহুর্তেই রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সেটাই আমার দুশ্চিন্তার কারণ। মাস্টার বাহিনীর সাথে প্রথম দেখার সময় যে গোলাগুলির মধ্যে পড়েছিলাম, সেখান থেকে শিক্ষা না নেয়াটা বোকামি। সেদিন আমাদের অবস্থানের কথা নিশ্চই ওই ঝাইলোর খাল থেকেই কোস্টগার্ডের কাছে গেছিলো। সে যাত্রায় বেঁচেছিলাম বলে বার বার বাঁচবো সেকথা কেউ বলতে পারে না।

খাল পাড়ে গিয়ে আমাদের ট্রলারে উঠলাম। কয়রার দুই জেলের বাঁধন খুলে দিলাম নিজ হাতে। সবার ভিতর থেকে ভীতি কমাতে তখন সেটাই যৌক্তিক মনে করেছি। নরম করে কথা বললাম তাদের সাথে। বেঁধে রাখার জন্য অপরাধবোধও কাজ করছে। আবারও জানতে চাইলাম জাহাঙ্গীরকে কিছু জানিয়েছে কী না। উত্তর না দিলেও সে জানালো, মাস্টার বাহিনীর ওপর জাহাঙ্গীরের ক্ষোভের কথা। সুযোগ পেলে ছাড়বে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের কি এতো সাহস বা ক্ষমতা আছে?

মাস্টার বাহিনী হলো সবচেয়ে বড় দস্যু দল। আছে বেশ কয়েকজন বন্দুকবাজ দস্যু। গুলিরও অভাব নাই। ছেলেটি বললো, গত দুই সপ্তাহ ধরে মাস্টার বাহিনীর অবস্থানের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করছে জাহাঙ্গীর। সঠিক অবস্থানের খবর পেলে নিজে আক্রমণ করবে, অথবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে খবরটা দিবে। জাহাঙ্গীরের সাথে নাকী খুলনার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ ছিলো।

ছাড়া পেয়ে ছেলে দুটো কী করবে বুঝতে পারছিলো না। মামুনকে বললাম চা বানাও। বিস্কিট আর চা দাও। ওরা আমাদের মেহমান। কোনো কষ্ট না হয়। বললাম, তোমরা প্রাণে বেঁচে গেছো। আর কোনো ঝামেলায় যেও না। মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা তোমার ওপর ভীষণ রেগে আছে। এর পর কিছু হলে বাঁচাতে পারবো না।

(ছবিটি সেই সময়ের না)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top