রূপান্তরের গল্প ১০২ | Rupantorer Golpo 102

রওনা হয়েছে RAB এর লঞ্চ | রূপান্তরের গল্প ১০২

রওনা হয়েছে RAB এর লঞ্চ | রূপান্তরের গল্প ১০২ | Rupantorer Golpo 102 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১০২ : মংলা খালের জেটিতে তখন ব্যাপক হুড়োহুড়ি চলছে। RAB সদস্যরা উঠেছেন। কিন্তু বিপত্তি বেধেছিলো আমাদের লাইভ করার যন্ত্রপাতি নিয়ে। বড় বড় বাক্স, অনেক ওজন। ওই অর্ধের ভাটায় সময় সেগুলো ওঠানো নিয়ে বিপাকেই পড়েছিলো তারা। RAB দেখে আশেপাশের লোকজন ভয়ে কাছে আসছিলো না। আবার গোপন মিশন বলে বাক্সগুলো উঠাতে অন্য কাউকে ডাকাও হয়নি। RAB সদস্যরা নিজেরা কাঁধে করে সেগুলো লঞ্চে উঠিয়েছেন সেই রাতে।

মেজর আদনানরা রওনা দিতে দিকে ভাটা হয়ে গেছে চার ঘন্টা। মানে দুই ঘন্টা পর আবার জোয়ার শুরু হবে। রাত তখন নয়টা পেরিয়েছে। পশুর নদীতে উঠেই ফোন করে আমাকে জানান মেজর আদনান। আবারও আমাদের দেখা হওয়ার জায়গাটি জানিয়ে দিলাম। বললাম, এরপর হয়তো আর ফোনে পাবে না আমাকে। একবারে দেখা হবে। তোমরা সাবধানে আসো। আদনানও বললেন, সতর্ক থাকবেন ভাই। আর দুই ঘন্টার মধ্যে চলে আসবো।

আমার হাসি শুনে আদনান অবাক। বললাম, পথ এখন আর দুই ঘন্টার নাই। অর্ধেক রাস্তায় জোয়ার শুরু হবে। তখন সময় লাগবে দ্বিগুন। উজান ঠেলে আসতে হবে।

লঞ্চ-এ যমুনা টিভি’র সিনিয়র ব্রডকাস্ট টেকনিসিয়ান আতিক ভাইসহ আমার আরও তিন সহকর্মী আসছেন। সুন্দরবনের যেকোনো জায়গা থেকে সরাসরি সম্প্রচারের যন্ত্র নিয়ে তাঁরা ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছেন সকালে। বিশাল বিশাল সব যন্ত্রের সমন্বয়ে সেই সরঞ্জামের নাম ডিএসএনজি। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক থাকার সাথে এর সম্পর্ক নাই। সরাসরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই যন্ত্র দিয়ে সরাসরি সম্প্রচারে আসা যায়।

বেশ ক্লান্তির মধ্যে ভীতিও কাজ করছিলো। তার ওপর লঞ্চে RAB এর টান টান উত্তেজনা, সশন্ত্র অবস্থান দেখে তারা বেশ ভড়কে যায়। দ্রুত সব কাজ সেরে কেবিনে ঢুকে পড়েন তাঁরা। এদিকে মেজর আদনান ছাড়া ওই টিমের কেউই পরিস্কার জানেন না যে কী হতে যাচ্ছে। বিষয়টি এতো সুন্দর করে গোপন রেখেছিলেন আদনান যে তাঁর সৈনিকেরা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। লঞ্চ চলছে, কিন্তু ভিতরের পরিবেশ থমথমে। জানি না তখন মেজন আদনানের মনে কী চলছিলো। শুধু এটুকু অনুভব করছিলাম যে এই মিশনে ব্যর্থ হলে পেশাগত সম্মান থাকবে না, চাকরিরও ক্ষতি হয়ে যাবে। তবুও ঝুঁকিটি তিনিই নিয়েছিলেন। একটা জিনিষ আমরা জানি, সফলতার ক্রেডিট ভাগাভাগি হয়, কিন্তু ব্যর্থতার দায় একজনকেই নিতে হয়।

পরের দিন সকালে মংলায় আসবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একদিকে সেই আয়োজন চলছিলো পশুর নদীর তীরের ফুয়েল জেটিতে। অন্যদিকে সুন্দরবনের জলদস্যুদের নিজেদের হেফাজতে নিতে সুন্দরবনে আদনানসহ তাঁর টিম। অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তায় সম্ভবত বিপর্যস্ত তাঁরা। ২৮ মে ২০১৬ তারিখ সকাল দশটায় দস্যুরা আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করবে মন্ত্রীর কাছে। এমন কথাই ছিলো। কিন্তু তার আগে আরেকটি কর্মসূচিতে যোগ দিতে কুয়াকাটা যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ধারণা করছি বনদস্যুদের সারেন্ডারে অনিশ্চয়তা আছে ভেবে সকালের অনুষ্ঠানটি রাখা হয়। তা না হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিব্রত হবেন। বনদস্যুরা RAB হেফাজতে আসবে গভীর রাতে। আমি নিশ্চিত হলেও তাঁরা তো আর নিশ্চিত ছিলেন না! মেজর আদনানের সহযাত্রী হয়েছিলেন বরিশাল RAB এর আরও তিন পুলিশ কর্মকর্তা নিজাম ভাই, জসীম ভাই ও হাফিজ ভাই। অবশ্য তখনও তাঁদের কারও সাথে পরিচয় ছিলো না।

ভাটা চলছে আমাদের ওখানে। খালের ভিতরে রাখা ট্রলারগুলো বের করে বড় নদীতে নিতে হবে। দ্রুত পানি নামছে। এখনই বের না করলে আবার কয়েক ঘন্টার জন্য আটকে যাবো। দস্যুনেতা বললেন অসুবিধা নাই। সবাই মিলে ঠেলে নামিয়ে দিবো। বললাম, এই রাতে আর ঠেলাঠেলি করবেন কেন? পানি থাকতে থাকতে বের করে ফেলি? বেলায়েত সরদারকে বললাম ট্রলারগুলো বের করার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এখনও ঘন্টা দুই এখানেই থাকবো আমরা। দন্যুনেতা বললো, যদি বড় নদীতে ট্রলার রাখি তবে বাইরে থেকে দেখে ফেলবে যে কেউ।

শুধু জাহাঙ্গীর বাহিনী না অন্য কোনো দস্যুদলেরও নজর পড়তে পারে। তার চেয়ে বড় কথা যদি কোস্টগার্ডের কোনো নৌযান আসে তাহলে বিপদের শেষ থাকবে না। কী করি তাহলে এখন? সিদ্ধান্ত হলো, আপাতত বড় নদীতে বের করবো না ট্রলার। RAB এর লঞ্চ আসতে আসতে রাত দুইটার আগে না, বললেন বেলায়েত সরদার। উজান ঠেলে ভদ্রা পর্যন্ত আসতে তাদের পাঁচ ঘন্টা লেগে যাবে। আমরা পাশাখালী ছাড়বো রাত ১২টার দিকে। ততোক্ষণে জোয়ারের পানি ঢুকে যাবে খালে। সেই জোয়ারে আমরা জোয়ার দিতে পারবো।

দুই রাত নির্ঘুম আমি। সামনের রাতটিও জেগেই কাটবে। শরীররটাকে টেনে ধরে রেখেছি মনের জোরে। প্রতি ঘন্টায় চা খেয়ে নিজেকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছি। রাত দশটার মধ্যে সবাইকে খেয়ে নিতে বললাম। শুরুতে দস্যুদের স্ত্রী সন্তান, সাথে ওই অফিসের ভিতরে রাখা জেলেদের খাওয়ানো হলো। দস্যুরা বলছিলো ক্ষুধা নাই। বললাম আবার কখন খাবার হবে আমাদের জানি না। খেয়ে নেন।

ওসি সাহেবসহ বন বিভাগের তিনজন বনরক্ষী কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বললাম আপনাদের কষ্টের দিন শেষ হচ্ছে। দস্যুদের তো রাতেই নিয়ে যাবো। দুশ্চিন্তার কিছু নাই। আপনারাও খেতে বসেন। পাশে নিজেও বসে পড়লাম। সাথে আমার সহযাত্রীরা।

ছোট্ট ওই বন টহল ফাঁড়ীর ভিতরে আমরা সবাই। খাচ্ছি আর ভাবছি সত্যিই ঘটতে যাচ্ছে সেই ঘটনা। গত ছয়/সাত বছরের চেষ্টা আমার বাস্তব হতে যাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় ছিলাম, শরীরটা বিদ্ধস্ত, তবুও ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত আমি। ভাবছিলাম এতো বছর ধরে যে অসম্মান বয়ে বেড়াচ্ছি সেই গ্লানি কেটে যাবে কাল সকালে। এর মধ্য দিয়ে সুন্দরবনে আমার কাজ শেষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু তখনও জানতাম না সেটা ছিলো শুরু।

রাতের খাবার শেষে বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ায় থাকা দস্যুদের ডেকে আনলাম। খাবার খেয়ে সবাইকে গুছিয়ে নিতে বললাম। দস্যুপত্নীরা গোছগাছে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সাথে বাচ্চারাও। তখন তাদের মনের ভিতরে কী চলছিলো জানি না। এসময় মাস্টার বাহিনীর এক সদস্য ট্রলার থেকে একটি ব্যাগ আনলো। ভিতরে নতুন লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবী। সারেন্ডারের সময় এসব পড়ে যাবে মন্ত্রীর সামনে। বললাম আপনারা যে পোশাকে আছেন সেই পোশাকেই যাবেন। অন্যরা রাজি হলেও সুলতান কাকা রাজি না। নতুন লুঙ্গি, স্যান্ডো গেঞ্জি, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পড়লেন, সাথে টুপিও। বললাম, ও কাকা, এই ড্রেস এর সাথে হাতে বন্দুক নিলে মানাবে? কাকা বললেন, এই যে আজকে মাথায় টুপিডা পড়লাম, মরার আগ পর্যন্ত আর খুলবো না। যদি কোনো রকমে বেঁচে যাই তাহলে বাড়ি, বাজার আর মসজিদের বাইরে আর কোথাও যাবো না।

মাস্টারের ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন তাঁর স্ত্রী। ছোট ব্যাগ। কয়েকটা কাপড় আর কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ। অন্যরাও গোছগাছে ব্যস্ত। যারা সারেন্ডার করবে না তারা ফিরে গেলো ট্রলারে। বনরক্ষীরা বিছানা, টেবিলসহ তাঁদের জিনিষপত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন। ওসি সাহেবকে বললাম, আপনাদের কষ্ট দিলাম সারাদিন। চলে যাচ্ছি একটু পর। দস্যুরাও চলে যাচ্ছে। আপনাদের বিপদও কেটে যাচ্ছে। ওসি সাহেব বললেন, একটা বাহিনী সারেন্ডার করবে। কাল রাতেই দেখবেন আরেকটা দস্যুদল এসে উঠবে এখানে। আমাদের আর শান্তি নাই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top