হিংশ্র চোখগুলোতে ভর করেছে আতঙ্ক | রূপান্তরের গল্প ১০৩ | Rupantorer Golpo 103 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১০৩ : অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে…!! ভাঙ্গা গলায় গাইছে কে যেন! ওই রাতে গভীর বনের ভিতর দিয়ে গান গায় কে? সুর নাই, তাল নাই কিন্তু মাদকতা আছে সেই গলায়। বিপদে ঘেরা সুন্দরবনে এতো মন খুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে? আমাদের কেউ? পাশাখালীর খাল ধরে নৌকা বাইছে কোন পাগল?
রাত বাজে সাড়ে দশটা। খালে রাখা ট্রলারে উঠে আমার জিনিষপত্র গোছাচ্ছিলাম। মামুন বললো খালের ভিতর থেকে কেউ আসছে। বললাম, আর টেনশন নিতে পারবো না। কিন্তু টেনশন তো হবেই। চুপ করে গেলাম। কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করছি। ঠিক। নৌকা বেয়ে এগিয়ে আসছে কেউ। দূর থেকে ভেসে আসছে অগোছালো গান। সাথে এগিয়ে আসছে নৌকা বাওয়ার শব্দ।
টর্চ হাতে নিয়ে ট্রলারের ডেক এর উপর উঠলাম। দাঁড়িয়ে দেখি নৌকাটা আমাদের দিকেই আসছে। ঝাপসা কিন্তু দূর থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। পাশাখালী অফিসোর দিকে আসা বা যাওয়া ছাড়া এই খালে আর কোনো পথ নাই। কোনো পাশ খালও নাই আশেপাশে। ভরা জোয়ার হলে তখন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আসা যায় নৌকা ভাসিয়ে।
টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মামুন বললো টর্চ মাইরেন না ভাই। কেন? জঙ্গলে হুটহাট টর্চ জ্বালালে ঝামেলা হয়, বিপদ বাড়ে। ফিসফিস করে বললো, যদি শিকারী হয় তাহলে এই টর্চ এর আলো ধরে নিশানা করবে, গুলি করে বসতে পারে। বললাম, শিকারী বা ডাকাত হলে এভাবে গান গাইতে গাইতে আসবে কেউ?
মিনিট দুই এর মধ্যে পরিস্কার হলো সব। দেখা যাচ্ছে নৌকাটি। ছোট্ট একটি কাঁকড়ার নৌকা মনে হলো। আরও কাছে আসার পর দেখি নৌকায় একজনই বসা। হাত আর পা মিলিয়ে দারুণ ভাবে বেয়ে যাচ্ছে নৌকা। আর গান গাইছে নিজের মনের মতো। খালের এখানে যে এতোগুলো নৌকা-ট্রলার রাখা সেদিকে কোনো নজর নাই। আমাদের দিকে তাকিয়ে গান বন্ধ করলো। কিন্তু পাত্তা দিলো না। পাশ দিয়ে নৌকা বেয়ে খালের পাড়ে ভিড়ালো নৌকা। তখনও সুন্দরবন সম্পর্কে তেমন ধারণা হয়নি।
তবে এটুকু বুঝলাম যে এই মানুষটি আমাদের কারও জন্য ঝুঁকির কারণ না। ডাক দিলাম, ও ভাই। কোত্থেকে আসলেন? বললো, ওই শিবসার আড়পাড়ে ছিলাম, পাটাকাটায়। করেন কী? বললো বড়শি বাই। একা একা? বাড়ি কোথায়? কোনো উত্তর নাই। উল্টো জিজ্ঞেস করলো আপনারা কারা? সার্ভে করতে আইছেন? না কী প্রশাসনের লোক? কী উত্তর দিবো বুঝলাম না।
নাম তার সাদ্দাম। বয়স ৩০ এর মতো। কম বেশি হতে পারে। শরীর স্বাস্থ্য তেমন ভালো না। কিন্তু নৌকা থেকে নেমে একাই যেভাবে কাদার উপর দিয়ে নৌকা টেনে তুললো তাতে শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে আমার ধারণা পাল্টে গেলো। সুন্দরবনের মানুষদের ভিতরে কেমন যেন একটা শক্তি আছে। ভিতরের শক্তি। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। সাদ্দাম ভাইয়ের বাড়ি রায়েন্দা-শরণখোলা।
এতো দূর থেকে এদিকে আসেন মাছ ধরতে? বললো, ওদিকে মাছ-পোণা তেমন নাই। মাছ মারতে মারতে শেষ করে ফেলছে। আর আমি ধরি গলদা চিংড়ি। খালে বিষ মারে, টোনা জাল, চিংড়া জাল, কাঠি জাল, ভ্যাসালী, চরপাটা, খালপাটা, বেন্দী জালে ভরে থাকে পূর্ব সুন্দরবন। তাই এই দিকে আসি। পূর্ব সুন্দরবন পাড়ি দিয়ে পশ্চিমে শিবসার বাওনে নৌকা বেয়ে আসতে সময় লাগে দেড় দিন। পথে বিরতি নেই, মন চাইলে এক ভাটিয় বড়শি ফেলি। যদি চলার মতো মাছ পাই তাহলে ওখানেই মারতে থাকি মাছ। কিন্তু ওদিকে কিছু পার্টি আছে। সুমন, মোশারররফ, শান্ত বাহিনীসহ আরও দুই/তিনটা ডাকাত পার্টি। ওরা ডাকাইত তো না, চোরের চেয়েও খারাপ। সামনে পড়লে মাছ তো নেয়, সাথে বাজার-পানি-বিড়ি-পান সব নিয়ে যায়।
এদিকে তো ডাকাত থাকে। ওরা ধরে না? বললো, এদিকের পার্টিগুলো বড়। মেলা অস্ত্র তাদের। আমার মতো একজনের নৌকা দেখলে ডাকেও না। ওরা জানে আমার কিছুই নাই। ডাকাতদের সাথে দেখা হয়। উল্টা কিছু বাজার সদা দিয়ে ছেড়ে দেয়। আমার মতো পাগলকে ধরে বিপদে পড়বে কে?
মাছ কেড়ে নেয় না? বললো, উল্টা বাজার নেই আমি। এই জঙ্গলে মাছ ধরি সেই ছোটবেলা থেকে। তখন বাপের সাথে আসতাম। পরে বাবা স্ট্রোক করলো। এরপর থেকে আমি একাই আসি। সংসারে বাপ-মা আছে। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আরেক ভাই আছে- পাগল। এই পুরা সংসার আমার ঘাড়ে। জঙ্গলে আমার আসতেই হবে। না হলে সবাই না খেয়ে থাকবে। চোর ডাকাতের ভয়ে ডাঙ্গায় বসে থাকলে খাওয়াবে কে?
সাদ্দাম বললো, আপনারা আসছেন পাশাখালী? কী করেন জানি না। তবে এই জায়গায় বেশি না থাকাই ভালো। চোর ডাকাতেরা সামনে পড়লে কখন কঅ করে ফেলে? জানালো, আশে পাশে মাস্টার বাহিনী আছে। বললাম, মাস্টার বাহিনী কি খুব খারাপ? মেরে ফেলবে আমাকে? বললো, তা মারবে না। নতুন পার্টি তো। কখন কী করে ফেলে! এদিকে সে যে মাস্টার বাহিনীর ভিতরে চলে এসেছে টের পায়নি।
মামুনকে ইশারা করলাম। নেমে গেলো কাঁদার মধ্যে। সাদ্দামের নৌকাটি আরেকটু ঠেলে উপরে উঠাতে সাহায্য করলো। তারপর সাদ্দামকে নিয়ে আসলো আমাদের ট্রলারে। কয়েকটা বিস্কিটের প্যাকেট, মুড়ি, চানাচুর, কয়েকটা ফল আর বড় দুই বোতল খাবার পানি দিলাম। সাদ্দাম বললো, আপনারা কারা কন তো? বিরাট সন্দেহ তার চোখে। বললাম, একটু বেড়াতে আসছি। কী মনে করলো কে জানে? জিনিষগুলো নৌকায় নিয়ে রাখলো। তারপর পানির একটা ড্রাম নিয়ে চললো পুকুরের দিকে। যাওয়ার সময় দেখে ফরেস্ট অফিসের অস্ত্র হাতে হাঁটাহাঁটি করছে বনদস্যুরা। থমকে দাঁড়ায় সে।
ট্রলার থেকে নেমে হাঁটা দিলাম। বললাম পানির তো এখন অভাব নাই। বৃষ্টির পানি ধরে রাখলেই তো হয়। আবার পুকুরে যাচ্ছেন কেন? বললো, জঙ্গলে নামছিলাম লাকড়ি কাটতে। তখন বৃষ্টি হলো। পানি ধরা হয়নি। আর অফিসের সাথে কিছু লেনদেন আছে। সেগুলো সারতে হবে। সেজন্যই আসলাম। কিন্তু এখানে যে পার্টি আছে বুঝিনি। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি কে বলেন তো? চেপে গেলাম আমি।
সাদ্দামের সাথে ওরা কথা বললো। ফরেস্টের লোকজনও দেখলাম চিনে তাকে। বললো, ছেলেটা খুব অসহায়। একা একা আসে মাছ ধরতে। এছাড়া অভয়াশ্রম হলেও এখানে তো আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। কোন জেলেকে আটকায়ে কোন বিপদে পড়ি! আর এই জেলে বড়শি দিয়ে গলদা ধরে। বিষ-টিষ মারে না। ছেলেটাকে রাতে খেয়ে যেতে বললাম। এমনিতে তাকে আটকে রাখার কোনো ইচ্ছা নাই। কিন্তু অফিস ছাড়ার আগে তাকে ছাড়াও যাবে না। আমার নিমন্ত্রণ রাখলো সে।
ফোন দিলাম আদনানকে। যাচ্ছে না। পুকুর পাড়ের ওই জায়গায় তখন নেটওয়ার্ক আসছে। ওদিকে টাওয়ারে খোঁজ নিলাম। সেখানে একবার ফোন দিয়েছিলেন মেজর সাহেব। তখন জয়মনির ঘোল অতিক্রম করেছে RAB। কিন্তু ততোক্ষণে জোয়ার লেগেছে নদীতে। আসতে সময় লাগবে। লাগুক সময়। আর ভাবতে পারবো না। বললাম, নামবো আমরা নদীতে। সবাই তৈরি হন।
৮জন বনদস্যু সারেন্ডার করবে। মাস্টার ওরফে মোস্তফা শেখ, সোহাগ আকন, সুলতান খাঁ, ফজলু শেখ, সোলাইমান শেখ, সুমন সরদার, শাহীন শেখ ও হারুন। শাহীন ছাড়া বাঁকী সবার হাতে অস্ত্র, সাথে পোসেস ভর্তি গুলি। ট্রলার ছাড়বো এক ঘন্টার মধ্যে।
হিংশ্র জলদস্যুদের স্বভাবে রূপান্তর দেখছিলাম। তখন চোখগুলো থেকে হিংশ্রতা সরে যাচ্ছে। সেখানে ভর করেছে অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক। তবে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত ওরা, যারা সারেন্ডার করবে না!