বন্দুক তাক করে রওনা হলাম, গন্তব্য- ভদ্রা নদী | রূপান্তরের গল্প ১০৫ | Rupantorer Golpo 105 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১০৫ : অস্ত্রগুলো তাক করা জঙ্গলের দিকে। সুকানিতে সোহাগ। সামনে পিছনে মিলিয়ে বাঁকী দস্যুরা সতর্ক অবস্থানে। ট্রলারের সামনের দিকে দাঁড়ানো আমি। হাতে টর্চ লাইট। পশুর নদী তখন থমথমে। আবহাওয়া পরিস্কার। কেবিনের ভিতরে মাস্টার ও সোহাগের স্ত্রী ও সন্তানেরা। তাদের চোখে সাক্ষাৎ আতঙ্ক। আমাদের গন্তব্য ভদ্রা নদীর গোঁড়া।
আমাদের নৌকা বহরে কোনো আলো জ্বলছে না। চারপাশে আলো নাই। তবে সেই অন্ধকারে চারপাশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তিনটি ট্রলারের গতি তিন রকম। দস্যুদেরটির গতি অনেক বেশি। তাই সমান্তরাল চলাটা একটু কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে শেষের ট্রলারটির গতি অনেক কমে গেছে। কারণ তার সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা জেলেদের অনেকগুলো নৌকা। বহরের এই নৌকা-ট্রলার নিয়ে বেশি চিন্তা ছিলো নানা কারণে। ওদের পাশে রাখতে হবে। সেভাবেই যেতে হবে ভদ্রা পর্যন্ত।
মাস্টার ভাই তখন মহা দুশ্চিন্তায়। তবে বলছিলেন, ওপরে আল্লাহ নিচে আপনি। এখন যদি সরকার মেরেও ফেলে কষ্ট থাকবে না। শুধু আমার বাচ্চাটাকে দেখবেন। সোহাগ তখনও শক্ত হাতে সুকানি ধরে দাঁড়ানো। গুলিতে নষ্ট হওয়া হাতটি দিয়েই ধরে আছেন হাল। সুলতান কাকা দেখলাম নামাজ পড়ছেন। দোনলা বন্দুকটি পড়ে আছে পাশে। ফজলু, হারুন, সুমন, সোলাইমান শক্ত হাতে বন্দুক তাক করে বসা। সবশেষ আত্মসমর্পণের বহরে যোগ দেয়া শাহীনের হাতে থ্রি নট থ্রি বন্দুক। দস্যুদের সবগুলো অস্ত্র লোড করা। যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি ছিলো।
পাশাখালী ছাড়ার সময় অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। ভাবছিলাম সারেন্ডার করবে মাত্র আটজন। পিছনের ট্রলারে যারা তারা প্রত্যেকেই চিহ্নিত জলদস্যু। এ যাত্রায় বাড়ি ফিরলেও তারা নিজেদের এলাকায় থাকতে পারবে না। কিছুতেই না। তাদের থাকতে দেয়া হবেও না। বাড়ি না থাকলে ওদের আবারও জঙ্গলে ফিরতে হবে। ওরাই আবার গড়ে তুলবে নতুন দস্যু দল। তাহলে এই কয়জনকে আত্মসমর্পণ করিয়ে কী লাভ?
মাস্টারকে বললাম মনের কথা। বললেন, নিজেদের ভালো যদি না বোঝে কী করবো? যদি বলেন জোর করে সারেন্ডার করাবেন সেটাও সম্ভব। এখনও সময় আছে। সবাইকে বেঁধে নিয়ে যাবো। RAB এর হাতে তুলে দিবো। তারপর যা হওয়ার হবে। বললাম, তা করবো না। সেটা করলে তো জোর করে সারেন্ডার করানো হবে। ওদের মধ্যে অনেকেই দেখবেন জেল থেকে বের হয়ে আবার জঙ্গলে ফিরবে, নতুন দস্যুদল গড়বে। আর কিছু না হলেও জাহাঙ্গীর বা নোয়া বাহিনীতে যোগ দিবে।
ধীরে ধীরে চলছে আমাদের নৌকা বহর। হাতের বামে চাইলেবগী। জঙ্গল ঘেঁষে চারটি কার্গো নোঙ্গর করা। সিগন্যাল বাতি ছাড়া আর কোনো আলো নাই। সম্ভবত সবাই গভীর ঘুমে। আরও আধা ঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবো ভদ্রা। নদীর পশ্চিম পাশ দিয়ে চললে সুবিধা হতো। কিন্তু নির্দিষ্ট দূরত্ব না রাখলে বিপদ হতে পারে। যদি জাহাঙ্গীর বাহিনী সত্যিই এখানে আসে তবে গোলাগুলি হবে নিশ্চিত। ঝুঁকি নিবো না একদম।
ছোট কানছিঁড়া, বড় কানছিঁড়া খালের মুখ পার হলাম নির্বিঘ্নে। পড়লাম ভদ্রার মুখে। ভদ্রা নদী বেশ বড়, গভীর। পশুরের সাথে যেখানে মিশেছে নদীটি সেই জায়গাটি তার চেয়েও বড়। এখানে প্রচুর মাছ হয়, ডলফিন দেখা যায় অহরহ, আছে কুমিরও। আক্রমণাত্মক হিসাবে ভদ্রা নদীর কুমিরের বেশ নাম আছে। জেলেরা খুব সতর্ক থাকে। এই নদী চলে গেছে সোজা পশ্চিমে। দুই পাশ থেকে মিশেছে অনেক গুলো খাল। আরেকটু পশ্চিমে গিয়ে নদী ঘুরেছে উত্তরে। আর দক্ষিণ-পশ্চিমে চলে গেলে আদাচাই এর ভাড়ানী। ওই খাল গিয়ে পড়েছে শিবসা নদীতে। ভদ্রার মূল ধারা চলে গেছে ঝাপসি হয়ে আরও উত্তরে। খুলনা থেকে নেমে আসা ছোট্ট ভদ্রা নদীই এই নদী কী না জানা নাই।
ভদ্রার মুখে যেতে যেতে অন্ধকার কেটে গেলো। চাঁদের আলো না। সামনে হাড়বাড়িয়া। মনে হচ্ছিলো বিরাট এক শহর আলোয় ঝলমল করছে। সেখানে নোঙ্গর করা আছে না হলেও কুড়িটি জাহাজ। লাইটারেজ জাহাজ-কার্গোগুলো ঘিরে আছে সেগুলোকে। ক্রেন চলছে সশব্দে, জাহাজ থেকে কার্গোতে নামানো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মালামাল। আশে পাশে চলছে ট্রলার, স্পিডবোট। ওখানে কোস্টগার্ডের নৌযানও থাকার কথা।
RAB এর বহর আসতে দেরি হচ্ছে। ভেবেছিলাম আরেকটু এগিয়ে যাবো। কিন্তু ওই আলো ঝলমলে এলাকা অতিক্রম করা সম্ভব না। ভদ্রার মুখে দাঁড়াবো আমরা। কিন্তু সেখানেও একটা ফরেস্ট অফিস আছে। তাদের নজরেও পড়া যাবে না। মাঝ নদীতে সবগুলো ট্রলার-নৌকা নিয়ে একসাথে হলাম। বেঁধে ফেলা হলো একসাথে। নোঙ্গর করবো এখানে। কিন্তু নোঙ্গর ফেলতে গিয়ে দেখা গেলো পানির গভীরতা অনেক বেশি। দড়ির পর দড়ি জোড়া দিয়েও মাটির নাগাল নাই। এদিকে জোয়ারের স্রোত বেড়ে গেছে। সেই স্রোত আমাদের ফেলে নিয়ে যাচ্ছে উজানে।
দস্যুদের ট্রলারের ইঞ্জিন চালু করা হলো। পুরো বহর নিয়ে পৌঁছে গেছি ভদ্রার ঠোঁটায়। সেখানে বড় নদীতে বাড়ানো গেওয়ার বন। নিজেদের আড়াল করে সেই গাছগুলোর সঙ্গে বেঁধে ফেলা হলো ট্রলার। আসার পথে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু সশস্ত্র দস্যুদের হাতে শক্ত করে ধরে রাখা বন্দুকগুলো, ট্রিগারে আঙ্গুল। বললাম, আমাদের ট্রলারটা সামনে রাখেন। তারপর থাকবে আপনাদের ট্রলার ও নৌকাগুলো। বেলায়েত সরদারকে বললাম, ও ভাই, চুলা জ্বালান। চা খাবো!