ভদ্রায় আমাদের নৌকা বহর, কখন আসবে RAB এর লঞ্চ? | রূপান্তরের গল্প ১০৬ | Rupantorer Golpo 106 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১০৬ : স্যারেরা আসবে তো ভাই? আমাদের সারেন্ডার হবে তো? কালকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন তো? আমাদের সাথে আবার RAB বেঈমানী করবে না তো ভাই? এক নাগাড়ে প্রশ্নগুলো করে যাচ্ছে দস্যুরা। এতো কিছুর পরও সন্দেহ কাটেনি আপনাদের? দস্যুরা বললো, আমরা খারাপ মানুষ। কিন্তু আমাদের সাথেও তো সবাই বেঈমানী করে। কেউ কথা রাখে না। আমরা জুলুম করি জেলেদের সাথে। আর আমাদের জুলুম করে শহরের ভদ্রলোকেরা। কী বলবো? উত্তর নাই আমার কাছে। বললাম, বেঁচে যাওয়ার এমন সুযোগ আপনাদের জীবনে আগে আসেনি, সামনে আসবে বলেও মনে হয় না। চলেন চা খাই।
দখিণা বাতাস ছেড়েছে। উথাল পাথাল অবস্থা। জোয়ার বাড়ছে। তীব্র হয়েছে স্রোত। ভদ্রার মুখে ঘোল পাকাচ্ছে পানি। তার মধ্যেই একটা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে যাচ্ছি ফরেস্ট অফিসের ঘাটে। ওখানে গিয়ে একটু উঁচুতে দাঁড়ালে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। জেটিতে বন বিভাগের ট্রলার রাখা। কয়েকটি ডিঙ্গি নৌকাও আছে সেখানে। ফরেস্টের ওই মাঝি আমার পরিচিত।
নৌকা বাইতে গিয়ে জেলে ভাইদের বেহাল অবস্থা। পানির স্রোত এক এক সময় ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। বাতাস আর স্রোত মিলিয়ে বেসামাল অবস্থা। সেভাবেই অর্ধেক পথ পেরিয়ে গেলাম। কোনো রকমে পৌঁছালাম বন বিভাগের জেটিতে। সবাই ঘুম। জেলেদের নৌকাগুলো থেকে দুই একজন উঁকি দিলো। আবার ঘুমিয়ে পড়লো। ফরেস্টের ট্রলারে কেউ নাই। জেটিতে উঠে নেটওয়ার্ক পেলাম। কিন্তু মেজর আদনানের ফোনে ঢুকতে পারলাম না।
কয়েকটা মিসড কল অ্যালার্ট পেলাম। অচেনা নাম্বার। মনে হলো বিদেশি ফোন। কল লিস্ট চেক করতে করতে আবার ফোন ঢুকলো ফোনে। ওপাশে মেজর আদনান। স্যাটেলাইট ফোন দিয়ে কল দিচ্ছেন তিনি।
কতোদূর? আদনান জানালেন লোকালয় পার হয়েছেন বেশ আগে। তার মানে নন্দবালা পার হয়ে হাড়বাড়িয়ার কাছাকাছি? বললেন, সামনে অনেকগুলো জাহাজ। বললাম, জাহাজগুলো পার করে সোজা এগিয়ে আসো। পশ্চিম পাশ থেকর টর্চ দিয়ে ইশারা দিবো। সেখানেই নোঙ্গর করবে। অপ্রত্যাশিত সেই ফোন কল মনটাকে শীতল করে দিলো। তখন রাত একটা বাজে। ওদের আসতে আরও অন্তত এক ঘন্টা লাগবে। পাড়ে ভিড়ানো নৌকাতে ঘুমিয়ে থাকা জেলেদের কোনো সাড়া শব্দ নাই তখনও।
ভদ্রায় মাছ ধরা জেলেদের মাছ-কাঁকড়া ধরতে হয় অনেক পরিশ্রম করে। চ্যালেঞ্জেরও শেষ নাই। তখন ভদ্রা নদী নিয়ে অনেক ভয়ের গল্প শুনতাম। বাঘ, কুমির আর জলদস্যুদের আস্তানা সেখানে। বাঘগুলো না কী বেশ চালাক আর হিংশ্র। পানিতে পা রাখলেও নাকী কুমিরে টেনে নেয়। কামট বা হাঙ্গরে পা কেটে নিয়েছে এমন গল্পও শুনেছি। এছাড়া নিজেরাও একবার এই নদীর পাড়ে নেমেই বাঘের আলামত পেয়েছিলা। মামাদের পায়ের ছাপ যেখানে সেখানে। নৌকা বাইতে বাইতে জেলেরা বললো, ভদ্রায় দুইটি বিশাল কুমির আছে। আস্ত মানুষ খেয়ে ফেলতে পারবে। এই নদী আর ঝাপসি খাল মিলে কয়েক হাজার কুমির আছে। পানিতে নামা এখানে নিরাপদ না। মালে ওঠাও ঝুঁকি (মালে নামা মানে জঙ্গলে নামা)। মাছ ধরার মাঝে সেজন্য জেলেরা নদীতে এসে নোঙ্গর করে থাকে। ছোট খালে রাত কাটায় না।
টালমাটাল মোহনাটি পার হয়ে গেলাম সহজেই। একটু ঘুরে সোজা পার হলো নৌকা। উঠলাম শেষের ট্রলারে। সেখানে সারেন্ডার করবে না যারা তারাই শুয়ে বসে আছে। বেশ ক্লান্ত। তার ওপর শংকায় তাদের দিশেহারা অবস্থা। বললাম, আপনাদের ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে। এখনও সময় আছে। RAB এর বহর আসবে কিছুক্ষণ পর। সব মিলিয়ে এক ঘন্টার মতো সময় পাবেন। যদি মন সায় দেয় তাহলে জানাবেন। আবারও বললাম, সুযোগ জীবনে বার বার আসে না। একজন বললো, বাড়িতে এখনও কেউ জানে না যে আমি জঙ্গলে ডাকাতি করি। সবাই জানে চট্টগ্রামে গার্মেন্টস এ কাজ করি। তাই বাড়ি গেলেও সমস্যা হবে না। বললাম, আমার মনে হয় তুমিই সবার আগে জঙ্গলে নামবে। কথাটি তার এক সপ্তাহের মধ্যেই ফলেছিলো।
কথায় কথায় বিভ্রান্ত করা এই অপরাধীদের স্বভাব। যে জীবন তারা কাটায় সেখানে সত্য বলে টিকে থাকাও কঠিন। সুন্দরবনের জেলেরা বা বনদস্যুরা কথায় কথা মিথ্যা বলে অভ্যন্ত। হয়তো বৈরী জীবনে ছোট থেকে এভাবেই গড়ে ওঠে তারা। জলদস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মিথ্যার পাহাড় থেকে সত্যটাকে বের করতে শিখেছিলাম। সেজন্য সময় দিয়েছি, গভীর পর্যবেক্ষণ না করে কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি।
পাশেই দস্যুদের মূল ট্রলার। তার ছাদে বসা বায়েজীদ ইসলাম পলিন। সাথে মাস্টারের কণ্যা। দু’জনের আড্ডাকে ঘিরে গল্পগুজবে ব্যস্ত অন্য দস্যুরা। সোলাইমান বসা ট্রলারের পিছনে। হাতে বন্দুক, চোখ ঘুরছে চারপাশে। বললাম, ওরা আসলো বলে। এতোক্ষণে হাড়বাড়িয়ে ছেড়েছে। এবার নিজেদের ট্রলারে গেলাম। শরীর চলছে না একদম। মনে হচ্ছিলো বাসার কথা, নিজের ঘরের নরম বিছানাটির কথা। সরদারের ট্রলারের ছাদটা বেশ সুন্দর। মাঝে মাঝে ওই ছাদে শুয়ে থাকতে বেশ লাগে। সেখানে পা ঝুলিয়ে বসলাম। বাঁকীটা সময় সেখানেই বসেই থাকবো। হাতে টর্চ অপেক্ষা করবো। লঞ্চটা আসতে অনেক দেরি করছে। ওইটুকু সময় অপেক্ষা করতে ভালো লাগছিলো না।
রাত দেড়টা পার হলো, দুইটা বেজে গেলো, জোয়ার শেষ হবে হবে করছে। ভদ্রার ঠোঁটায় গড়ান গাছগুলোর আড়ালে বসে তাকিয়ে আছি বড় নদীর দিকে। বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়লাম। হাতে থাকা চায়ের কাপটা হাতেই ধরা। মনে হলো দূর থেকে কারা ডাকাডাকি করছে। তন্দ্রা কেটে গেলো। তাকিয়ে দেখি মাঝ পশুর দিয়ে এগিয়ে আসছে ছোট্ট একটি লঞ্চ।
পিছনের নৌকা থেকে আরিফ বললো, আমিও সারেন্ডার করবো মামা। চলে আসো এই ট্রলারে। নয় জনে দাঁড়ালো আত্মসমর্পণে আগ্রহী বনদস্যুর সংখ্যা। তার পাশ থেকে হারুন নামের এক জেলে বললো, আমিও সারেন্ডার করবো ভাই। বললাম, জেলে মানুষ আপনি। সারেন্ডার করবেন কেন? বললেন, তিনি একজন মাছ ব্যবসায়ী। জঙ্গলে মাছও ধরেন। দস্যু দলের সাথে তার খুব ভাব। মানে দস্যুদের সহযোগী তিনি। বললেন, সরাসরি ডাকাতি করি না। কিন্তু ডাকাতদের বাজার সদা সাপ্লাই দেই। RAB এর তালিকায় আমার নাম আছে ভাই। আমাকে বাঁচান। বললাম, হাতে সময় নাই। আপাতত বাড়ি যান। পরে দেখা যাবে।
সবাইকে তৈরি হতে বললাম। বেলায়েত সরদার তৈরি হন। ট্রলার ছাড়তে হবে।