মাঝ পশুরে থামলো লঞ্চ,মেজর আদনান কোথায়? | রূপান্তরের গল্প ১০৭ | Rupantorer Golpo 107 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১০৭ : কতোবার টর্চ জ্বালিয়ে সিগন্যাল দিচ্ছি। কিন্তু পাল্টা সিগন্যাল আসছে না। লঞ্চটি সোজা এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। ভাবলাম এটা RAB এর লঞ্চ তো? মে-জুন মাসে পর্যটকদের লঞ্চ সচরাচর এতো দূর আসে না। পর্যটকবাহী লঞ্চগুলো সাধারণত সেলা নদী দিয়ে যায়। তাদের গন্তব্য থাকে কটকা-কচিখালী। এমনিতে বুঝতে পারছি ওটাতে মেজর আদনান আছেন তাঁর দলসহ। কিন্তু আলোর ইশারার জবাব না পেলে নিশ্চিত হই কী করে? আবার লঞ্চ-এর গতিও কমছে না। দেখতে দেখতে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলো। ভাবলাম ওরা জায়গা চিনতে না পেরে এগিয়ে যাচ্ছে না তো?
সশস্ত্র দস্যুদেরকে নিয়ে মহা বিপাকে আমি। একটু এদিক সেদিক হলে, কোনো রকম ভুল বোঝাবুঝি হলে কী হবে বলতে পারি না। এমনিতে আতঙ্কিত তারা। আবার বেশি এগিয়ে গেলে এই দূরত্বে যোগাযোগ করা কঠিন হবে। উনাদের কাছে স্যাটেলাইট ফোন আছে। কিন্তু আমাদের এখানে তো নেটওয়ার্ক নাই। এসব ভাবতে ভাবতে দেখি গতি কমে গেছে লঞ্চ এর।
বড় নদীতে তখন ভাটা হয়ে হয়ে গেছে। পশুরের স্রোত ঘুরে গেছে। নদীর এখানে একটা বড় বাঁক আছে। বড় নদীর সাথে সাথে ভদ্রা নদীর পানিও নামছে এই বাঁক দিয়ে। তাই ভাটার স্রোতের চাপ একটু বেশি। সেই চাপ সামলাতে সামলাতে লঞ্চটি প্রায় এক কিলোমিটার ভাটিতে চলে গেছে।
গতি কমতে কমতে টর্চ এর পাল্টা ইশারা পেলাম। সম্ভবত ইচ্ছা করেই একটু দেখে শুনে সিগন্যালের জবাব দিয়েছে তারা। লঞ্চটির শুধু সিগন্যাল বাতি জ্বলছে। বাঁকী সব আলো বন্ধ। নদীর মাঝখানে নোঙ্গর করা কঠিন কাজ। বিশেষ করে ছোট লঞ্চ এর জন্য সেটা বেশিই কঠিন। পানির গভীরতা সেখানে কয়েকশ’ ফুট। নোঙ্গর নাগাল নাও পেতে পারে।
টান টান উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে আছি সবাই। এর মধ্যে বেলায়েত সরদার বললেন, ও ভাই, ওরা মনে হয় ভয় পাচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বহরের সবাই হেসে উঠলো। হা হা হা হা। আমিও না হেসে পারলাম না। বললাম, মরার সময়ও হাসাতে পারবেন আপনি। তাহলে, ছোট করে একটা গল্প শোনেন ভাই। সরদার বলতে থাকলেন, আমার দাদা মারা যাওয়ার আগে একদিন ডেকে বললো, ও ভাই, তোদের জন্য তো কিছু রেখে যেতে পারলাম না। সুন্দরবনটা রেখে গেলাম দেখেশুনে খাস! বললাম, তখন থেকে দাদার সূত্রে এই জঙ্গলের মালিক হয়ে গেলেন? বললেন, জ্বি ভাই, তখন থেকেই জঙ্গলটাকে নিজের মতো করে খাচ্ছি! হাসতে হাসতে শেষ আমরা সবাই। বললাম, চলেন দেখে আসি ওদের।
বেলায়েত সরদারের ট্রলার থেকে সবাইকে নামিয়ে দিলাম দস্যুদের ট্রলারে। পলিন, ইয়ামীন ভাই, রাজীব, নিজাম ভাইসহ ট্রলারের সবাইকে বললাম, মাস্টারের সাথে থাকেন আপনারা। আমি একটু দেখে আসি কারা ওরা। ইঞ্জিন স্টার্ট দেন। বেলায়েত সরদারের ওই ট্রলারটি চলতো সিঙ্গেল স্ট্রোক ইঞ্জিন দিয়ে। ওরা বলতো এক গুতো মেশিন। বেশ শব্দ করে চলে। হ্যান্ডেল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চালু করতে হয় সে ট্রলার। মামুনকে উঠিয়ে নিলাম ইঞ্জিন চালানোর জন্য। রওনা হলাম আমরা। অন্যদের রেখে গেলাম দুটি কারণে। এক, দল ছোট করে ওখানে যাওয়া ভালো। দুই, আমি ওদিকে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে ভয় পেয়ে ওরা পালিয়ে না যায়।
যথারীতি সরদার দাঁড়ানো সুকানিতে। আমি দাঁড়ানো গলুই-এ। মামুন থাকলো নিচে ইঞ্জিনের পাশে। প্রায় পনেরো মিনিট চললাম। ট্রলারের আলো সবগুলো জ্বালানো। যাতে ওদিক থেকে স্পষ্ট দেখতে পায়। একটু ভুল বোঝাবুঝি হলে
জীবনটা চলে যাবে। এই মাঝ নদীতে নিজেকে আড়াল করার কোনো সুযোগ নাই। তাদের বোঝাতে হবে যে এই ট্রলারে আমি আছি, সশস্ত্র দস্যুরা নাই। কাছে গিয়ে গতি কমালাম। ট্রলার ভিড়ালাম ওই লঞ্চ এর পাশে।
কারা ওরা? কাউকে চিনি না। লঞ্চ এর চারপাশের রেলিং এর সামনে দাঁড়ানো। হাতে অটোমেটিক অস্ত্রশস্ত্র, ট্রিগারে আঙ্গুল দিয়ে দাঁড়ানো RAB এর সৈনিকরা। কালো ড্রেস, সিভিল ড্রেস, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট পড়া এলিট ফোর্স এর সদস্যরা। আমরা ভিড়াবো ট্রলার। কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না। বললাম, মেজর আদনান এসেছেন? তাও কেউ কথা বলেন না। বেলায়েত সরদার চিৎকার করে বললেন, এখানে দাঁড়ানো যাচ্ছে না ভাই! অনেক স্রোত। আবার উল্টো বাতাস মানে দখিণা বাতাসও বেড়েছে। বিপরীত স্রোত ও বাতাসে নদীর পানি টগবগ করছে তখন। ভাঙ্গা শোলার মতো সেই নদীতে ভেসে থাকা ওই ছোট্ট এক গুতা মেশিনের ট্রলারের জন্য সত্যিই কঠিন। ওদেরকে বললাম, ভিতরে খবর দেন আপনাদের স্যারকে। বলবেন, মোহসীন ভাই আসছে।
ভিতর থেকে সিভিল ড্রেস-এ একজন আসলেন। না আদনান না। উনাকেও চিনি না। আমাকে দেখে বললেন, আপনি মোহসীন মামা? একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, আমারই তো আসার কথা। এই সময়ে, এই জঙ্গলের মধ্যে আর কে আসবে? বললাম, মেজর আদনান কোথায়? বললেন, আসেন। বলেই লঞ্চ-এ থাকা অন্যদের বললেন ট্রলার ভিড়বে, তোমরা সহযোগিতা করো। উনার নাম মোস্তাফিজ। সবাই তাঁকে মামা বলে ডাকছেন কেন বুঝতে পারছিলাম না।
রোলিং এর মধ্যে মাঝ নদীতে ট্রলার ভিড়াতে বেগ পেতে হলো। দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। কিন্তু কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে বাঁধতে হলো। দূরত্ব না রাখলে নাকি আমাদের ট্রলার ভেঙ্গে যাবে। ঢেউ বাড়ছেই। কিছুতেই পার হতে পারছি না। পড়লে কই হারিয়ে যাবো! লাশটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনিতে শরীরটা দুর্বল না। কিন্তু নির্ঘুম তৃতীয় রাতে এসে সেই ঝুকি নেয়া যাবে না। মামুনকে বললাম, আমাকে একটু হেল্প করো, এই দিকে আসো!
টি-শার্ট, শর্টস পড়া একজন মানুষ মাঝ সুন্দরবনে কোত্থেকে আসলো? কে এই মানুষ? কী হবে আজ? RAB সদস্যরা কিছুই বুঝতে পারছেন না। আমার দিকে তাকিয়ে থাকা দেখেই বুঝতে পারছি। শুধু এসএমজিতে শক্ত হাতগুলো রাখা, যেকোনো সময় আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত তারা। শুধু অফিসারের নির্দেশের অপেক্ষা। আবার বললাম, মেজর আদনান কোথায়?
মনে হলো আদনান লঞ্চ-এর কোনো একটি কেবিনে আছেন। হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছেন। কিন্তু অন্য অফিসারদেরও তো থাকার কথা। তাঁরা কোথায়? মোস্তাফিজ মামা বললেন, স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। বলেই হাত বাড়িয়ে দিলেন। মামুন এসে হাতটা ধরলো। নিজে পার হয়ে গেলো লঞ্চ-এ। তারপর হাতে ধরে টেনে নিলো আমাকে। লঞ্চ-এ উঠিয়ে দিয়ে ট্রলারে ফিরলো মামুন। সরদার বললেন, এভাবে ট্রলার রাখা যাবে না। বললাম দড়ি খুলে দেন। আশে পাশে ঘুরতে থাকেন। সিগন্যাল দিলে এসে নিয়ে যাবেন।