হারিয়ে ফেলললাম সরদারের ট্রলার | রূপান্তরের গল্প ১০৯ | Rupantorer Golpo 109 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১০৯ : নিচে নামতেই দেখি লঞ্চ-এর সামনের দিকে জটলা। শোরগোল চলছে অ্যাঙ্কর নিয়ে। চিৎকার করে কর্মীদের বকাঝকা করছেন সারেঙ। বলছেন, জোয়ার শেষ হয়ে ভাটাও হয়ে গেছে কিন্তু তোমরা কেউই খেয়াল করোনি। উনাদের ঘিরে RAB সদস্যরা দাঁড়ানো। লঞ্চ-এ আসার সময় তাঁদের সতর্ক সশস্ত্র অবস্থান দেখেছিলাম। তাঁরাও জড়ো হয়েছেন গলুইয়ের দিকে।
যে পাশ দিয়ে উঠেছিলাম সেপাশে এসে আমাদের ট্রলারের খোঁজ করছি। টর্চ জ্বালিয়ে ইশারা দিচ্ছি বার বার। উনাদেরও জিজ্ঞেস করলাম, ট্রলারটা দেখেছেন? কেউ উত্তর দিলেন না। RAB সদস্যরা কেন এমন আচরণ করছেন কিছুতেই বুঝতে পারছি না। হয়তো অপারেশনে থাকা অবস্থায় অপরিচিত কারও সাথে কথা বলা নিষেধ! মোস্তাফিজ মামাকে বললাম, উনাদের একটু জিজ্ঞেস করবেন যে আমার ট্রলারটা কোথায়? এবার তাঁর চেহারা দেখলাম। ছোট্ট একটা গালি দিয়ে বললেন, এই তোরা কথা বলিস না কেন? সাথে সাথে উনারা বললেন, ট্রলারটা তাঁরাও খুঁজে পাচ্ছেন না। কী একটা বিপদ!
শরীরটা খুব ভারী লাগছে। ছোট ছোট দুশ্চিন্তাগুলো আর মাথায় নিতে পারছি না। কিন্তু সুযোগ কোথায়? আমি জানি, এই মুহুর্তের একটি ছোট্ট ভুল পুরো কাজটাকে নষ্ট করে দিতে পারে। নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। ভুল করা যাবে না। শরীরের সাথে মাথাটাকেও চাঙ্গা রাখতে হবে। বার বারই শরীরটাকে টেনে তুলছি। কিন্তু বেলায়েত সরদার কই? আমাকে যেতে হবে ভদ্রার ঠোঁটায়। এখনও যেতে হবে। ওদেরকে দেখতেও পাচ্ছি না।
ওদিকে লঞ্চ-এর নোঙ্গর তোলা নিয়ে হই হুল্লোড় চলছে। মাথায় যন্ত্রণা দিচ্ছে সেই শব্দগুলো। কিন্তু সেখান থেকেই মাথায় আসলো সমাধান। সারেঙ বলছিলেন যে জোয়ার শেষ, ভাটা হচ্ছে। মানে লঞ্চটা ঘুরে গেছে। তার মানে আমি যেদিকে টর্চ এর আলোর ইশারা দিচ্ছি সেটা উল্টো দিক, মানে নদীর পূর্ব দিক! অর্থাৎ যখন উঠি তখন লঞ্চটির সামনের অংশ ছিলো দক্ষিণ দিকে। ভাটা শুরুর পর সেটি যে ঘুরে উত্তরমুখী হয়ে গেছে সেটা মাথায় ছিলো না। তারপরও লঞ্চ এর একজনকে জিজ্ঞেস করলাম পশ্চিম দিক কোনটা? বললেন, আমরা পূর্ব দিকে আছি। সাথে সাথে হাঁটা দিলাম। উল্টো পাশে গিয়ে দেখি বেলায়েত সরদারের ট্রলার ভেসে আছে সামনে। দূরে আবছা দেখা যাচ্ছে ভদ্রার ঠোঁটা। সেখানে আলোও জ্বলছে। টর্চ জ্বালিয়ে সিগন্যাল দিলাম। গিয়ার দিয়ে চলতে শুরু করলো বেলায়েত সরদারের ট্রলার।
উপকূলের বড় নদীগুলোতে জোয়ার-ভাটার প্রভাব অনেক বেশি। পানির স্রোতের দিক দেখে সব সময় জোয়ার হচ্ছে না ভাটা হচ্ছে সেটা বোঝা যায় না। বিশেষ করে রাতের বেলা আমি কিছুতেই বুঝি না। জেলেরা অন্ধকারে পানির দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারেন সে কথা। এছাড়া আকাশে চাঁদ থাকলে সেটা খুব সহজ হয়ে যায়। কয়েক বছরে সেই হিসাব করা কিছুটা শিখেছি মাত্র। পুরোটা শিখলে বা জানলে আমার ওই ট্রলার খুঁজে পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হতো না।
নদীর চেহারা তখন আরও উত্তাল। সরদারের ট্রলার সেই ঢেউ মোকাবেলা করে আগাচ্ছে। কিন্তু কাছে এসেও ভিড়ানো যাচ্ছে না। এতো ঢেউ! উঠবো কী করে? এদিকে লঞ্চ-এর লোকজন চিৎকার করে বলছেন, কাছে আসবেন না! ধাক্কা লাগলে লঞ্চ-এর ক্ষতি হবে। আবার এক ধাক্কায় সরদারের ট্রলারটিও ভেঙ্গে যেতে পারে। কিন্তু আমাকে ওখানে যেতেই হবে। ওদিকে সুকানি হাতে ট্রলার সামলাতে ব্যস্ত সরদার। গলুই-এ দাঁড়ানো মামুন। বললো, ও ভাই, দাঁড়ান আপনি। আমি তুলে নিচ্ছি আপনাকে। কিন্তু এই অবস্থায় ওখানে উঠবো কী করে মাথায় আসছিলো না।
আমাকে যেতে হবে ভদ্রা নদীর মুখে। সশস্ত্র বনদস্যুরা অপেক্ষা করছে সেখানে। প্রয়োজনে কতো কিছুই করতে হয়। করা হয়ে যায়। ওই বৈরী পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসলো ট্রলার। পশুর নদীর ওই চেহারা পরিচিত। কিন্তু জেলেদের মতো করে চলা শিখিনি। শরারীরিক সক্ষমতাও তাদের মতো না। তবুও লাফ দেয়ার মতো দূরত্বে আসলেই লাফ দিতে হবে। মামুন এসে দাঁড়িয়েছে আমাকে ধরার জন্য। মুহুর্তেই লাফ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শরীর আর মনটাকে একসাথে নিয়ে দিলাম লাফ!