অস্ত্র রেখেই উঠে আসলো বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ১১৪ | Rupantorer Golpo 114 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১১৪ : টান টান উত্তেজনা দু’দিকে। এর মধ্যে এক দস্যু বললো, ও ভাই লাইভ করবেন না? বললাম, এখন তোমার লাইভের কথা মনে পড়লো? বললো, এখন যদি উনারা আমাদের ক্রসফায়ার দিয়ে দেয়? বললাম, দিলে দিবে। আর একটা কথাও বলবে না। সবাইকে বললাম আবার, মাথা ঠান্ডা রাখবেন সবাই। সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণে। লঞ্চ-এর দিকে দেখিয়ে বললাম, ওই যে দেখেন মেজর আদনান। বললাম ঠিকই। কিন্তু বরিশাল RAB এর উপ-অধিনায়ক আদনান কবীরকে তো ওরা চিনে না। আবার বরদস্যুদের কাউকে চিনেন না উনারাও। এতো দিন আমার চোখে উনারা দেখেছেন বনদস্যুদের। আবার দস্যুরা মেজর সাহেবকেও দেখেছে আমার চোখে।
বনদস্যু ও RAB-এর মধ্যে দূতিয়ালী করতে গিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করেছিলাম দীর্ঘ সময় নিয়ে। যার ফলাফল আজকের এই আত্মসমর্পণ। বার বার হোঁচট খেয়েছি। আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। শুভাকাঙ্খীরা বলতেন এই কাজটা ছেড়ে দিতে। আবার কেউ কেউ বলতেন চালিয়ে যান। আমার মনও বলতো চালিয়ে যেতে হবে যতো বাধাই আসুক।
মেজর আদনান ছাড়া RAB এর বহরের কেউই জানতেন না কী ঘটতে যাচ্ছে আজ। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। আমি শুধু সতর্ক যাতে এদিক থেকে কোনো ভুল না হয়। ভাবতে ভাবতে কখন যে চা ঠান্ডা হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। ভদ্রার ঠোঁটা থেকে রওনা দেয়ার সময় ওই চা ভর্তি মগটি দিলো মামুন। বললাম, ও মামুন, চা তো ঠান্ডা হয়ে গেলো। বেলায়েত সরদার বললেন, তাহলে লঞ্চের চারপাশে একটু চক্কর দেই ভাই? বললাম, কেন রে ভাই? সরদার বললেন, এর মধ্যে মামুন আরেক কাপ চা বানায়ে দিতো! লঞ্চে উঠলে তো খাওয়াবে লাল চা। ওতে আপনার পোষাবে? সবাই হেসে দিলো। সাথে আমিও। কপালে হাত দিয়ে বললাম, আমি উঠবো এখন। আপনারা কিন্তু আবার হারায়ে যাইয়েন না।
আমি হারাই? তখন তো আপনিই হারায়ে গেলেন! আপনিই তো উল্টো দিকে খোঁজাখুঁজি করলেন। বললাম আপনারও তো একটু মাথায় রাখা উচিৎ ছিলো। লঞ্চ ঘুরে গেছে খেয়াল করবেন না? সরদার বললেন, অতো খেয়াল রাখা যায়? তখন তো আমি ট্রলার ভাসায়ে রাখা নিয়ে ব্যস্ত। নদীর যা অবস্থা ছিলো তখন! বললাম, এখন তো নদী ঠান্ডা। তাহলে চারপাশ দিয়ে চক্কর দিবো কেন? বললেন, ওদেরকে একটু টেনশনে রাখলাম! আর মধ্যে একটু চা-ও খেয়ে নিলেন! লঞ্চ-এ তো দুধ চা খাওয়াবে না ভাই। ওই উত্তেজনার মধ্যেও না হেসে পারা গেলো না। বললাম, ট্রলার ভিড়ান RAB-এর লঞ্চ-এর পাশে।
সবার সামনে দাঁড়ানো মোস্তাফিজ মামা। উনার দুই পাশে সিভিল পোশাকে আরও তিন/চার জন। হাত তুলে ইশারা করলাম। জবাবে ট্রলার ভিড়ানোর ইশারা দিলেন তিনি। দোতলার রেলিং ধরে দাঁড়ানো মেজর আদনান। চোখাচোখি হতেই আমাকে বললেন, আপনি আগে চলে আসেন ভাই। বলতে বলতে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম লঞ্চ-এ। পিছনে ফিরে দস্যুদের বললাম, অপেক্ষা করেন।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছে। RAB এর এক অফিসার জানতে চাইলেন মাস্টার কে? বললাম, ওই হলো বনদস্যুদের ট্রলার। মাস্টার বাহানীর যারা সারেন্ডার করবে তারা সবাই ওখানে আছে। তাকিয়ে দেখি একপাশে এসে দাঁড়িছে সবাই। মাস্টার ছাড়া সবাই শক্ত করে বন্দুক ধরে আছে। তবে অস্ত্রগুলোর নল নিচের দিকে রাখা। আবার এ পাশের পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রশিক্ষিত RAB সদস্যরা অটোমেটিক অস্ত্রগুলো তাক করে আছে দস্যুদের দিকে। হঠাৎ করে মনে হলো আমার কাজ শেষ। ভয় পেয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে দস্যুরা যে কোনো ঝামেলা করবে না ততোক্ষণে বুঝে গেছি। অপ্রশিক্ষিত অস্ত্রধারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ কাজ নয়। আর এদিকের সবাই প্রশিক্ষিত। কমান্ডারের নির্দেশ না পেলে উনারা কেউ গুললি করবেন না নিশ্চিত। আর কমান্ডার তো আমার সামনেই দাঁড়ানো।
আদনান, আমার কাজ শেষ ভাই। এবার তোমাদের পালা। মাস্টার বাহিনীকে নিয়ে এসেছি। সবকিছু বুঝে নাও। দস্যুদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন তিনি। ওইটুকু অভ্যর্থনায় বনদস্যুরা দেখলাম বিগলিত। আদনানের প্রতি তাদের সম্মান ছিলো আকাশ ছোঁয়া। যদিও অপরাধ জগতের ওই মানুষগুলো ছিলো RAB-এর টার্গেট। আর আদনানের নেতৃত্ব বেশ কয়েকটি দস্যুবিরোধী অভিযানও হয়েছে। তবুও এই মেজর সাহেবকে নিয়ে তারা সন্তুষ্ট। আদনানের অভ্যর্থনার জবাব হাত তুলে সালাম দিয়ে জানালো দস্যুরা।
আদনানকে জিজ্ঞেস করলাম, মাস্টার কোন জন বলো তো? কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন। কখনও দেখেনি যাকে তাকে সনাক্ত করা সহজ না। তবে কাজ করতে গিয়ে যে বিবরণ পেয়েছেন তার সঙ্গে মিলিয়ে আঙ্গুল তুললেন তিনি। ট্রলারের ছাদে অন্যদের থেকে একটু পিছনে দাঁড়ানো ওই লোকটিই মাস্টার। একদম ঠিক। আদনানের বিচক্ষণতার প্রমাণ পেলাম আবারও। কিন্তু অন্য কেউই দস্যুনেতাকে চিনতে পারেননি। তারা সবাই আমার সহকর্মী পলিনকে মাস্টার মনে করেছে। পলিন তখন দস্যুদের ট্রলারে বসা, কোলে মাস্টারের মেয়ে। যখন বললাম উনি আমার সহকর্মী পলিন, লজ্জা পেয়ে গেলেন সবাই।
আসলে তখনও সুন্দরবনের ওই দস্যুদের সবার ছবিও ছিলো না আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। ছবি তোলার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতো তারা। বাহিনীর ভিতরে ক্যামেরাসহ কোনো ফোন রাখা হতো না। শুরুর দিকে যখন আসতাম দস্যুদের কাছে তখন আমিও সতর্ক থাকতাম। ক্যামেরা আর ফোন বন্ধ করে রাখতে হতো। ইন্টারভিউ নিতে হতো চেহারা ঢেকে। তাই ডাকসাইটে ও কুখ্যাত জলদস্যুদের সনাক্ত করা ছিলো দুরূহ কাজ।
মেজর আদনানের সাথে শেষ কথা, ওদের নিয়ে আসেন ভাই। মাঝ নদীতে ভাসছি আমরা। লঞ্চটির ইঞ্জিন চলছে। জেনারেটর চলছে। তখন পুরো লঞ্চ আলোকিত। সবাই তাকিয়ে দস্যুদের দিকে।
নিচে নামলাম। মাস্টারসহ বনদস্যুদের বললাম এগিয়ে আসেন। বেলায়েত সরদারের ট্রলার হয়ে তাদের উঠতে হবে লঞ্চ-এ। বললাম, উঠে আসেন আপনারা। মাস্টার বললো, অস্ত্র নিয়েই আসবো? বললাম, অনেক তো হলো। ওগুলো রেখে আসেন ট্রলারে। একে একে উঠে আসলো সবাই। আমাদের ট্রলারের উপর দাঁড়ানো মাস্টার বাহিনী। এখন আর সশস্ত্র না, প্রত্যকে নিরস্ত্র।
(ছবিটি একটি আত্মসমর্পণের সময়ে তোলা। সুন্দরবনের গহীনে)