জলদস্যুরা গেলো RAB হেফাজতে | রূপান্তরের গল্প ১১৫ | Rupantorer Golpo 115 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১১৫ : সাঁজোয়া লঞ্চটি পশুর নদীর ঠিক মাঝখানে দাঁড়ানো। এক পাশে আমরা। দস্যুদের ট্রলারটিও এদিকেই। বিপরীত পাশ ও পিছনে RAB-এর স্পিডবোট। নিরাপত্তা নিশ্চিতের সব প্রস্তুতি ছিলো তাদের। দস্যুরা সবাই আমাদের ট্রলারে দাঁড়ানো। কিছুক্ষণের মধ্যে RAB হেফাজতে যাবে তারা।
তখনও দস্যুদের মধ্যে কে মাস্টার, কে সোহাগ, কে সুমন, কে সোলাইমান চিনতে পারছেন না RAB সদস্যরা। প্রত্যেকেই দাঁড়ানো আমাদের ট্রলারের উপর। সামনে আমি। সহকর্মী ইয়ামীন ভাই লঞ্চ-এ উঠলেন নামাজ পড়ার জন্য। ফজরের নামাজ। তার মানে ভোর হয়ে যাচ্ছে! ইয়ামীন ভাইকে ঘিরে ধরলেন RAB সদস্যরা। মাস্টার কোন জন?
এই দস্যুনেতাকে নিয়ে এতো আগ্রহ তাদের! RAB কর্মকর্তা জসীম ভাই, হাফিজ ভাইসহ সকলকে মাস্টার দেখিয়ে দিলেন ইয়ামীন ভাই। দেখিয়ে নামাজ পড়তে গেলেন। সময় কী ভাবে কাটছে মনে নাই, সেভাবে ঘড়ি দেখা হয়নি গত তিন দিন। ২৫ মে থেকে ২৮ মে। ঝড়ের মতো কেটেছে প্রতিটি মুহুর্ত। সেই অর্থে সময় খুব বেশি নাই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মংলা আসার আগে, সকাল ১০টার মধ্যে মংলা পৌঁছাতে হবে। এখনও অনেক কাজ বাঁকী। সব শেষ করে পানি পথে পৌঁছাতে হবে। তবে তার আগে দস্যুদের বুঝিয়ে দেওয়া জরুরি।
প্রথমে এগিয়ে দিলাম দস্যুনেতাকে। মোস্তফা শেখ (মাস্টার) আকৃতিতে বেশ ছোটখাটো। হুট করে দেখলে নজরে পড়বে না। আসলে ডাকাত সরদার হিসাবে আমাদের কল্পনায় যা আসে তা না, একদমই না। এই খর্বাকার মানুষটিই পুরো বঙ্গোপসাগরের জেলেদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছে? দেখতে সাধারণ। অথচ এই মানুষটি সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদলের নেতা!
প্রথমে নামলেন মাস্টার, তারপর সোহাগ আকন, এরপর সুমন, সোলাইমান, সুলতান কাকা, ফজলু শেষ… মনে হলো বিশাল বড় পাহাড় নামলো আমার মাথা থেকে। মেজর আদনান কবীরের হাতে তুলে দিলাম মাস্টার বাহিনীকে। এই সময় পর্যন্ত আসতে কতো শংকা, কতো ঝক্কি পার করেছি আমরা সবাই মিলে। মনে হচ্ছিলো সাত বছর ধরে যে বোঝা ঘাড়ে নিয়েছিলাম তা নেমে যাচ্ছে!
একজন মানুষের জীবনের দায়িত্ব নেওয়া যায়? সেটা কি খুব সহজ? আমার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষের পক্ষ্যে সেই কাজ অনেক বেশি কঠিন! হতে পারেন তিনি একজন অপরাধী। কিন্তু জীবন তো জীবনই। আমার কোনো ভুলে কারও জীবন সংশয়ে পড়লে সেই ক্ষতি পোষানো অসম্ভব। তাই খুব ভেবে চিন্তে প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করতাম। সুন্দরবনের দস্যুদের জীবনগুলো বাঁচলে কার লাভ? কার ক্ষতি? অথবা কী লাভ ওই খারাপ মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে? অনেকেই বলেন সে কথা। ওদের ক্রসফায়ারেই মরা উচিৎ, এমন মন্তব্য অনেক সুশীলের মুখেও শুনেছি। অখচ একটি জীবন কতো মূল্যবান! অপরাধের শাস্তি হতেই হবে। দস্যুদের সাথে আমার বোঝাপড়াও ছিলো তেমন।
সাধারণ ক্ষমা নয়, নিরাপদ আত্মসমর্পণই ছিলো আমার সাথে তাদের শর্ত। মামলা চলবে মামলার মতো। অতীদের অপরাধের জন্য যে মামলাগুলো আছে সেগুলোও চলবে। আর সবশেষ অস্ত্র জমা দেয়ার সময়ও মামলা হবে একটি। অন্য অপরাধীদের মতো তারা জেলখানায় যাবে, জামিন নিবে, বাড়ি ফিরবে, যদি মামলার শাস্তি হয় সেই শাস্তিও ভোগ করবে। শেষ কথা, এটি বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ।
অনেকেরই প্রশ্ন, হিংশ্র অপরাধী এই দস্যুরা তো অত্যাচার করছে। তাদের কেন বাঁচাতে চাচ্ছিলাম? আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান অভিযানে কোণঠাসা হলেও দস্যুতা নির্মূল হবে বলে মনে হয়নি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম, একটি অস্ত্রও যদি বনের ভিতরে থাকে সেখান থেকেই একটি দস্যুদলের জন্ম হয়। তারপর ফুলে ফেঁপে তৈরি হয় সংগঠিত দল। এছাড়া ফেরারি মানুষগুলোর জন্য সুন্দরবন ছাড়া নিরাপদ কোনো জায়গা ছিলো না। তাই জেলখানায় গেলেও জামিন পেলেই পালিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে পড়ে তারা। বাড়িতে থাকার উপায় নাই বলেই বনদস্যুরা দস্যুতার পথেই থেতে যায়। তাই যদি বুঝিয়ে সারেন্ডার করানো যায়, অস্ত্রগুলো যদি সুন্দরবন থেকে বের করে জমা করানো যায় তাহলে কাজের কাজ হতে পারে। আমার ভাবনায় ছিলো দস্যুমুক্ত সুন্দরবন।
কেউ বলেন একমাত্র আমার উদ্যোগেই সুন্দরবনের দস্যুরা সারেন্ডার করছে। কিন্তু বিষয়টি তেমন না। অনেকগুলো উদ্যোগ ছিলো, অনেকেই দিন রাত এক করে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে আমিও একজন।
ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে করছে। আত্মসমর্পণ করবে যারা তারা সবাই এখন মেজর আদনাদের হেফাজতে। দুই তলায় বসানো হলো সবাইকে। দস্যুদের স্ত্রী-সন্তানদেরও উঠিয়ে আনলাম। কুখ্যাত মাস্টার বাহিনীর ট্রলারটি তখন দস্যুশূণ্য। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বন্দুকগুলো। পলিনসহ অন্যরা তখন ওই ট্রলার পাহাড়া দিচ্ছেন। মোস্তাফিজ মামাকে বললাম, ট্রলারটির দায়িত্ব নিন আপনারা। আমরা খুব টায়ার্ড।