রূপান্তরের গল্প ১১৮ | Rupantorer Golpo 118

বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়ানো হলো দস্যুদের,নামানো হলো অস্ত্র-গুলি | রূপান্তরের গল্প ১১৮

বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়ানো হলো দস্যুদের,নামানো হলো অস্ত্র-গুলি | রূপান্তরের গল্প ১১৮ | Rupantorer Golpo 118 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১১৮ : কী করবে এখন ওরা? নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার এমন সুযোগ কেন হাতছাড়া করবে মানুষ? প্রথমে না হয় ভরসা পায়নি। কিন্তু তাদের লিডারসহ নয়জন কুখ্যাত বনদস্যুকে RAB কী ভাবে অভ্যর্থনা জানালো তা নিজের চোখেই দেখলো তারা। তারপরও আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না কেউ? ২৬ জনের একজনও না? নিশ্চিত জানি যে এদের বেশির ভাগই আবার জঙ্গলে নামবে। মানে দস্যুতায় নামবে।

নিজেরা নতুন বাহিনী গড়বে? মনে হয় না। করলেও দেরি আছে। কারণ ওই বাহিনীর প্রতিটি অস্ত্র ও গুলি আমরা নিয়ে এসেছি। তাহলে অন্য দস্যুদলে যোগ দিবে তারা? সুন্দরবনে তখন দস্যুদল আছে জাহাঙ্গীর, নোয়া মিয়া, মজনু, সুমনসহ বেশ কয়েকটি বাহিনী ছিলো। পশুর নদীর পশ্চিম পাশ পুরোটাই ছিলো মাস্টার বাহিনীর দখলে। তাদের সারেন্ডারের পর সেই জায়গা দখল নিয়ে যুদ্ধ চলবে। সেজন্য লোকবল বাড়াবে বিদ্যমান দলগুলো। সেখানে হাসমত, সবুজদের মতো দস্যুরা এসে ভিড়বে। হাসমত কিংবা সবুজসহ সারেন্ডার না করা ২৬ জনের দুইজন। যাক, তারা তাদের ভাগ্য গড়বে।

একটা চেয়ারে বসে বসে ঝিমাচ্ছিলাম। শরীরটাকে আটকাতে পারছি না কিছুতেই। তিন দিন একটানা ঘুম ছাড়া শরীরটাকে ধরে রাখা যে কতোটা কঠিন ছিলো! একটু শোরগোলে ঘুম ভাঙ্গলো। পাশে বাঁধা আমাদের ট্রলার। সেখান থেকে এক কাপ চা বানিয়ে লঞ্চ-এ ওঠার সময় মামুনকে বাঁধা দেন RAB সদস্যরা। ছেড়ে দিতে বললাম, তবুও ছাড়লেন না। পরে উঠে ট্রলারে নামলাম। সেখানে বসে চা খেলাম। মামুন ভীষণ ক্ষিপ্ত। বললাম, RAB সদস্যরা আমাকে চিনতে পারেননি, ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেননি।

ততোক্ষণে হাড়বাড়িয়া খালের মুখে চলে এসেছি আমরা। নোঙ্গর করা হবে জেটিতে। ট্রলারগুলো যে পাশে বাঁধা ছিলো সেখান থেকে সরিয়ে বিপরীত পাশে নেয়া হলো। কেবল জোয়ার হয়েছে। তাই ফরেস্ট অফিসের জেটিতে লঞ্চ ভিড়ানো একটু কঠিন। অবশ্য ছোট লঞ্চ বলে তেমন অসুবিধা হলো না। নেমে পড়লাম সবার আগে। তারপর সোজা হেঁটে চারপাশটা দেখে লাইভ এর যন্ত্রপাতি বসানোর জায়গা নির্ধারণ করলাম। আমাদের ব্রডকাস্ট টেকনিশিয়ানরা কাজ শুরু করলেন। সময় তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। বললাম, ছয়টার মধ্যে সব সেট করতে হবে। অফিসে ফোন দিয়ে জানালাম আমাদের পরিকল্পনার কথা।

আমাদের ট্রলারে রাখা অস্ত্রগুলো বের করা হলো। সেগুলো নিয়ে জেটিতে রাখলাম। গুলিগুলো যেভাবে ছিলো সেভাবেই রাখা হলো। দস্যুদের হাতে থাকা অস্ত্রগুলো নিয়ে RAB সদস্যরা রাখলেন সেখানেই। সবগুলো অস্ত্র তখনও গুলি ভরা। অবৈধ অস্ত্র ও গোলা-বারুদ আনুষ্ঠানিক ভাবে হেফাজতে নিবে RAB, সঙ্গে মাস্টারসহ দস্যুরাও যাবে তাদের হেফাজতে।

ততোক্ষণে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়ানো হয়েছে সারেন্ডার করতে আসা দস্যুদের। এসব দেখে মাস্টার ও সোহাগের স্ত্রী সন্তানেরা কান্নাকাটি শুরু করলেন। তাদের কোথায় নেয়া হচ্ছে? আবার কেন সুন্দরবনে যাচ্ছি আমরা, এসব নিয়ে বিশাল চিন্তায় পড়ে গেছেন উনারা। বললাম, আমি আছি, টেনশন করেন কেন? উনাদের সেই ডাইনিং রুমে বসিয়ে দিলাম। বললাম, নাস্তা দিবে এখন। খেয়ে বিশ্রাম নিন। আমাদের কাজ করতে দিন। একে একে নামানো হলো বনদস্যুদের।

জেটিতে RAB এর লঞ্চ এসেছে। তার মানে নিশ্চয়ই বড় কোনো অভিযান, ক্রসফায়ারের ঘটনাও ঘটবে হয়তো! বন বিভাগের সদস্যরা রীতিমতো ভড়কে গেছেন। ওসি সাহেব অপরিচিত। কিন্তু সেখানাকার কয়েকজন বনকর্মী আমাকে চিনেন আগে থেকে। কাছে গিয়ে কানে কানে বললাম, টেনশন করবেন না। তাদের জেটির উপর অতোগুলো অস্ত্র দেখে ভয় আরও বেড়ে গেলো। বললাম, ওই যে হেলমেট পড়া লোকগুলোকে চিনেন? বললেন, হবে কোনো ডাকাত পার্টি। কিন্তু কোন বাহিনী সেটা বলতে পারলেন না। দস্যুদের কাউকেই চিনে না। আসলে তাঁরা চিনেন ঠিকই। কিন্তু ভয়ে বলছেন না। একজন পূর্ব পরিচিত বনকর্মী শুধু কানে কানে জিজ্ঞেস করলেন, ও ভাই, এদেরকে কি ক্রস-এ দিবেন?

মোস্তাফিজ মামা তখন ভীষণ ব্যস্ত। বললাম, ফরেস্টের ওসি সাহেবকে আপনারা একটু বুঝিয়ে বলবেন? অবশ্য ততোক্ষণে মেজর আদনান নেমেছেন। তিনি নিজেই আলাপ সেরে নিলেন। বনরক্ষীরা বিশাল টেনশন নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মেজর সাহেবকে বললাম, আমরা প্রায় প্রস্তুত। আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করতে পারো।

একগাদা অস্ত্র গুলি নিয়ে তখন ব্যস্ত সবাই। জেটি থেকে সেগুলো নেয়া হচ্ছে বনের ভিতরে। সে সময় বরিশাল RAB এর উপ অধিনায়ক বললেন, অস্ত্রগুলোর ভিতরে গুলি আছে কী না চেক করেছো? উনারা বললেন, না স্যার। এবার সজোরে ধমক খেলেন মোস্তাফিজ মামা। সাথে সাথে বন্দুকগুলো সেখানে দাঁড়িয়েই চেক করা হলো। সবচেয়ে ভালো অস্ত্রগুলো অর্থাৎ টুয়েল বোর এর শর্টগানগুলোর চেম্বারে গুলি ভরা। প্রতিটির চেম্বারে ছয়টি থেকে আটটি গুলি। সেগুলো বের করা হলো। একে একে ৫১টি বন্দুক চেক করতে সময় চলে গেলো আরও কয়েক মিনিট।

সাড়ে ছয়টা বাজতে আর কয়েক মিনিট বাঁকী। আমাদের লাইভ টিমের সদস্যরা দেখলাম ঘেমে গেছেন। আতিক ভাই বললেন, যন্ত্রপাতি এখনও সেট হয়নি। কোথায় যেন সমস্যা হচ্ছে। এবার আমার সহকর্মীদের ধমক দিলাম আমি। বললাম, সাড়ে ছয়টার মধ্যে আমাদের লাইভে যাওয়ার কথা! অফিসে ফোন দিতে গিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক চলে গেছে। মানে ঝামেলা যখন শুরু হয় তখন চারপাশ দিয়ে নতুন নতুন ঝামেলা এসে হাজির হয়। আসুক ঝামেলা। সহকর্মীদের বললাম, দ্রুত সংযোগ স্থাপন করেন। ঢাকা থেকে সুন্দরবনে আমরা সেই যন্ত্রপাতি টেনে এনেছি ভালো করে সরাসরি সম্প্রচার করবো বলে।

সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। ঢাকায় আমাদের নিউজরুম প্রস্তুত। কিন্তু শেষ সময়ে এসে আমরা বিচ্ছিন্ন। মিনিট পাঁচ সময়ের মধ্যে সমাধান হলো। আসলে গহীন বন বলে আমাদের যন্ত্রটির সাথে স্যাটেলাইটের সংযোগ পেতে সমস্যা হচ্ছে। পরে ডিশ-টি একটু সরিয়ে ফাঁকা আকাশের নিচে রাখতেই সংযোগ পেলাম। ভোর ৬টা ৩৭ মিনিটে লাইভে ঢুকলাম আমরা। ওপাশে স্টুডিওতে সেই সংবাদের উপস্থাপক ছিলেন রুবায়েত হাসান।

এতো ঝক্কির কী প্রয়োজন ছিলো? RAB-এর প্রয়োজন ছিলো না। প্রয়োজন ছিলো আমাদের। কারণ আমার কাছে জলদস্যুদের একটাই দাবি ছিলো। সেটি হলো RAB হেফাজতে যাওয়ার সময় সেই প্রক্রিয়া সরাসরি প্রচার করতে হবে। রাজি ছিলাম সেই শর্তে। আবার সারেন্ডারটি আমাদের টেলিভিশনে এক্সক্লুসিভ হবে। ব্রেকিং নিউজ চলছে যমুনা টেলিভিশনে। তখন ভোর ৬টা ৩৭ মিনিট, ২৯ মে ২০১৬। অনেকের ঘুমও ভাঙ্গেনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top