এতো বড় ঘটনা কিন্তু টের পায়নি কেউ | রূপান্তরের গল্প ১১৯ | Rupantorer Golpo 119 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১১৯ : জঙ্গলের ভিতর থেকে একে একে বের করা হলো বনদস্যুদের। দুই পাশে RAB সদস্য। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটে তাদের অচেনা লাগছে। জমা দেওয়া অস্ত্রগুলো তার আগেই এনে সাজানো হয়েছে বনের ভিতরে। একটা একটা করে অস্ত্র সাজানো। সুন্দরবনে এতোগুলো বনদস্যুদের অস্ত্র একসাথে কখনও আটক হয়নি কোনো অভিযানে। মাটিতে বিছানো ত্রিপলে অস্ত্রগুরো সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো।
ঢাকার স্টুডিও থেকে সংবাদ পড়ছেন রুবায়েত। ডিএসএনজিন মাধ্যমে সরাসরি যুক্ত আমি। বনের ভিতরে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সারেন্ডার নিয়ে কাজ করছেন উনারা আর আমার সহকর্মীরা সবাই মিলে লাইভটি নির্বিঘ্ন করার কাজ করছেন। ভোরবেলা সারা বিশ্ব দেখছে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যু দল মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণ। পরের ১৩ মিনিট একটানা চললো নিউজ।
পুরো বিষয়টি নিয়ে সাক্ষাতকার নিলাম মেজর আদনানের। তার কিছুক্ষণ পর জানলাম এই সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ অসহিষ্ণু আচরণ করছেন। কাজ গুছিয়ে নিলাম দ্রুত। সরাসরি সম্প্রচার শেষ করে দম নিলাম। যমুনা টিভিতে তখনও চলছে ব্রেকিং নিউজ। ২৯ মে ভোরবেলা আত্মসমর্পণের জন্য RAB হেফাজতে সুন্দরবনের মাস্টার বাহিনী…!!
আত্মসমর্পণ করা দস্যুদলের প্রতি আমার দেয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হলো। দায়মুক্ত হলাম।
ওই গহীন বনের ভিতর থেকে সরাসরি সম্প্রচার হলো কী করে? যারা সারেন্ডারের বিষয়টি তখনও জনসম্মুখে আনতে চাননি যাঁরা, তাঁরা ঘুরেফিরে এ প্রশ্ন করছেন। কেউ কেউ ভেবেছিলেন সুন্দরবনের ভিতরে ফোনের নেটওয়ার্ক নাই, থাকলেও সেখানে দ্রুত গতির ইন্টারনেট পাবো না। উনারা জানতেন না যে লাইভ করার জন্য আমরা স্যাটেলাইট ডিভাইস ডিএসএনজি নিয়ে গেছি। সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ চাইছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিক সারেন্ডারের সময় জানুক সবাই। বিষয়টি নিয়ে মেজর আদনান কবীর বেশ চাপে ছিলেন।
আমরা আমাদের যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিলাম। RAB সদস্যরা গুছিয়ে নিলেন বনদস্যুদের অস্ত্রগুলো। সবাইকে নিয়ে লঞ্চ-এ উঠলাম। আপাতত আমার কাজ শেষ। নাস্তা করে একটু বিশ্রাম নিবো। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন মংলায়। বাঁকী আনুষ্ঠানিকতা সেখানেই হবে।
হাড়বাড়িয়া ফরেস্ট জেটি। লঞ্চ-এর সাথে আমাদের ট্রলার, দস্যুদের ট্রলার বাঁধা। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরলো দস্যুদের আরেকটি ট্রলার। সারেন্ডার করবে না যারা তাদের নামানো হয়েছে মংলার জয়মনিরঘোল-এ। নাস্তা শেষে এক কাপ চা নিয়ে বসলাম। লঞ্চ-এর সামনে তখন দস্যুদের সবগুলো অস্ত্র রাখা। RAB সদস্যরা অস্ত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখছেন, মাপ নিচ্ছেন, লিখছেন খাতায়। অস্ত্রগুলো সব মামলার আলামত হিসাবে আদালতে জমা হবে।
বিপত্তি বেধেছে গুলিগুলো নিয়ে। কয়েক হাজার গুলি। সেগুলো রাখা বিভিন্ন রকমের ব্যাগ, বাক্স ও প্লাস্টিকের ড্রামের ভিতরে। সেগুলো বের করা, গণনা করা নিয়ে ব্যস্ত উনারা। বিশেষ করে প্লাস্টিকের ড্রামের ভিতরে রাখা গুলিগুলো বের করা নিয়ে বিপাকে উনারা। ঠেসে ঠেসে তুলার ভিতরে ভিতরে রাখা এক একটা ড্রামে ১২ বোর-এর গুলি। এরকম ড্রাম ছিলো কয়েকটা। লবণ পানির ওই পরিবেশে গুলিগুলোকে তাজা রাখতে এ ব্যবস্থা। কাজগুলো সারতে সময় লাগবে।
ভোরবেলা বলে সুন্দরবনের এই খবরটা তখনও সবার কাছে পৌঁছায়নি। সবাই বলতে বন উপকূলের মানুষ, খুলনা, সাতক্ষীরা বাগেরহাটের সাংবাদিকদের ঘুম ভাঙ্গছে একে একে। সংশ্লিষ্ট আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো কিছুই জানে না। জানতে পারেনি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও। ঢাকার নিউজরুমগুলো তখন পুরো গরম। যমুনা টিভিতে সাত সকালে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ দেখাচ্ছে। ক্রাইম রিপোর্টাররা কী করছে? জেলা প্রতিনিধিরা কেন কিছুই জানে না? দায়িত্বশীল কয়েকজন আবার যমুনা টিভিতে প্রচারিত সংবাদ নিয়ে বেশ উত্তেজিত।
হাড়বাড়িয়ায় তখন পুরো জোয়ার। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক এসেছে। ফোন ঢুকছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। বেশ স্পর্শ্বকাতর একটি প্রতিষ্ঠানের এজন কর্তাব্যক্তি ফোন করে বেশ উষ্মা প্রকাশ করলেন, বললেন, কেন তাদের জানালাম না। বললাম, এই কাজটি যে গোপন রাখতে পেরেছি আপনার ফোন তারই প্রমাণ। জানালাম, সাড়ে দশটার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন মংলায়।
পুরো সুন্দরবন যেন থমথম করছে। বনের সেই অন্ধকার জগতের কথা বলছি। সেই দস্যু জগতের ভিতরে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কেউ কেউ টের পাচ্ছিলো। কিন্তু ঠিক কী হতে যাচ্ছে বুঝতে পারছিলো না। এদিকে আমরা ঢুকে পড়েছি, কেউ টের পায়নি। গাড়িতে আমার একটি ফোন অন করে রেখে এসেছি। যাতে কেউ ফোন দিলে বন্ধ না পায়। কৌশলটি কাজে এসেছিলো। খুলনা থেকে বেশ কয়েকজন খোঁজ নিচ্ছিলেন চারপাশে। তাঁরা আমার সোর্সদের কাছে জানতে চাইছেন। কিন্তু সেই সোর্সরাও তো কিছুই জানে না। তাদের কাছেও গোপন রেখেছিলাম পুরো প্রক্রিয়া। আমি সুন্দরবনে ঢুকেছি কী না নিশ্চিত হতে পারেনি কেউ।
সোর্সরা আমার ফোন করছেন। রিং যাচ্ছে কিন্তু ধরছি না। বনের গভীরে থাকলে তো ফোন খোলা থাকার কথা না। সোর্সরা তাই তাদের নিশ্চিত করেছিলো যে আমি এখনও বনের ভিতরে যাইনি। বনে প্রবেশের সময় কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিলাম। এছাড়া গভীর রাতে এসেছি বলে আমাদের গতিবিধি কেউই অনুসরণ করতে পারেনি।