নতুন বিপদে আমরা!, কী করবো জানি না! | রূপান্তরের গল্প ১২১ | Rupantorer Golpo 121 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১২১ : জঙ্গল ঘেঁষে দুটি মাছ ধরার নৌকা নোঙ্গর করা। একটিতে দুইজন, আরেকটিতে একজন। শেষ জোয়ার আর প্রথম ভাটায় মাছ ধরা পড়ে। তাই আমাদের দিকে তাকানোর সময় নাই। মন দিয়ে মাছ ধরছেন তাঁরা।
ভরা জোয়ারে সুন্দরবনটা সবচেয়ে সুন্দর। হাড়বাড়িয়ার ওই জায়গাটি আরও বেশি সুন্দর। সুন্দরী, গড়ান, কেওড়া, বাইন, গোলপাতাসহ সব রকমের গাছ জমাট বাঁধা। দোয়ায় ঘুর্ণি খেতে খেতে পানি বইছে। কয়েকটি ডলফিন ছুটোছুটি করছে সেখানে। RAB-এর লঞ্চ-এর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে এসব দেখছি। ভাবছি কাজটা শেষ করতে হবে। কিন্তু সবকিছু তো আমার হাতে নাই। চৈত্র-বৈশাখ মাসের পরিবেশ বেশ কঠিন।
আকাশ-বাতাস কখন কোন চেহারা নিবে কেউ বলতে পারে না। বনদস্যুদের নিয়ে RAB-এর নৌ-বহর ভাসছে সেখানে। হাড়বাড়িয়ার এই দোয়া বা মোহনা থেকে একটি খাল চলে গেছে পূর্ব দিকে, মিশেছে সেলা নদীতে। আরেকটি খাল দক্ষিণে নেমে গেছে, হরমল খাল হয়ে পড়েছে চরাপুঁটিয়া খালে। এই অঞ্চলে তিনটি বনদস্যু দল আছে, সুমন বাহিনী, শান্ত বাহিনী ও মোশাররফ বাহিনী। মনটা বেশ ফুরফুরে ছিলো। কিন্তু RAB কর্মকর্তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনের ভিতরটা খচখচ করতে শুরু করলো।
মেজর আদনানের মুখ-চোখ অন্ধকার। নিশ্চিত কোনো ঝামেলা হয়েছে। আমি তো আগে থেকেই দুশ্চিন্তায়। কারণ বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক ছিলেন। কোনো সমস্যা? আদনান বললেন, ম্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কুয়াকাটায় নেমেছেন, কিন্তু সেখান থেকে মংলায় আসতে পারবেন কী না বুঝতে পারছি না। আকাশের অবস্থা ভালো না হলে হেলিকপ্টারে এদিকে না এসে সোজা ঢাকা ফিরবে। তবে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য একটি অপেক্ষা করতে হবে।
পূর্ব আকাশে তাকালাম। অনেক দূরে বৃষ্টি হচ্ছে। পরিস্থিতি খুব খারাপ ওই পাশটায়। সুন্দরবনের পূর্ব দিকে বলেশ্বর নদী। দক্ষিণে বরগুনার পাথরঘাটা। তারও পূর্বে কুয়াকাটা। এখন বড় একটা বৃষ্টি না হলে আকাশ পরিস্কার হবে না। আর আকাশ পরিস্কার না হলে হেলিকপ্টার আসবে কী করে?
২৯ মে ২০১৬। আদনান বলছেন, আজকে যদি নির্দিষ্ট সময়ে সারেন্ডার না হয় তাহলে কী হবে বুঝতে পারছেন ভাই? আমরা তো মাস্টার বাহিনীকে হেফাজতে নিয়েছি। আপনি লাইভ করলেন, সবাই জেনে গেছে। আইনগত ব্যাপার আছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য তো আমরা দস্যুদের হেফাজতে রাখতে পারবো না। বললাম, চিন্তা করো। রাস্তা বের হবে। এখান থেকে পিছনে যাওয়ার তো সুযোগ নাই!
ওই পরিস্থিতে আর চাপ নিবো কী করে? আদনানের কাঁধে ঝামেলা চাপিয়ে দিলাম। সোজা এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। এখনও ৫/৭ জন RAB সদস্য গুলি গণনার কাজ করেই যাচ্ছেন। সময় লাগবে। গুলি ৫ হাজারের কম না। পিছনে পিছনে হেঁটে আসলেন মেজর আদনান। বললেন, বিরাট সমস্যায় পড়তে যাচ্ছি ভাই! বললাম, সারেন্ডার অনুষ্ঠান বাতিল হচ্ছে?
মন্ত্রী ঢাকা থেকে আকাশ পথে কুয়াকাটা গেছেন। সেখানে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান শেষে RAB এর হেলিকপ্টারটি মংলায় আসার কথা। কিন্তু আকাশের অবস্থা খুব খারাপ। এই আবহাওয়ায় আজ আর এদিকে আসতে পারবে না হেলিকপ্টার। আবারও বললাম, সারেন্ডার কি পন্ড হচ্ছে? উনি বললেন, বুঝতে পারছি না ভাই। বললাম, তোমরা বুঝতে থাকো। এখানে বাতাস নাই। গরমে খুব কষ্ট হচ্ছে। ট্রলার নিয়ে আমরা বড় নদীতে যাবো, সেখানেই নোঙ্গর করবো।
বেলায়েত সরদারকে ঘুম থেকে উঠালাম। বললাম, বাতাস আছে এমন কোনো জায়গায় চলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, ও ভাই, নয়টা বাজে। মংলা যাবো না আমরা? টেনশনে ভিতরে ভিতরে ঘেমে গেছি ততোক্ষণে। আকাশের মতো আমার চোখ মুখও অন্ধকার। সরদার সেটা লক্ষ্য করলেন। বললেন, ও ভাই, সবকিছু ঠিক আছে তো? বললাম, সব ঠিক। ট্রলার চালান। গরমে টিকতে পারছি না। চোখ ডলতে ডলতে চারপাশে তাকিয়ে বললেন, কই আমরা? বললাম, হাড়বাড়িয়ার ভিতরে। ওই যে দেখেন বইশেলরা মাছ ধরছে। চলেন, মাছ ধরা দেখি। সরদার বললেন, জোয়ার ভাটার মাঝে মাত্র এক ঘন্টা সময় ওরা বড়শি ফেলে। গেলে খুব বিরক্ত হবে। বললাম, আমি তারচেয়েও বেশি বিরক্ত এখন। চলেন ওখানে। মাছ ধরা দেখবো।
নিজের ভিতরে তখন তোলপাড় চলছে। নিজেকে সংযত করতে হবে। এমনও হতে পারে পুরো প্রক্রিয়া এখানেই শেষ হয়ে যাবে। যদি সারেন্ডারের সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরেও আসে তখন কী করবো সেটাও ভাবতে হবে এখনই। আকাশের মতো আমাদের মনের অবস্থাও মেঘে ঢেকে গেছে। ঝড়-ঝাপটা মোকাবেলা করে এ পর্যন্ত এসে ভেবেছিলাম সামনে আর কোনো ঝড় নাই। কিন্তু নতুন করে যে বড় ঝড়টি আসছে সেটি মোকাবেলা করার সক্ষমতা আমার নাই! ট্রলার ছাড়লো। জঙ্গল ঘেঁষে নোঙ্গর করা বড়শির নৌকার পাশে গিয়ে থামলাম। চরম বিরক্তি নিয়ে তাকালেন খুলনা থেকে আসা প্রবীন জেলে। বললাম, কাকা, আপনি মাছ ধরেন। আমরা একটু এই বাইন গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিবো।