আত্মসমর্পণ স্থগিত, আসবেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী | রূপান্তরের গল্প ১২২ | Rupantorer Golpo 122 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১২২ : মাছ পাইছেন কাকা? দেখি তো কয়টা মাছ ধরলেন? নৌকায় বসা প্রবীন জেলে ওমর কাকা এমনিতেই আমাদের নিয়ে বিরক্ত। আমার কথা শোনার পর বেশ রেগে গেলেন। বললেন, মাছ পাইছি কী না সেটা শুনে করবেন কী? মাছ কিনবেন? বিরক্তি ছাপিয়ে মনে হলো একগাদা ক্ষোভ ঝরে পড়লো উনার কথায়। বললেন, আপনারা ঘুরবেন, ঘোরেন। আমার এখানে কী করতে আসছেন? আপনারা যান তো। আমাকে বিরক্ত করেন না। ভাটা হয়ে গেছে। এখন গল্প করার সময় নাই।
বললাম, ঠিক আছে কাকা। ক্ষমা করবেন আমাকে। আমি বুঝতে পারিনি। চলে যাচ্ছি। আসছিলাম এই বাইন গাছের নিচে একটু বিশ্রাম নিতে। অনেক রোদ উঠেছে, বাতাসও নাই। বলতে বলতে সরদারকে বললাম, ট্রলার ছাড়েন, অন্য দিকে চলেন।
ক্ষমা চাইতে দেখে কাকা একটু নরম হলেন। বললেন, আপনারা কই যান? মাছ কয়টা আছে খোলে। এগুলো নিয়ে যান। টাটকা মাছ, ভুনা করে খেলে ভালো লাগবে। দাঁড়িয়ে পড়লাম। মামুনকে বললাম আমাকে একটু কাকার নৌকায় উঠায়ে দাও।
একটা মাছ ধরতে আল্লাহকে ডাকি হাজার হাজার বার। তারপরও মাছ ওঠে-ওঠে না। কয়টা গলদা চিংড়ি ধরতে সেই খুলনা থেকে আসি। একাই ভাটা দিয়ে আসি। নৌকা বেয়ে খুলনা থেকে এই পর্যন্ত আসা মানে বোঝেন? পুরো দুই ভাটা লাগে। সুন্দরবনের এই দিকে আগের মতো মাছ হয় না। কিন্তু মাছ ধরা তো ছাড়তে পারি না। খুলনা থেকে আসা বইশেল (বড়শির জেলে) ওমর কাকা বলছিলেন কথাগুলো। বললেন, আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে এক একটা মাছ পাই। সেই মাছ যদি ডাকাতে নিয়ে যায়, সেটা সহ্য করা যায়?
কোন ডাকাত বাহিনী আপনার মাছ নিলো? কবে নিলো? বললেন, এই গোনেই তো নিলো। বলতে বলতে মাছ রাখার পাত্র বের করলেন কাকা। বললেন, না হলেও পাঁচ কেজি গলদা ধরছিলাম। সুমন বাহিনী আসছিলো ওই হরমল খালের গোঁড়ায়। আমি তখন এশার নামাজটা পড়েও পারিনি।
চোখে পানি নাই প্রবীন ওই জেলের। কিন্তু সেই চোখের কান্না আর জ্বালা অনুভব করছিলাম। বললাম, টাকা দেয়নি? বললেন, ৪০ বছর জঙ্গল করি। অনেক ডাকাত পার্টি দেখছি। মাছ নেয় না তারা। নিলেও একটা দাম ধরে দেয়। কিন্তু ইদানিং কিছু ডাকাত দল আসছে যারা কোনো কথাই শোনে না। দেখা হলে যা পায় তাই নিয়ে যায়। বাজার সদাগুলোও রাখে না। ওমর কাকা বললেন, এই যে এতো ডাকাত ক্রসফায়ারে মরে, তাও তো দেখি জঙ্গলের ডাকাত কমে না। কমে তো না, মনে হয় বাড়তেই আছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।
এমনিতে আজকের সারেন্ডার অনুষ্ঠান হবে কী না জানি না। তার ওপর তিন রাত জেগে আছি। শরীর মন দুটোই ক্লান্ত। ভেবেছিলাম মাছ ধরা দেখতে দেখতে মনটা শান্ত করবো। কিন্তু ওই কাকার কথা শুনে মন হাল্কা করা যায়? আরও খারাপ হয়ে গেলো। মনে হচ্ছিলো, আমি কী নিয়ে দৌড়াচ্ছি? কেন দৌড়াচ্ছি? এই পরিশ্রম কী কাজে আসবে শেষ পর্যন্ত?
পাশেই ট্রলার বাঁধা বাইন গাছের সাথে। একদম জঙ্গলের সাথে লাগানো। বললাম, সবাই সতর্ক থাকবেন। এখানে বাঘের চাপ আছে মনে হয়। সাথে সাথে ওমর কাকা বললেন, এই বাদায় মামার চাপ সব সময় বেশি। তবে লোক উঠায় না। ভাটা হলে দেখবেন পুরো চর ধরে পায়ের ছাপ। মামা (বাঘ) আশে পাশেই আছে। ট্রলার থেকে বেলায়েত সরদার বললেন, ও ভাই, আপনার ফোন আসছে। জঙ্গলের ওই জায়গায় দেখলাম নেটওয়ার্ক ভালোই পাচ্ছে। সরদার বললেন, একটা নাম্বার থেকে ফোন আসতেই আছে। একটু কথা বলেন। না হলে এই লোকের দম বন্ধ হয়ে যাবে। পরে ফোন না ধরার অপরাধে মার্ডার কেস খাবেন।
ওমর কাকার কাছে থেকে বিদায় নিলাম। বললাম, আপনার ওই পাঁচ কেজি গলদা চিংড়ির দাম আমি আদায় করে দিবো। ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললেন, আপনারা প্রশাসনের লোক। অনেক কিছুই করতে পারেন। চাইলে লাখ টাকা দিতেও পারেন। কিন্তু আমার ওই টাকার দরকার নাই। জানি উনি আমার কথাটিকে কথার কথা ভাববেন। কিন্তু আমি জানি, ওই ডাকাত দলই কোনো একদিন পাঁচ কেজি গলদার দাম দিবে, সাথে জরিমানাও দিবে।
ওমর কাকা মনে হয় আমাকে ভালোবাসলেন। মাছ ধরা রেখে নৌকা বেয়ে পৌঁছে দিলেন ট্রলারে। কয়েক ফুটের পথ। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই বললেন, মাছ কয়টা নিলে খুশি হতাম। বললাম, যেদিন ওই ডাকাত দল আপনার মাছের দাম দিবে সেদিন নিবো কাকা। ট্রলার থেকে কয়েকটা পানির বোতল আর একটু চাল-ডাল দিয়ে বিদায় দিলাম। ওমর কাকা আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। বললাম, সাংবাদিক। বাদায় (সুন্দরবন) কি বেড়াতে আসছেন? বললাম, না কাকু, একটা কাজে আসছি।
ফোন এসেছে অনেকগুলো। বিবিসি বাংলা’র সাংবাদিক আহরার হোসেনকে ফিরতি ফোন করলাম। মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণ নিয়ে আমার মন্তব্য জানালাম। এরপর ফোন করলাম, ঢাকার একজন সিনিয়র অপরাধ সাংবাদিক। বললেন, আপনি একা গেছেন সারেন্ডার অনুষ্ঠানে? মানে RAB শুধু আপনাকে নিয়ে গেছে? বললাম, না ভাই। আমি আমার মতো আসছি। ওই সাংবাদিক ভাই নেতিবাচক ভাবনা ভাবছেন। কথা না বাড়িয়ে ফোন রাখলাম। এর মধ্যে কোস্টগার্ড এর জোনাল কমান্ডার ফোন দিলেন। বললেন, আমাকে জানালেন না? বললাম, আপনাকেই তো প্রথম জানালাম ভাই। আপনি সাড়া দিলেন না। মন খারাপ করে ফোন রাখলেন। আরও কয়েকটা ফোন করলাম। কথা হলো আমার পরিবারের সাথে। একটু বিশ্রাম নিবো ভাবলাম কিন্তু হলো না। লঞ্চ থেকে একজন ইশারা করলেন। ট্রলার ভাসিয়ে পৌঁছে গেলাম সেখানে।
মেজর আদনান বললেন, বিপদ হয়ে গেলো ভাই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজ আর আসবেন না। সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত। আবারও জিজ্ঞেস করলাম, সারেন্ডার হবে তো? আসলে RAB এর মতো একটি বড় প্রতিষ্ঠানে তিনি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, বেশ জুনিয়রও। নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত তিনি নেন না। শুধু বললেন, স্যররা বলেছেন, অনুষ্ঠান হবে, তবে কবে হবে সেটা নিশ্চিত করেননি। বললাম সমস্যা কি শুধু আবহাওয়া? বললেন, জ্বি ভাই, আবহাওয়া ভালো হলে কাল বা পরশু অনুষ্ঠানটি হবে।
সিদ্ধান্তটি কি মাস্টার ভাইদের জানানো হয়েছে? বললেন, কথা হয়েছে তাঁর সাথে। মাস্টার বাহিনীর সদস্যদের কাছে গেলাম। বললাম, দুশ্চিন্তা হচ্ছে? উনারা বললেন, আমরা কথা রেখেছি। বাঁকীটা আপনাদের দায়িত্ব। এখন যদি জেলখানায় দেন, মেরেও ফেলেন তাও আমাদের মনে কোনো দুঃখ থাকবে না। বললাম, আবাহওয়ার জন্য সময়টা হেরফের হচ্ছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন।
মনের মধ্যে শংকা নিয়ে বের হলাম। শেষ পর্যন্ত আজ সারেন্ডার হচ্ছেই না। দস্যুদের নিয়ে RAB এখন কী করবে? আমিই বা কী করবো? সকাল থেকে সংবাদ যাচ্ছে। আমরা বলছি যে আজ ২৯ মে ২০১৬ তারিখ সকালে মংলায় আত্মসমর্পণ করবে মাস্টার বাহিনী। সেটা বদলে লিখলাম, অনিবার্য কারণে স্থগিত জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান!