রূপান্তরের গল্প ১২৫ | Rupantorer Golpo 125

বনদস্যুরা তখন গায়ে গায়ে বাড়ি খায়! | রূপান্তরের গল্প ১২৫

বনদস্যুরা তখন গায়ে গায়ে বাড়ি খায়! | রূপান্তরের গল্প ১২৫ | Rupantorer Golpo 125 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১২৫ : লবণ পানির চা খেতে খেতে বললাম ওই লোকটাকে চিনেন? মাস্টারকে দেখালাম। ওমর কাকা বললেন চোখে তো ভালো দেখি না কাকা। তারপর ভালো করে দেখে বললেন, RAB দেখা যায়। বললাম, পাশে ছোট করে লোকটাকে চিনেন? বললেন, হবে কোনো চোর-ডাকাত। বললাম, মাস্টার বাহিনীর নাম শুনেছেন? ওই লোকটা হলো মাস্টার। বললেন, ওই লোকের নাম তো মোস্ত। এবার চিনছি। ওরা তো বড় পার্টি কাকা। বললাম, বড়ই তো। কিন্তু পূর্ব বাদায় কম আসে তারা। পশ্চিম সুন্দরবন আর সাগরে ডাকাতি করে।

তো ওরা কী করে এখানে? কাকা জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, ওই বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। RAB তাদের নিয়ে যাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। কেমন হবে? বললেন, সারেন্ডার করলে তো খুব ভালো। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু কয়জনকে ফিরাবেন? সবাই তো আর সারেন্ডার করবে না। বললাম, সারেন্ডার করবে কাকা। সবাই করবে। বললেন, সবাই সারেন্ডার করলে ভালো। কিন্তু আপনি কাজ চালায়ে যান। বললেন, গোন শুরু হলো, একাদশী পড়ে গেছে। তাই পানির চাপ বেড়েছে, স্রোত বেড়েছে। অমাবশ্যার গোন। পানি বাড়বে অনেক। এর মধ্যে আমার মাছ ধরতে হবে।

হাড়বাড়িয়া তো বিষ দিয়ে শেষ করে ফেলছে। একটু নিচের দিকে গেলে মনে হয় মাছ পাবো। বললাম, বইশেল জাহাঙ্গীর নামে এক কুখ্যাত ডাকাত ছিলো সুন্দরবনে। নুরাবি ডাকাতের গল্পও শুনি। আবার কবিরাজ ডাকাতের নাম শুনেছি অনেক। আপনি দেখেছেন এদের? তিন জনই অনেক পুরানো দস্যু। মারাও গেছে তারা এই জঙ্গলেই।

দেখিনি আবার! ওমর কাকা বলতে শুরু করলেন। নুরাবি (নূর হাবিব) খুব সৌখিন ডাকাত ছিলো। সাদা লুঙ্গি পড়তো সব সময়। কিছু বদ অভ্যাস ছিলো। জুয়া খেলতো খুব। জঙ্গলে ওই চরাপুটিয়ার ঠোঁটায়, বড় নদীর ধারে ধারে থাকতো। সদস্যদের নিয়ে তাশ খেলতো। আমাদের কাছে তার তেমন কোনো দাবি দাওয়াও ছিলো না। যা দিতো জেলেরা তাই নিয়ে খুশি ছিলো সে। একবার ওই পশুরের বাওনে পূর্ব সুন্দরবনে ফোন করতে গাছে উঠছিলো। তখন নিচ থেকে তার সদস্যদের একজন গুলি করে মারে তাকে। মাটিও নাকি জঙ্গলেই দিছিলো। নিজের লোকই তার সাথে বেঈমানী করে।

কবিরাজ ডাকাতকে ধরছিলো রামপাল খাল দিয়ে পালানোর সময়। বাড়ি আসছিলো। পরে পুলিশ জেনে যায়। বাড়িতে অভিযান চালায়। কবিরাজের বাড়ি ছিলো খালের পাড়ে। ধাওয়া খেয়ে মেয়েকে সাথে নিয়ে ট্রলারে ওঠে। পালানোর সময় ধরা পড়ছিলো নিচের দিকে গিয়ে। আর বইশেল জাহাঙ্গীর ছিলো বিরাট হিংশ্র ডাকাত। দুবলার চরে হরিণ শিকারে গিয়ে বাঘের হাতে মারা পড়ে সে।

গল্প করলে শেষ হবে না কাকা। ভাটি দিয়ে চরাপুঁটিয়া যাবো। লম্বা পথ। পশুরের বাওনে বড়শি ফেলবো। আশা করি মাছ হবেনে। বললাম, এই মাছ বিক্রি করবেন কোথায়? বললেন, জয়মনির এক মহাজন আছে আমার। তার কাছে জমা দিবো। সে একটা দাম ধরে দিবে। বললাম, নিজে গিয়ে আড়তে বেঁচতে পারেন না মাছ? বললেন, সে কাজ করতে গেলে মাছ নিয়ে আর ডাঙ্গায় ওঠা হবে না। মহাজনদের সাথে ডাকাতদের ডাইরেক্ট কানেকশন। ট্রলার থেকে নৌকা খুলে রওনা হলেন ওমর কাকা। উঠে বসলাম নৌকায়। বললাম, ওই দোয়ায় নোঙ্গর করা লঞ্চটিতে উঠে দিয়ে যান।

অনেক ক্ষণ পর ফিরলাম বনদস্যু মাস্টার বাহিনীর কাছে। মেজর আদনান তখন সম্ভবত বিশ্রামে। মোস্তাফিজ মামা আমাকে হাত ধরে তুলে নিলেন লঞ্চ-এ। জলদস্যুদের চেহারায় তখন কোনো আতঙ্ক নাই। মনে হচ্ছিলো নতুন জীবনের ব্যাপারে নিশ্চিত সবাই। কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ বসে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলছে স্বজনদের সাথে, আবার কেউ রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সুন্দরবন দেখছে। মাস্টারকে বললাম, সুন্দরবন দেখা শেষ হয়নি?

লবণ পানিতে আর আসবো না ভাই। শেষ দেখা দেখে যাই। সারেন্ডারের পর বাড়ি ফিরে কী করবেন? সংসার চালাবেন কী করে? সরকার বা RAB আপনাদের জন্য কী করবে জানি না। মাস্টার বললো, আর কিছু না পারলে রিক্সা-ভ্যান চালাবো। বললাম, এতো বড় দস্যুনেতা ভ্যান চালাবে, কেমন লাগবে ভাই? পারবেন? মাস্টার বললো, এই জীবন যারা দেখে গেছে তারা না খেয়ে থাকলেও দস্যুতায় আর ফিরবে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প হলো লম্বা সময়। তখন শুনলাম কী ভাবে মাস্টার বাহিনী গড়ে উঠেছিলো। বললো, দলের মধ্যে বিদ্রোহ, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে এই দস্যুদলের জন্ম। এক বছরও হয়নি। তবে ডাকাতি করার জন্য না। আত্মসমর্পণ করার জন্য বিদ্রোহটা করছিলাম আমরা। আমিসহ ছয়জন ছিলাম সেই বিদ্রোহ-যুদ্ধের পরিকল্পনায়। এবার রয়ে সয়ে শুনবো সেই গল্প।

সুন্দরবনের দস্যু জগতে রক্তপাতের ইতিহাস আছে। অনেক বেশি বলা যাবে না। কিন্তু ঘটেছে। বনদস্যুদের টার্গেট জেলেরা। তবে তাদের হাতে সাধারণ জেলে খুণ হয়েছে খুব কম। সেটিও টার্গেট করে না, গোলাগুলির মধ্যে পড়ে। বন্দুক যুদ্ধ হতো বড় দস্যুদলগুলোর মধ্যে। কখনও ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করতো তারা। কখনও অ্যামবুশ করে। কয়েকটি অ্যামবুশের নায়ক আবার মোস্তফা শেখ অর্থাৎ মাস্টার।

পানিতে ডুব দিয়ে নি:শব্দে প্রতিপক্ষের ট্রলারে উঠে পড়ার দুর্দান্ত কৌশল জানতো সে। আবার কোনো ফরেস্ট অফিসে প্রতিপক্ষ দস্যুদল বিশ্রাম নিচ্ছে। খবর এসেছে কোনো খালের আগায় গা ঢাকা দিয়েছে কোনো বাহিনী। জঙ্গল দিয়ে হেঁটে নি:শব্দে সেখানে পৌঁছে যাওয়া ছিলো মাস্টারের কাছে সহজ কাজ। বন্দুক চালানোয় দক্ষতা, লক্ষ্যভেদী নিশানা এই দস্যুনেতাকে করেছিলো অপ্রতিরোধ্য। ইলিশ মৌসুমে উত্তাল বঙ্গোপসাগরেও জলদস্যু মাস্টার ছিলো মূর্তিমান আতঙ্ক! আজ সেই ভয়ঙ্কর বনদস্যুকে চিনতে পারছি না একদম।

আরেকটি বড়শির নৌকা ছিলো সেখানে। ভাটার টানে নৌকা ভাসিয়েছে তারা। হরমল, বজবজা হয়ে তারা যাবে চাত্রী খালে। সুন্দরবনের ওই অঞ্চলে তখন বনদস্যু গায়ে গায়ে বাড়ি খায়!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top