রূপান্তরের গল্প ১২৭ | Rupantorer Golpo 127

মোস্ত থেকে দস্যুনেতা মাস্টার! গড়ে উঠলো দুর্ধর্ষ দস্যুবাহিনী | রূপান্তরের গল্প ১২৭

মোস্ত থেকে দস্যুনেতা মাস্টার! গড়ে উঠলো দুর্ধর্ষ দস্যুবাহিনী | রূপান্তরের গল্প ১২৭ | Rupantorer Golpo 127 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১২৭ : মাস্টার বাহিনী নামে সুন্দরবনে কোনো দস্যুদল নাই। এটা সাজানো। RAB আর ওই সাংবাদিক মিলে পুরস্কার নেয়ার জন্য নাটক সাজিয়েছে… একটি মহলের মুখে মুখে চলছে এমন কথাবার্তা। সুন্দরবনে বসে সেই অপপ্রচারের আঁচ পাচ্ছিলাম। একই সঙ্গে টাকা পয়সার লেনদেন নিয়ে অপপ্রচার তো আছেই। এদিকে সংবাদ প্রচার নিয়ে চাপ তো ছিলোই। অনুভব করছিলাম, আমার নামটা যাতে কিছুতেই প্রকাশ না পায় তার জন্য সব রকমের চেষ্টাই ছিলো। ওসব নিয়ে ভাবার সময় নাই। সামনে আবারও অপেক্ষা, পথ এখনও মসৃণ না। অবশ্য আত্মসমর্পণের দিন-ক্ষণ চুড়ান্ত জেনে চাপ কমেছে। বনদস্যুরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

নোঙ্গর তুলতে গিয়ে দেখি সরদারের ট্রলার আটকে গেছে চর-এ। ভাটার সময় খেয়াল না করেনি বলে বিপত্তিতে পড়তে হলো। কাঁদার মধ্যে গেঁথে গেছে এক পাশ। কিছুতেই নামছে না। এখনই ট্রলারটি ভাসাতে না পারলে এখানেই আটকে থাকতে হবে কয়েক ঘন্টা। ট্রলারের সবাই নেমে পড়লো কাঁদায়। একটু সময় লাগবে। লঞ্চ-এর রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে চা চাইলাম।

দস্যু জগৎ ও সুন্দরবন ভিত্তিক ব্যবসায়ী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মাস্টার বাহিনী নতুন নাম। দস্যু দলগুলো জঙ্গলের ভিতরে থাকলে তাদের প্রকৃত খবর পাওয়া বেশ কঠিন। সঠিক খবর কোনো সোর্স এর মাধ্যমে পাওয়াও সহজ না। আমার কাছে সঠিক খবর ছিলো কারণ ওই দস্যুনেতা আমার পূর্ব পরিচিতি, সম্পর্কও আস্থার। সেই সম্পর্ক থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার হাত ধরে আত্মসমর্পণ করছে তারা। এই দস্যুদলটি গড়ে ওঠার গল্পটি অন্য রকম।

আজকের সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুনেতা মোস্তফা শেখ। অথচ তিনি ছিলেন রাজু বাহিনীর সাধারণ সদস্য। ২০১১ সালে সেখানেই পরিচয়। তারপর যোগাযোগ রয়ে যায়। ২০১৩ সালে দস্যুতা ছেড়ে বাড়ি চলে যান তিনি। সেবার রামপালের কাটালিবাজারে থাকতে পারেননি। ভালো হতে দেয়নি কেউ। তারপর আবার বনে ফিরে আসেন। যোগ দেন নোয়া বাহিনীতে। নোয়া বাহিনীর সাধারণ সদস্য তখন মোস্তফা শেখ।

লঞ্চ-এর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মাস্টার গল্প করছেন। বললেন, পরের বার দস্যুতায় গেছি সারেন্ডারের উদ্দেশ্য নিয়ে। আমরা ছয়জন গোপনে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি, সোহাগ, ফজলু, সুলতান কাকা, সুমন আর সোলাইমান। নোয়া মিয়া দস্যুনেতা হলেও পলাতক রাজু’র কথা মতো দল চালাতো। ওই বাহিনীতে পশ্চিম সুন্দরবনের আরেক ত্রাস আলিফও ভিড়েছে তার কয়েকজন সদস্য ও অস্ত্র নিয়ে।

তখন ইলিশের মৌসুম। ২০১৫ সালের বর্ষাকাল। উত্তাল সাগরে গিয়ে বড় বড় ফিশিং ট্রলারে হামলা চালাতাম আমরা। এক কোপ-এ কখনও ৬০/৭০ জন জেলে জিম্মি করতাম। একসাথে বেশ কয়েকটি ট্রলারও ধরে এনেছি আমরা। দুই দফা সাগরের দস্যুতায় কয়েক কোটি টাকা আয় করলো নোয়া মিয়া। সেই টাকার বড় অংশ পাঠিয়ে দিলো রাজু’র কাছে। আমাদের মানে সদস্যদের দেয়া হলো নাম মাত্র কিছু টাকা। মাস্টার বললেন, সাগরে গিয়ে ডাকাতি করতাম আমরা। আর বসে বসে সেই টাকা খেয়ে ফেলতো লিডাররা।

তখন শ্রাবণ মাস। সাগর উত্তাল। তার মধ্যেই জেলেরা নেমেছে বঙ্গোপসাগরে। আর এই সময়ে সাগরে একটা কোপ দেওয়া মানে কোটি টাকার ওপর বাণিজ্য। আলিফের নেতৃত্বে রওনা দেয় দস্যুদের একটি দল। সেই দলের সদস্য মোস্তফা শেখ (মাস্টার) সহ সেই ছয়জন। সাগরে নেমে বৈরী আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে সুন্দরবনে ফিরে আসে তারা। সেই খবর নোয়া মিয়াকে ফোনে জানাতে একটি গাছের মগডালে ওঠে আলিফ। সেই সুযোগে দলের অন্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মাস্টার, সোহাগরা। ফোনে কথা বলে নামার পর কেড়ে নেওয়া হয় তার অস্ত্র। আলিফও জিম্মি তাদের কাছে। এরপর ট্রলার ছুটলো বনের আরও গহীনে।

ওরা জানতো কোথায় আছে তাদের দলের অন্যরা। নোয়া মিয়ার নেতৃত্বে সেই ট্রলারটিতে আক্রমণ চালায় মাস্টাররা। গোলাগুলিতে মৃত্যু হয় একজনের। রাঙ্গা নামের এক দস্যুর একটি হাত নষ্ট হয় গুলিতে। নোয়া মিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে। কোনো রকমে জীবন বাঁচে সে যাত্রায়। অবশিষ্ট দস্যুদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করা হয়। পুরো দলটি তখন মাস্টারের নেতৃত্বে।

তারপর কী করলেন? মাস্টারের কাছে প্রশ্ন করতেই বললেন, আমাদের ছয়জন ছাড়া বাঁকী সবাইকে তুলে দেই লোকালয়ে। পুরো পরিস্থিতিতি নিয়ন্ত্রণে এনেই আপনাকে ফোন দেই। সেদিন বিকালে ফোনে মাস্টার বলেছিলেন, এবার পুরো দল আমার নিয়ন্ত্রণে। আমরা সারেন্ডার করবো। আপনি সরকারের সাথে কথা বলেন। এই দস্যুদের আত্মসমর্পণের লক্ষ্য নিয়ে সেই থেকে নতুন করে কাজ শুরু আমার। নোয়া বাহিনীর অস্ত্রগুলোর মালিক তখন এই মাস্টাররা।

জিজ্ঞেস করলাম, পড়াশোনা করেছেন কোন পর্যন্ত। মাস্টার বললেন, স্কুলের বারান্দা দিয়েও হাঁটেননি। তাহলে আপনাকে সবাই মাস্টার বলে ডাকে কেন? বললেন, আমি হলাম বন্দুক যুদ্ধের মাস্টার, এই জঙ্গল-জলায় অ্যামবুশ মাস্টার। আমার গুলি করার নিরিখও খুব ভালো। আমার আচরণও নাকী মাস্টার সাহেবদের মতো। সেজন্য দস্যু জগতে আমার নাম মাস্টার। কেউ ডাকে কাদের মাস্টার। আবার চোখে কম দেখি বলে কেউ ডাকে কানা কাদের। তার মানে ডাকতে ডাকতেই আপনার নাম মাস্টার হয়ে গেছে? বললেন, সেই থেকেই মাস্টার বাহিনী। লিডার আমি হলেও এই দলের সমান অংশীদার আমরা ছয়জন।

মাস্টারসহ সেই ছয়জন আছে সারেন্ডারের দলে। সাথে যোগ দিয়েছে আরও তিনজন। চুড়ান্ত অনুষ্ঠান হতে আরও একদিন বাঁকী। মাস্টারকে বললাম, এর মধ্যে আরও কেউ যদি সারেন্ডার করতে চায় তাদের আসতে বলেন। আমি একটু মংলা যাই। কয়েক ঘন্টার একটা ঘুম না দিলে আর বাঁচবো না।

RAB এর লঞ্চ-এ বসে গল্প করছিলাম। ততোক্ষণে চা-এর কাপ খালি হলো। ওদিকে হাড়বাড়িয়ার দোয়ায় চরে আটকে যাওয়া বেলায়েত সরদারের ট্রলারটিও ভেসেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top