ঝুঁকি বাড়ছে, পথ আরও কঠিন হচ্ছে! | রূপান্তরের গল্প ১২৮ | Rupantorer Golpo 128 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১২৮ : ভাটায় আটকে যাওয়া নৌকা নামানো বেশ সহজ, একজনের কাজ। কিন্তু কাঁদায় আটকে যাওয়া ট্রলার ভাসানো সহজ না। ভাটার সময় হলে সেই কাজ অনেক বেশি কঠিন। বেলায়েত সরদারসহ চারজন মিলে ঠেলে নামালেন ট্রলার। হাড়বাড়িয়াসহ সুন্দরবনের এই অঞ্চলে পানি বা জঙ্গলে নামা বেশ ঝুঁকির কাজ। কিন্তু কখনও কখনও প্রয়োজনে ঝুঁকি নিতে হয়। এই যেমন আমরা রওনা দিবো ঠিক করেছি। ট্রলারটি নামাতে না পারলে আমাদের অন্তত চার ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু শরীর ও মন এতো ক্লান্ত যে ওউ গরমের মধ্যে জঙ্গলের ভিতরে আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন ৩১ মে সকালে। দুই দিন অপেক্ষা করতে হবে। আমরা থাকবে মংলাতেই। বনদস্যুরা থাকবে জঙ্গলের মধ্যেই। ট্রলার ছাড়লো। বড় নদীতে উঠে দেখি তখনও ভাটা চলছে। অমাবশ্যার গোন বলে স্রোত অনেক বেশি। উজান ঠেলে মংলা যেতে কষ্ট হবে। তাই পশুর নদীতে হাড়বাড়িয়ার মুখে নোঙ্গর ফেললাম। ঘন্টা খানেক পর স্রোত একটু কমলে রওনা দিবো আমরা।
এতোক্ষণ সময় তাহলে কী করবো? বড়শি বের করলাম। হাড়বাড়িয়া খালের মুখে মাছ ধরতে বসে পড়লাম। ওদিকে ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করতেই শুরু হলো বেলায়েত সরদারের হাঁকডাক। দুপুরের রান্না হবে ট্রলালের রান্নাঘরে। যথারীতি বাবুর্চি বেলায়েত সরদার।
ট্রলারের ভিতরে কয়েকটি হাঁস-মুরগি রাখা। দুপুরে খিচুরি আর মুরগি রান্না হবে। এই সময়টুকু কাটাতে বড়শি বের করলাম। বড়ফের বাক্স থেকে চিংড়ি মাছ বের করে বসে পড়লাম গলুই-এ। মামুনকে বললাম, মাছ পেলে কী করবো? সে বললো, মাছ ধরেন তো আগে। ধরতে পারলে নগদে ভেজে ফেলবো। বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে মাছ ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। সুন্দরবনের যেখানে সেখানে, যখন তখন বসলে মাছ ধরা যায় না।
রান্না হলো। সেখানে বসে দুপুরের খাবার খেলাম। এরই মধ্যে ভাটা প্রায় শেষ। নরম হয়ে এসেছে স্রোত। ট্রলার ছেড়ে সোজা মংলা। উপজেলা সদরের একটি হোটেলে উঠলাম। গোসল সেরে ফোনগুলো সব বন্ধ করে দিলাম লম্বা ঘুম।
ঘুম ভাঙ্গলো সন্ধ্যার পর। উঠে দেখি অন্তত ১৫/২০ জন মানুষ অপেক্ষা করছে। তাদের কেউ সাংবাদিক, কেউ মাছ ব্যবসায়ী কেউ বা আমার সোর্স। প্রত্যকের চোখে হাজারও প্রশ্ন। আসলে কী হলো? কী হতে যাচ্ছে? বললাম, দুশ্চিন্তার কিছু নাই। সাংবাদিকরা সংবাদ করতে পারেন। মন্ত্রীর কর্মসূচির কথা জানালাম, বললাম জলদস্যুদের সংখ্যা বলবো না। তবে তারা RAB হেফাজতে আছে নিশ্চিত।
মংলার আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, সেখানে দায়িত্বরত বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীলরা সশরীরে খোঁজ নিতে আসছেন। সবাইকে বিদায় দিয়ে আবারও ঘুম দিবো। তিন রাতের ঘুম ফেরত চাইছে শরীর।
পরদিন অর্থাৎ ৩০ মে হাতে কোনো কাজ নাই। সারাদিন ঘুরে বেড়ালাম মংলার চিলা, জয়মনিরঘোল, বৈদ্যমারী, উলুবুনিয়া আর সুন্দরবন ইউনিয়নে। সন্ধ্যায় মংলা ফিরে আড্ডা-গল্পে বসলাম। আমার সোর্সদের সাথে কথাবার্তা চললো গভীর রাত পর্যন্ত। জানলাম, শহরের সান্ডিকেটের ভিতরে তোলপাড় চলছে। অবৈধ অস্ত্রের কারবারীরা বেশ উদ্বিগ্ন। যারা মাস্টার বাহিনীর মতো সাগরে দস্যুতা করতে সহায়তা করে, ট্রলার ভাড়া দেয়, অস্ত্র-গুলি পৌঁছে দেয় তাদের মাথা ব্যাথা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে যারা মাস্টার বাহিনীকে সরাসরি সহযোগিতা করতো তাদের ঘুম হারাম।
রাতের দিকে একজন দেখা করতে আসলেন। পরিচয় দিলেন সাংবাদিক। কোন প্রতিষ্ঠান জিজ্ঞেস করার পর বললেন তিনি একজন ব্যবসায়ী। কীসের ব্যবসা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, প্রশাসনের লোক। কোন প্রশাসন জানতে চাইলে বললেন, পুলিশ, RAB, কোস্টগার্ড এর সাথে কাজ করেন। বললাম, সোর্স আপনি? বললেন, তিনি আমার শুভাকাঙ্খী। তারপর একটি ফোন এসেছে বলে বেরিয়ে গেলেন। আর আসলেন না। ওই রাতে আমার হোটেলের নিচে এমন রহস্যজনক কিছু মানুষের আনাগোণা দেখছি। সহকর্মীদের বললাম, দরজা লাগিয়ে ঘুম দিন সবাই। কাল সকালে আবার কাজে নামতে হবে।
রাত ১২টার দিকে ফোন খুললাম। অফিসে, বাসায় কথা হলো। এর মধ্যে বনদস্যু জাহাঙ্গীরের ফোন ঢুকলো আবার। বেশ কর্কষ কন্ঠে বলছিলেন, আপনার কারণে প্রতিশোধ নিতে পারলাম না। আবারও বললাম, আপনারাও সারেন্ডার করেন। তিনি বললেন, এই পৃথিবীতে তাকে সারেন্ডার করানোর ক্ষমতা কারও নাই। বললেন, জাহাঙ্গীর বাহিনীকে টেক্কা দেওয়ার মতো কোনো দস্যুদল এই জঙ্গলে নাই।
বললাম, এভাবে চললে তো মারা পড়বেন। আপনার দুইজন স্ত্রী, বড় ঘরের সন্তানরা খুব দুশ্চিন্তা করে। আপনার মেয়ের জামাই হান্নান আপনার সাথে ডাকাতি করছে। সেই মেয়েও চায় তার স্বামী বাড়ি ফিরুক। ছোট স্ত্রী ময়না বেশ আনন্দে আছেন। তবে ওই ঘরে আপনার একটা ছেলে আছে। তার ভবিষ্যৎটাও দেখবেন না? জাহাঙ্গীর বললেন, সাগরে দস্যুতা করবো দুই বছর। কয়েক কোটি টাকা বানিয়ে তারপর চিন্তা করবো সারেন্ডার করবো কী না! বললাম, চলুক আপনার দস্যুতা। আমরাও দেখবো কতোদূর যেতে পারেন আপনি।
ফোন রাখার আগে জাহাঙ্গীর বললেন, দুই টাকার সাংবাদিক আপনি। আমার কিছুই করতে পারবেন না। আমি সব জায়গায় যোগাযোগ রাখি। অনেককে টাকা দেই, মাছ দেই, মধু দেই। আপনিও তো টাকা নিলেন কয়দিন আগে! আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, কবে, কী ভাবে, কতো টাকা নিলাম। জাহাঙ্গীর বললেন, মাস খানেক আগেই ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন আমার নামে। বললাম, কই টাকার বিষয়ে আমি তো কিছুই জানি না। জানলাম, মংলার বাসিন্দা আমার এক সোর্স তাকে বলেছে আমি নাকী অসুস্থ্য। হাসপাতালে ভর্তি। এই বলে আমার নামে টাকা নিয়েছে। আগেও নাকী ১০/২০ হাজার করে কয়েক দফা টাকা নিয়েছে একই ব্যক্তি।
জাহাঙ্গীরকে বললাম, আমি বেশ সুস্থ্য আছি আপনাদের দোয়ায়। হাসপাতালেও যাইনি অনেক বছর হলো। ওই লোক আপনাকে ধোঁকা দিয়েছে। তার কাছ থেকে টাকাগুলো ফেরত নিয়েন। ফোন রেখে ওই সোর্সকে ফোন দিলাম। বললাম, আমার নামে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে নেওয়া টাকাগুলো কালকেই ফেরত দিবেন।
বিছনায় শুয়ে ভাবছি, এই পথ অনেক বেশি জটিল। আরও ভেবে চিন্তে কাজ করতে হবে। সব দুশ্চিন্তা একপাশে সরিয়ে রেখে ঘুম দিলাম। সেই রাতেও বনদস্যুদের নিয়ে RAB-এর লঞ্চ ভাসছে সুন্দরবনের ভিতরে, হাড়বাড়িয়ায়।
(ছবিটি পাশাখালীতে তোলা। মাস্টার বাহিনীর অস্ত্রগুলো তখন গোছগাছ চলছিলো)