কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণে ছিলো না, কোথাও আসেনি নামটাও! | রূপান্তরের গল্প ১৩০ | Rupantorer Golpo 130 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৩০ : এটি সাধারণ ক্ষমা না। শর্তবিহীন আত্মসমর্পণ। কিন্তু ঝামেলা হলো যে এতোগুলো অস্ত্র দস্যুরা জমা দিলো, এর আইনগত প্রক্রিয়া কী? ভেবেছিলাম অস্ত্রগুলো পরিত্যাক্ত দেখিয়ে সারেন্ডার করা দস্যুদের একটু ছাড় দেওয়া হবে। কিন্তু জনসম্মুখে নিজ হাতে তারা অস্ত্র জমা দিলো। তাই মামলা একটা খেতেই হবে। বিকল্প কোনো সমাধান আসলো না। সারেন্ডার করা দস্যুদের নামে এখন একটি অস্ত্র মামলা হবে।
অনুষ্ঠান শেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চলে গেলেন। ফুয়েল জেটিতে আসা অন্যান্য কর্তা ব্যক্তিরাও ফিরে গেলেন। বরিশাল RAB এর কর্মকর্তারা শুধু থাকলেন। অস্ত্র-গুলিসহ মাস্টার বাহিনীর দস্যুদের এখন চালান দেওয়া হবে মংলা থানায়। সেই প্রস্তুতি চলছে। বনদস্যুরা বলছে, স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলাম, আবার মামলাও খাবো? কী উত্তর দিবো? আসলেই তো। অস্ত্রগুলো পরিত্যক্ত দেখালে তো বাড়তি একটা মামলা খেতে হয় না। আর অস্ত্র মামলাটি যদি বিচারে গড়ায় তাহলে তো যাবজ্জীবন হবে সবার। কর্মকর্তাদের বিকল্প খুঁজতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু না। সিদ্ধান্ত ওটাই।
কোনো কিছু যেন নিয়ন্ত্রণে নাই। এই পর্যায়ে এসে নিজেকে খুবই দুর্বল মনে হচ্ছে, অসহায় হয়ে পড়লা। মনে হলো, একটা দস্যুদল সারেন্ডার করেছে। তাদের দেখে অন্যরা উৎসাহিত হবে। এখন মাস্টারদের নামে অস্ত্র মামলা দিয়ে জেলখানায় পাঠালে সবাই ভাববে কী? কিন্তু এখন আমার আর কিছুই করার নাই। যা হচ্ছে তাই হবে। এই মামলা নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। কী করতে পারবো জানি না। দস্যুদের আত্মসমর্পণ, পুণর্বাসনের লক্ষ্য শুধু এদের বাঁচিয়ে দেওয়া না। এরা ফিরে আসলে বিপদ মুক্ত হবে বন উপকূলের ত্রিশ লাখ মানুষ, উপকূল সাগরের জেলেরা।
মাস্টারদের বললাম আপনাদের তো পুরনো মামলা আছে। সবগুলোতেই ওয়ারেন্ট। পলাতক আসামী হিসাবে হলেও জেলখানায় যেতে হবে। আপাতত থানা হয়ে জেলখানায় যান। আমি দেখি কী করা যায়! বললাম, একবারে বাড়ি ফিরলে প্রতিবেশিরা মেনে নিবে না আপনাদের। যাদের অত্যাচার করেছেন তারা তো প্রতিশোধ নিতে পারে। বরং কিছুদিন জেলখানা হয়ে বাড়ি ফেরা ভালো। এছাড়া রাজি না হয়েও উপায় নাই। বললাম, যে ২৫ লাখ টাকা ফেরত দিলাম ওটা খরচ করেন। থানা থেকে জেলখানা, কোর্ট-কাচারীতে অনেক খরচ। আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুদের নিয়ে যাওয়া হলো মংলা থানায়। অস্ত্র মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হলো।
অনুষ্ঠান শেষে অন্যরাও চলে যাচ্ছেন। কয়েকজন সাংবাদিক তখনও কাজে ব্যস্ত, সংবাদ পাঠাচ্ছেন যার যার প্রতিষ্ঠানে। গত দুই দিনের সমালোচনায় তাঁদের কয়েকজনও আছেন। সতর্ক হয়ে সবার সঙ্গে মিশলাম, গল্প করলাম। যাওয়ার সময় খুলনার এটিএন বাংলার সাংবাদিক হাবিব ভাই জড়িয়ে ধরলেন। বাহবা দিলেন।
RAB সদস্যরা প্যান্ডেল খুলছেন, চেয়ার-টেবিল গুছিয়ে ট্রাকে তুলছেন। গোছগাছ শেষ হলে উনারাও চলে যাবেন। পশুর নদীতে ভাসমান সেই ফুয়েল জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি ও আমার সহকর্মীরা। বায়েজীদ ইসলাম পলিন এক হাতে ক্যামেরা চালিয়ে ক্লান্ত, সাতক্ষীরার রাজীব, বাগেরহাটের ইয়ামীন ভাই, খুলনার সহকর্মীরা ও লাইভ সম্প্রচারের কাজে আসা সহকর্মীরা আছেন পাশে। ছিলেন আবু হোসাইন সুমন, নিজাম উদ্দীনসহ মংলার কয়েকজন সাংবাদিক। চিলা থেকে বেলায়েত সরদারসহ অন্যরাও এসেছেন সারেন্ডার অনুষ্ঠান দেখতে।
বেলায়েত সরদারও এসেছেন টিপটপ জামা কাপড় পড়ে। সাথে গ্রামের অনেকে। মংলার সোর্সরাও ছিলেন সেখানে। সবারই মন খারাপ। ঘুরেফিরে একটি কথাই আসলো, মোহসীন ভাইকে উনারা বসতেও দিলেন না, অনুষ্ঠানে কেউ উনার নামটাও উচ্চারণ করলেন না। আমি বললাম ব্যাপার না। নামটা খুব জরুরি না। কাজ হওয়াটা জরুরি। চলেন আজ আমরা পিকনিক করবো। সহযোগী, সহকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে একটু হৈ হুল্লোড় করতে হবে। বেলায়েত সরদারকে বললাম বাজার করতে হবে। সবাই মিলে উৎসব করবো নদীতে নেমে। একদিন বিশ্রাম নিয়ে ঢাকা ফিরবো।
বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের খবর বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করলো যমুনা টেলিভিশন। বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সাজানো হলো সংবাদ বুলেটিনগুলো। কিন্তু আর একটি টেলিভিশনেও এই সারেন্ডারটি নিয়ে গুরুত্ব দিলো না। কোনো রকমে প্রচার হলো সংবাত। সেখানে আমার মধ্যস্ততার কথা কেউ বললেন না, উচ্চারণও করলেন না। খবরগুলো ছিলো এমন যে বনের ভিতর দিয়ে RAB যাচ্ছিলো। এসময় জঙ্গল থেকে বের হয়ে এসে দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেছে দস্যুরা। আমি বুঝতে পারছিলাম, যেমন ভেবেছি তেমন হবে না। সেদিন দুই তিনজন টিভি সাংবাদিক আমার ইন্টারভিউ নিলেন। কিন্তু প্রচার হলো না। ভাবলাম টেলিভিশনগুলো হয়তো হিংসা করে দিচ্ছে না। অনলাইন ও পত্রিকাগুলো নিশ্চয়ই বিস্তারিত সংবাদটি দিবে।
মোবাইল ফোনে অনলাইন ঘেঁটে দেখলাম। না, কেউ না, একজনও না। কেউই এই সারেন্ডারে মধ্যস্ততাকারীর নাম নিলেন না। যমুনা টিভির বাইরে সেদিন শুধু বিবিসি বাংলা বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করে। বিবিসি রেডিও’র লন্ডন অফিস থেকে ফোন করে ইন্টারভিউ নেয়, যা প্রবাহ নামের সন্ধ্যার সংবাদ আয়োজনে প্রচারিত হয়। সেদিন আর একজন সাংবাদিক ফোন দিলেন। বাংলা ট্রিবিউনের হারুন ভাই। বললেন, ঢাকা ফিরলে একটা সাক্ষাৎকার নিবেন তিনি। সেদিন একটি শীর্ষ পত্রিকার সাংবাদিক আমার ইন্টারভিউ করলেন। রাতের বেলা ফোন করে আরও বিস্তারিত তথ্য নিলেন।
আমরা মংলা থেকে চিলা, জয়মনিরঘোলের দিকে রওনা দিলাম। রান্না-বান্না হলো। সবাই মিলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করলাম। বিকালে বন উপকূলে হেঁটে হেঁটে মানুষের সাথে কথা বললাম। বনদস্যুদের সারেন্ডারের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করলাম। প্রান্তিক মানুষেরা বললেন, জঙ্গলের ডাকাতেরা কষ্ট দেয়, কিন্তু মেরে ফেলে না। মারলে তো আমরা ভয়ে জঙ্গলে যাবো না। আমরা না গেলে ওরা খাবে কী? বরং ডাঙ্গার ডাকাতেরা আমাদের শেষ করে ফেললো। বললেন, জঙ্গলের ডাকাতের চেয়ে বড় সন্ত্রাসী সূদের কারবারীরা, বেশি কষ্ট দেয় দাদনের মহাজনেরা। মাথায় গেঁথে গেলো কথাগুলো। বুঝতে শুরু করলাম যে দস্যুমুক্ত সুন্দরবন হলেই বঞ্চনা কাটবে না এই জেলেদের। সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরা ও বিক্রি করার স্বাধীনতা এখানে নাই। সেটিই বড় বঞ্চনা।
সেই রাতে মংলা ফিরলাম। রাত কাটিয়ে সকাল সকাল রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে বসে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন পত্রিকা, অনলাইনের সংবাদ পড়লাম। টেভিশনের সংবাদগুলোও দেখলাম। কোথাও বনদস্যুদের সারেন্ডারের নেপথ্যের গল্প নাই। বিবিসি’র সংবাদে বিস্তারিত খবর না আসলে হয়তো দস্যুদের গডফাদারদের অপপ্রচারই সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতো। মানুষও বলতো, মাস্টার বাহিনীর কাছে থেকে দুই কোটি টাকা নিয়ে তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছি আমি। কিছু মাছ ব্যবসায়ী বলতো, পুরোটাই নাটক!
এরই মধ্যে মংলা থানা থেকে আদালত হয়ে বাগেরহাট কারাগারে প্রবেশ করেছে সারেন্ডার করা বনদস্যুরা। ফিরার পথে দেখা করবো তাদের সাথে। নিজেকে আশ্বস্ত করছিলাম এই ভেবে যে কেউ স্বীকৃতি দিক বা না দিক আমাকে দায়িত্বগুলো পালন করতে হবে। আর স্বীকৃতি একদিন আসবেই। যে যাই বলুক, বনজীবীরা একদিন ভালোবাসবে, লেগে থাকলে ভালোবাসবে দেশের মানুষ।
(নোট: এর মধ্য দিয়ে মাস্টার বাহিনীর গল্প শেষ হলো। আপনারা চাইলে পরের গল্পগুলো লিখবো। না চাইলে এখানেই ইতি টানবো। ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা।)