রূপান্তরের গল্প ১৩২ | Rupantorer Golpo 132

মজনুর পর ইলিয়াস, পুরো সুন্দরবনে সাড়া পড়ে গেছে! | রূপান্তরের গল্প ১৩২

মজনুর পর ইলিয়াস, পুরো সুন্দরবনে সাড়া পড়ে গেছে! | রূপান্তরের গল্প ১৩২ | Rupantorer Golpo 132 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim

রূপান্তরের গল্প ১৩২ : ভাগ্য সহায় হয় কাদের? জানি না। তবে আমার জীবনে ভাগ্যের প্রভাব খুব বেশি। টালমাটাল, উত্তাল আর অনিশ্চিত পথ চলায় আমার বেশি দূর এগুতে পারার কথা না। তবুও প্রথম ধাক্কাটি মনে হলো সামলে ফেলেছি। সুন্দরবন নিয়ে কাজটি কি তাহলে এখানে শেষ করবো? একটি দস্যুদলকে আত্মসমর্পণ করিয়েছি। একটি সফলতা এসেছে। সেটুকু নিয়ে ঘরে ফিরবো আমি? হয়তো একটি সংবাদ থেকে অনেকগুলো পুরস্কার আসবে। হয়তো কিছুই আসবে না। হয়তো মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা আর বিপথে যাবে না, আবার যেতেও পারে। এই সময়ে আমার কী করা উচিৎ?

পাটুরিয়া পার হয়ে মানিকগঞ্জের পথে দেখা আমাদের সহকর্মী খোরশেদ ভাই-এর সঙ্গে চা খেলাম। তারপর আবার রওনা। ঢাকা পৌঁছাতে আরও প্রায় তিন ঘন্টা। একটু রেস্ট নেই। ফোনটি পাশে রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে রাখলাম। এখন শুধু বিশ্রাম নিবো। সামনের পথটুকু কিছুতেই আর কথা বলবো না। গাড়ির সামনে চালকের পাশে বসা আমি। পিছনের সীটে সহকর্মী বায়েজিদ ইসলাম পলিমও ঘুম।

সাইলেন্ট করলেও ভাইব্রেশন তো বন্ধ করিনি। তাই একটা ফোন আসতেই তন্দ্রা কেটে গেলো। বিজাতীয় একটি নাম্বার থেকে ফোন। ধরলাম। ওপাশ থেকে সালাম দিলেন একজন। খুলনার ভাষা। খুব পরিচিত। ইলিয়াস? সেই দুর্ধর্ষ ডাকাত সরদার?

ইলিয়াসের সঙ্গে পরিচয় ২০১১ সালে। তখন তিনি রাজু বাহিনীর সদস্য। রাজু আত্মগোপনে যাওয়ার পর ওই দলের নেতা হয় শহীদুল। ক্রসফায়ারে মৃত্যু হয় তার। এরপর ২০১৩ সালে ওই বাহিনীর লিডার হন ইলিয়াস। ইলিয়াস বাহিনীর নামেই তখন কাঁপতো সুন্দরবন আর বঙ্গোপসাগর। বছর খানেক দস্যু দলের নেতৃত্ব দিয়ে ইলিয়াস আত্মগোপনে যান। কিন্তু সুন্দরবনের দস্যুদের পালিয়ে থাকা জীবন তো জীবন না। বিভীষিকার জীবন। ইলিয়াসের সাথে বেশ আগে কথা হতো। এক একবার এক এক নাম্বার থেকে ফোন আসতো।

বললাম, ও ভাই, কী খবর? ফাতেমা, আর ফাতেমার আম্মা কেমন আছে? বললেন, ওরা ভালো। কিন্তু আমি তো ভালো নাই। একবার প্রতিপক্ষের সাথে গোলাগুলির সময় মাথায় গুলি লাগছিলো। সেখানে সমস্যা করে। ডাক্তার দেখালাম, একটা অপারেশনও করলো। কিন্তু পলায়ে থাকবো না কি চিকিৎসা করাবো? তাই জঙ্গলেই ফিরে যাই বার বার। বললাম যেখানে পালিয়ে আছেন থেকে যান। ইলিয়াস আবার দস্যুতায় নামবে। বললাম অস্ত্র তো সব নোয়া মিয়াকে দিয়ে আসছেন।

না ভাই, মেশিন পত্র কিছু আছে। জঙ্গলে চাপানো আছে। খালি নামলেই হয়। বললাম, আবার দস্যুতা করতে নামবেন না। কয়দিন পালায়ে থাকেন। আমি দেখি কী করতে পারি। ইলিয়াস বললো, সারেন্ডারের সুযোগ আমাকে দিবেন? বললাম, সারেন্ডারই তো করবেন। তবে সেজন্য একটু ভাবতে দিবেন না আমাকে? আমি আর এই কাজে থাকবো কী না সেটাও নিশ্চিত না। ভেবে চিন্তে সিন্ধান্ত নিবো। এতো ঝামেলা আর নিতে পারছি না ভাই। আর আপনাদের তো সাধারণ ক্ষমা দিচ্ছে না সরকার। এটা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ। ওই যে দেখেন, মাস্টার বাহিনী এখন জেলখানায়।

ওরা তো বেঁচে আছে। কেউ তো তাদের পিছন থেকে তাড়াচ্ছে না ভাই। বলছিলেন ইলিয়াস। আমি বললাম, ওরা কবে জেল থেকে বের হবে জানি না। মামলাগুলো তাদের চালাতে হবে। পরে সরকার মামলাগুলো নিয়ে কিছু করবে কী না জানি না। তাই জেলে থাকবেন না পালায়ে থাকবেন সেটা ঠিক করেন। যাই করেন সুন্দরবনে আবার দস্যুতায় নামবেন না। যদি সুযোগ আসে, যদি আমি কাজ চালিয়ে যাই তাহলে এভাবেই সারেন্ডার করবেন আপনি। শুধু অস্ত্র আর গোলাবারুদগুলো বের করে দিবেন।

জিজ্ঞেস করলাম, রাজুর খবর কী? বললেন, যোগাযোগ নাই ভাই। মানে সম্পর্ক ভালো নাই। অথচ দস্যু সম্রাট রাজুর সবচেয়ে ঘনিষ্ট আর বিশ্বস্ত ছিলেন তিনি। রাজুর প্রস্থানের পর তার দলের দায়িত্বে ছিলো শহীদুল। অস্ত্রের মালিক রাজু। সেই হিসাবে আত্মগোপনে থেকেও দস্যুতার টাকার ৬০ শতাংশ রাজুকে পাঠাতে হতো। কিন্তু শহীদুল যখন আমার সাথে যোগাযোগ শুরু করে, যখন সারেন্ডারের আগ্রহ প্রকাশ করে তখন তাকে সরিয়ে দেয় রাজু। তার সাথে দেখা করতে গেলাম।

মংলায় পৌঁছেছি, পরদিন সুন্দরবনে ঢুকবো, এমন সময় শহীদুলকে বেঁধে ফেলা হয়। আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তারপর শহীদুলকে দল থেকে বের করে দেয় ইলিয়াসরা। শুধু তাই না, লোকালয়ে আসার পর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দেয়, ধরিয়ে দেয়। পরে এনকাউন্টারে মৃত্যু হয় শহীদুলের। তখন ইলিয়াস আসে নেতৃত্বে। বছর খানেক বেশ দাপটের সাথে দস্যুতা করে।

২০১৩ সালে তার আস্তানায় গেছি। শিবসার বাওনে নিশানখালীতে ছিলামও তিন দিন। ইলিয়াস ভাই, সেবার আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেন কেন? তখন রাজি জলে তো এতোদিনে সারেন্ডার করে বাড়ি ফিরতে পারতেন। বললেন, রাজু তা করতে দিলো না। আর ওপরের সাহেবরা তো কিছুতেই আত্মসমর্পণ করতে দিবে না। ওরাই তো বড় ডাকাত। আমরা জঙ্গলে থেকে ওদের জোন খাটি মানে দিনমজুরি খাটি। হা হা হা। হাসতে হাসতে বললাম, হাতে এইট শ্যুটার নিয়ে দিন মজুরি?

ইলিয়াসকে বললাম এবার একটা স্থায়ী ফোন নাম্বার থেকে আমাকে ফোন দিবেন। আগে আমি ভেবে দেখি যে আপনাদের সারেন্ডার নিয়ে কাজ করবো কী না। তারপর পরিবেশ পরিস্থিতি ঠিক থাকলে আপনিও সারেন্ডার করবেন। বললেন, সেজন্য জঙ্গলে নামতে হবে না? বললাম, এরপর নামলে আমার সাথে নামবেন। শুধু জঙ্গলে চাপানো অস্ত্রগুলো বের করে দিবেন।

মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর হতাশ হয়েছি নানা কারণে। এতো ঝুঁকি আর ঝক্কি নিয়ে কাজ করা যায়? তাই কী করবো কী করবো ভাবছি। প্রথমে মজনুর ফোন, তারপর ইলিয়াস! দুই প্রভাবশালী দস্যুনেতা। যাদের এক সময় খুঁজে বের করতেই লাগতো কয়েক মাস সময়, যাদের সঙ্গে কথা বলা গেলেও দেখা করা ছিলো অসম্ভব, সেই দুই দস্যুনেতা পর পর ফোন দিলো। দুজনই সারেন্ডার করতে চায়। ফোন দিলাম RAB এর গোয়েন্দা প্রধান লে কর্নেল আজাদ ভাইকে।

পুরো ঘটনা শুনে আজাদ ভাই বলে বসলেন, আপনাকে আমিও ছাড়বো না মোহসীন ভাই। বয়সে আমার থেকে ছোট হবেন। কিন্তু আপনার প্রতি আমার রেসপেক্ট বেড়ে গেছে অনেক। বললাম, আমি নাকী ভাই কোটি কোটি টাকা নিচ্ছি দস্যুদের কাছে থেকে? আপনাদের লোকজনই তো ছড়াচ্ছে। উনি বললেন, আপনি যে ২৫ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন সে কথা তো তারা জানে না। এখন জানবে, আর তাঁরা দেখবেন কী ভাবে সুন্দরবনে কাজ হয়, কী ভাবে কাজ করতে হয়।

গোয়েন্দা প্রধান বললেন, ইলিয়াসের মতো পটেনশিয়াল দস্যুনেতা বেঁচে থাকা মানেই ঝুঁকি। সে যেকোনো সময় জঙ্গলে নামলে একটা বাহিনী তৈরি হতে সময় লাগবে না। তাই ইলিয়াসকে নিষ্ক্রীয় করতে হবে। সেজন্য সারেন্ডার সবচেয়ে ভালো পথ। বললেন, আপনি এগিয়ে যান ভাই। ইলিয়াস বা মজনু এখনও আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওরা খুব চালাক ও সতর্ক। আপনিও সতর্ক থাকবেন। বিপদে না পড়েন।

ফোন রেখে বাসায় ফোন দিলাম। তারপর মেজর আদনানকে সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে মেসেজ দিলাম। বললাম, কথা আছে। কাল ফোন দিও।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top