জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরলো বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ১৩৪ | Rupantorer Golpo 134 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৩৪ : শুনানি হবে বাগেরহাট আদালতে। জামিন পেলে আপাতত বাড়ি ফিরবে মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডার করা জলদস্যুরা। ঢাকা থেকে রওনা হলাম সময় মিলিয়ে। পরিকল্পনা ছিলো জেলখানা থেকে মুক্তি পাওয়া থেকে তাদের বাড়িতে পৌঁছানো পর্যন্ত সময় পাশে থাকবো। গ্রামে পৌঁছানোর পর যাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রতিবেশীরা সহনশীল আচরণ করে সেজন্য কিছু কাজ করতে হবে। সবাইকে অনুরোধ করবো যাতে সারেন্ডার করা দস্যুদের একটু সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে। কারণ নিজেদের এলাকায় নির্বিঘ্নে বসবাস করতে না পারলে পুরো প্রক্রিয়া ব্যর্থ হবে।
জামিন শুনানির দিন চলে গেলাম বাগেরহাট আদালতে। যমুনা টিভি’র জেলা প্রতিনিধি ইয়ামীন ভাই আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। শুনানি শুরু হলো। আদালতের বাইরে অপেক্ষা করছি আমরা। আধা ঘন্টা পর জানলাম জামিন হয়নি। কী ব্যাপার? জামিন তো হওয়ার কথা! কিছুক্ষণের মধ্যে জানলাম যে জামিনের আবেদন করা হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট-এ। এই আদালতের তো অস্ত্র মামলায় জামিন দেওয়ার এখতিয়ারই নাই। তার মানে জজ আদালতে এখনও যায়নি মামলাটি? মামলার দেখভাল ঠিকঠাক হচ্ছে না। সাবেক দস্যুদের বুঝিয়ে বললাম, তাদের নেওয়া হলো কারাগারে। ইয়ামীন ভাইকে মামলাটি দেখভালের অনুরোধ করলাম। একটু হতাশা নিয়ো ফিরে যাবো ঢাকায়।
মাস্টার বাহিনীর বনদস্যুদের জামিন না হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লো দ্রুত গতিতে। পশ্চিম সুন্দরবন থেকে মজনুর ফোন আসলো। নোয়া মিয়ার সাথেও কথা হলো। তাদের মূল কথা, জামিনই যদি না হয় তাহলে আমরা সারেন্ডার করে জেলখানায় পঁচে মরবো? বিস্তারিত বুঝিয়ে বললাম। ওই জঙ্গলে বসে এদিকের বাস্তবতা বোঝা যায় না। সেদিন বিকাল হতে হতে সুন্দরবনের দস্যুজগতে ছড়িয়ে গেলো জামিন না পাওয়ার খবর। জামিন হবে জানি। দুই দিন আগে বা পরে। কিন্তু জামিন হলো না মাস্টার বাহিনীর, এই খবরটি নিয়ে রীতিমতো অপপ্রচার শুরু হলো দস্যু সিন্ডিকেটের মধ্যে। বনদস্যুদের মধ্যে ভীতি ছড়ানো হলো পরিকল্পিত ভাবে। সাময়িক ভাবে সেই অপপ্রচার কাজ করেছে। মজনু ছাড়া আর কাউকে ফোনে পাচ্ছি না। বিকাল থেকে সবার ফোন বন্ধ।
এরপর কয়েকদিন আর সারেন্ডারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বনদস্যুরা। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নিজের কাজে। তবে মাস্টার বাহিনীর খোঁজ খবর রাখছিলাম। দেড় মাস পর জামিন শুনানির তারিখ পড়লো। জামিন পেলো সাবেক দস্যুরা।
বরিশাল RAB-এর উপ অধিনায়ক মেজর আদনানের সঙ্গে কথা হয় প্রতিদিন। সুন্দরবনের অন্য দস্যুদের সারেন্ডার নিয়ে নিয়মিত আপডেট দিচ্ছি ও নিচ্ছি। একই সাথে মাস্টার বাহিনীর জামিনের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। জামিনের পর মাস্টার বাহিনীর সদস্যদের বাড়ি পৌঁছানো, তাদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা ছিলো আগে থেকে।
মাস্টার বাহিনীর জামিন হলো। বাগেরহাট জেলখানার গেইট-এ উপস্থিত বরিশাল RAB-এর দল। মোস্তাফিজ মামা’র নেতৃত্বে তারা জামিনে মুক্ত বনদস্যুদের নিয়ে রওনা দেয়। এলাকার জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে তাদের পৌঁছে দেয় বাড়ি বাড়ি। মাস্টারসহ সকলেই বাড়ি ফিরেছে। RAB-এর পক্ষ্য থেকে প্রত্যককে ২০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয় আপাতত চলার জন্য। সুবিধা অসুবিধা জানানোর জন্য নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হয়। আসলে সারেন্ডারের পর পুনর্বাসনের আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ শুরু হয়নি।দ তখনও। RAB সদর দফতরের নির্দেশনায় স্থানীয় ভাবে তাদের দেখভাল চলছে, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মেজর আদনান কবীর।
পুনর্বাসিত হতে সময় লাগবে। সে পর্যন্ত মাস্টার অর্থাৎ মোস্তফা শেখ-এর গ্রামের বাড়িতে থাকা নিয়ে ভয় লাগছিলো। কারণ তাঁর পুরনো শত্রুরা রয়ে গেছে। যাদের কারণে গ্রাম ছেড়েছিলো মাস্টার তাঁদের আচরণ সুবিধার ছিলো না। সরাসরি না বললেও গ্রামের হাট-বাজারে সাবেক দস্যুদের নামে কটুকথা বলছিলেন তাঁরা। আদনানের সাথেও আলোচনা করছি। দুর্ঘটনা ঘটার আগেই কিছু একটা করতে হবে।
মাস্টারও বললেন, স্ত্রী সন্তান নিয়ে গ্রামে থাকা নিরাপদ না। আবার পেট চালানোর জন্য কিছু করতেও হবে। কী করবেন তিনি? জানালেন, মটরসাইকেল সম্পর্কে সামান্য ধারণা আছে। বাগেরহাটে একটি ছোট মটরসাইকেলের গ্যারেজ দিতে চান। এরপর গ্রাম ছেড়ে বাগেরহাটে চলে যান সপরিবারে। শহরের ভিতরে একটা ছোট্ট মটরসাইকেলের গ্যারেজ করলেন। মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করালেন। গড়ে তুললেন ছোট একটা মুরগির খামার। অর্থনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও ভালোই চলছিলো। নিয়মিত মামলার হাজিরা চলছে, সংসারও চলছে সুন্দরবনের সাবেক এই দস্যুনেতার। সবকিছুর মধ্যে ভালো দিকটি ছিলো প্রতিবেশিদের সহযোগিতা। মাস্টারের পুনর্বাসনে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন।
মাস্টার বাহিনীর আরেক দস্যু সোহাগ চিংড়ির ঘের করছেন রামপালের কাটালীবাজারে। সুলতান কাকা থাকছেন মিঠাখালীতে ছেলেদের সঙ্গে। ফজলু একটা দোকান নিয়েছে দিগরাজে। সোলাইমান চট্টগ্রামে একটা ফোন এক্সেসরিজের দোকানে কাজ করছে। হারুন ফিরেছে কয়রার তেঁতুলতলায়। মাস্টার বাহিনীর মুহুরি ছিলেন সুমন সরদার। এলাকায় ফিরেছেন তিনিও। আরিফ কোনো কাজ করে না, ঘুরে বেড়ায়। আসাদুজ্জামান কোকিলের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। শাহীনও এলাকায় ফিরেছে। তবে তার চালচলন নিয়ে অভিযোগ পাচ্ছি। শুনেছি জুয়া খেলা নিয়েই আছে সে।
ফোনে ফোনে সবার খোঁজ রাখছি। তাদের পুণর্বাসন হওয়াটা বেশি জরুরি। একটি দুর্ঘটনাও ঘটতে দেওয়া যাবে না। কারণ সুন্দরবনে দস্যুতা করে বেড়ানো অন্যদের দেখিয়ে দিতে হবে যে আত্মসমর্পণ করা দস্যুরা ভুল করেনি। জামিন না পাওয়া নিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছিলো সেটি কেটে গেছে এতোদিনে।
সাবেক দস্যুরা চেষ্টা করছে নিজেদের এলাকায় পুণর্বাসিত হতে। প্রতিবেশিরাও দারুণ ভাবে সহযোগিতা করছে। এই দস্যুদের হাতে নির্যাতিত জেলেরাও তাদের প্রতিবেশি। তারাও ক্ষমা করেছে দস্যুদের। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টদের ভূমিকাও ইতিবাচক। সব মিলিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগুচ্ছে। কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে উদাহরণ সৃষ্টি হবে। যার প্রভাব পড়বে পুরো সুন্দরবনে। হয়তো কোনো একদিন দস্যুমুক্ত হবে সুন্দরবন। আমার কাজ চলবে।
(ছবি: বর্তমানে সাবেক মাস্টার বাহিনীর প্রধান মোস্তফা শেখ)