সরকার কি আমাদের মামলা নিয়ে কিছু করবে না? | রূপান্তরের গল্প ১৩৫ | Rupantorer Golpo 135 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৩৫ : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছিলেন, আইনী সহায়তা দিবেন। সারেন্ডার করা বনদস্যুদের সবাই এক কথাই বলছেন। আসলেই তো। কারও যদি ৫টি মামলা থাকে, আর হাজিরা যদি মাসে একবার হয় তাহলে পাঁচ দিনই যাচ্ছে আদালতে। সেই দিনের কাজ বন্ধ থাকছে। মানে রোজগার বন্ধ থাকছে মাসে অন্তত পাঁচ দিন।
গ্রাম থেকে যারা আসবে, দূর থেকে যারা আসবে তাদের একদিন আগে রওনা দিতে হয়। যাতায়াত ও হোটেল ভাড়ার খরচ আছে। উকিল-মুহুরির খরচও তো লাগে। সোহাগ বলছিলেন, সবাই মনে করে মাস্টার বাহিনী মানে তো বিরাট ব্যাপার। সব ক্ষেত্রে তাই আমাদের খরচও বেশি। কিন্তু আপনি তো জানেন, জঙ্গলে দস্যুতা করা টাকা আমরা গোছাতে পারিনি। আমাদের টাকাগুলো আটকে আছে কিছু লোকজনের কাছে। যাদের কাছে আমরা টাকা রাখছিলাম তারা আর চিনে না আমাদের।
সোহাগ বললেন, আমাদের তো এই ইলিশ মৌসুমে ডাকাতি করার পরিকল্পনা ছিলো। করতে দিলেন না। আপনার কথায় হুট করেই সারেন্ডার করছি। এখন ডাকাতির টাকা তো চাইতেও পারি না। কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে বেশ কিছু টাকা আছে আমাদের। কালেকশনের টাকা।
কালেকশনের টাকা মানে হলো চাঁদার টাকা। দস্যুরা সুন্দরবনে যারা মাছ-কাঁকড়া ধরতে যায় তাদের কাছে থেকে নৌকা প্রতি চাঁদা নেয়। চাঁদার পরিমান গোন-এ নৌকা প্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। যার যার নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে আসা জেলেদের কাছে থাকে এই টাকা নেয় তারা। নেয় বলতে সরাসরি নগদ টাকা নেয় না। তাদের সাথে যোগাযোগ করে মাছ ব্যবসায়ী বা মহাজনরা।
জেলেদের কাছে থেকে গোন-এ মাছ ধরতে যাওয়া খরচের মধ্যে এই ডাকাত দলের চাঁদার টাকাও ধরা থাকে। জঙ্গলে নামার আগে জেলেরা নগদ দেয় মহাজনদের। আর মহাজনরা সেই টাকার বিনিময়ে দস্যু দলের টোকেন ধরিয়ে দেয়। তারপর রয়ে সয়ে ডাকাত দলের টাকা পরিশোধ করে সাহেব মহাজনরা। বেশির ভাগ সময় টাকাটা মহাজনের কাছেই থাকে। অপহরণের পর যে মুক্তিপণ নেয় দস্যুরা সেই মোটা অংকটাও কিছু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে লেনদেন হয়। বঙ্গোপসাগরে কোপ দেওয়ার পর যে কোটি টাকার লেনদেন হয়, তাও এদের মাধ্যমেই হয়। সময় যায়, কাজ করি, জানতে থাকি ভিতরের সত্যগুলো।
এই মাছ ব্যবসায়ীরা হলেন ক্যাশিয়ারের মতো। দস্যুদের চাঁদার টাকা তুলে নিজেদের কাছেই রাখে। বনদস্যুদের নির্দেশনা অনুযায়ী এখানে সেখানে টাকা পৌঁছে দেয়। এভাবেই চলতে থাকে।
বিভিন্ন দস্যু দলের টোকেন থাকে এই ব্যবসায়ীদের কাছে। জেলেরা বনে নামার সময় নগদ টাকা দিয়ে টোকেন নিয়ে নামে। তার মানে সারা বছরের চাঁদার টাকা নাড়াচাড়া করে মূলত কিছু মহাজনে! কোনো বাহিনীর লিডার যদি ধরা পড়ে বা মারা যায় তখন তাদের আনন্দের আর সীমানা থাকে না। ওই দস্যু দলের সাথে টাকা পয়সার হিসাব সেখানেই শেষ হয়ে যায়। জুলফিকার বাহিনীর প্রধান ও তার ভাই মর্তুজার ক্রসফায়ারের মৃত্যুর পর তাদের ভাগের চাঁদার টাকা নিয়ে সুন্দরবনে গোলাগুলিও হয়েছিলো। দস্যুরা টার্গেট করে এক মহাজনকে গুলি করে। কার্গোতে থাকার কারণে বেঁচে যান তিনি। তার পর থেকে সুন্দরবনের এই মহাজনদের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসেছিলেন।
ভাবতাম, প্রতি গোন-এ জেলেরা সবাই কোটি কোটি টাকা দেয় দস্যুদের, ফরেস্ট অফিস ধরে ধরে ঘুষ দিতে হয়, ডিউটির টাকা নামে এক প্রকার চাঁদাও দিতে হয় তাদের। দস্যুরা এতো অত্যাচার করে, অপহরণের পর জিম্মি করে রাখে দিনের পর দিন, মুক্তিপণ নেয়, অথচ তাদের বিপদমুক্ত করা নিয়ে কারও মাথা ব্যাথা নাই। যাদের গায়ে শক্তি আছে, যারা এই প্রান্তিক জেলেদের রকবত চুষছে, তাদের নিরাপত্তা দিতেই ব্যস্ত সরকার। জেলেদের মনের এই কষ্টের কথা কে শুনবে? কেউ শুনতেও চায় না। কিছু করতে পারি আর না পারি বনের খাল-নদীতে ঘুরতে ঘুরতে জেলেদের মনের কথাগুলো শুনি, সাহস দেই। কিছু করতে পারি আর না পারি তাদের মনটা একটু হাল্কা হয়। যাই হোক। গল্পে ফিরি।
মাস্টার বাহিনীর সদস্য সোহাগ বলছিলেন, তাদের কালেকশনের টাকাগুলো যাদের কাছে রাখা, তাদের সাথে কথা ছিলো যে সারেন্ডারের পর টাকাগুলো ফেরত দিবে। কিছু টাকা রেখে দিবে। কিন্তু জেলখানাতে বসে তারা যখন টাকা চেয়েছে তখন বলা হয়েছে যে বের হলে দিবে। বের হওয়ার পর বলে জমি কিনে ফেলেছে, ক্যাশ টাকা নাই। তারপর খেকেই নয়ছয় চলছে। কতো টাকা মান্টাররা ওই সাহেবের কাছে রেখেছিলো জানি না, জানতেও চাইনা। সোহাগ আকনকে বললাম, ওই টাকার পিছনে আর ঘুরেন না আপনারা। অসৎ উপার্জন হাতে নিলে দেখবেন কতো ধরনের বিপদ সামনে এসে দাঁড়াবে। আবার দেখবেন জঙ্গলে টেনে নিবে আপনাদের। এসব হিসাব বাদ দেন, কাজ কর্ম করেন, ব্যবসা করেন, পরিশ্রম করে জীবন কাটান। সাবেক দস্যুদের সবাইকেই একই পরামর্শ দিচ্ছি। জানি কেউ শুনবে, কেউ শুনবে না।
দস্যু জগতে কাঁচা টাকার অভাব নাই। টাকার কোনো হিসাবও থাকে না। দস্যুতা করে যে রোজগার হয় তার থেকে দল চলার খরচ আসে, বাজার হয়, অস্ত্র গুলি কেনাকাটা চলে। অস্ত্র হাতে এক রকমের অবৈধ দিন মজুর তারা। যারা অত্যাচারী হিসাবে পরিচিত জেলেদের কাছে, আইনের কাছে ক্রসফায়ারের আসামী। আর সাদা পোশাক পড়ে কিছু মানুষ বনদস্যুদের অবৈধ টাকার প্রায় পুরোটাই গিলে ফেলছে। তাদের কেউ ধরছে না, কেউ জিজ্ঞেসও করছে না কোত্থেকে আসে এতো টাকা? কেন করছে না তার কারণ জানি। কিন্তু বলবো না। তবে লিখবো অনেক কিছু।
সুন্দরবনটাকে এতোদিন ঢেকে রাখা হয়েছে। বানানো হয়েছে রহস্য ঘেরা গহীন জঙ্গল। অথচ সেই দূরের গহীন বনে মানুষের অহরহ আসা-যাওয়া। তার মানে রহস্য সৃষ্টি করা। বনটাকে ঢেকে রাখা হয়েছে। আমাকে এই ঢেকে রাখা সুন্দরবনটাকে খুলে দিতে হবে। খুব বেশি কিছু বুঝি না এখনও। শুধু এটুকু বুঝেছি, সুন্দরবনের ভিতরের সব খবর আমাকে জানতে হবে, জানাতে হবে। এতে বনজীবীরা উপকৃত হবে, বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবে সুন্দরবন!