রূপান্তরের গল্প ১৩৬ | Rupantorer Golpo 136

গোয়েন্দা প্রধান আমাকে সতর্ক থাকতে বললেন | রূপান্তরের গল্প ১৩৬

গোয়েন্দা প্রধান আমাকে সতর্ক থাকতে বললেন | রূপান্তরের গল্প ১৩৬ | Rupantorer Golpo 136 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৩৬ : সাগরে ডাকাতি হয়েছে গত রাতে। পাথরঘাটার দক্ষিণের সাগরে ইলিশের ট্রলারে গণডাকাতি হয়েছে, এমন খবর পাচ্ছি। বলা হচ্ছে দস্যিদলটি সুন্দরবনের। সাথে সাথে ফোন দিলাম। জাহাঙ্গীর বাহিনী জঙ্গলে আছে, নোয়া মিয়াও বের হয়নি, পূর্ব সুন্দরবনে সাগরে দস্যুতা করার মতো বাহিনী নাই। বাঁকী থাকলো মজনু আর আলিফ। তাদেরকে ফোনে পাচ্ছি না। কিন্তু আমি যতোটুকু জানি এদেরও সাগরে দস্যুতা করতে যাওয়ার কথা না। তাহলে কেমন করে কী হলো? হিসাব মিলছে না কিছুতেই।

পথরঘাটার এক ট্রলার মালিক বললেন, মাস্টার বাহিনী তাদের একটি ট্রলারে ডাকাতি করেছে। বললাম, মাস্টার বাহিনী কোত্থেকে আসলো? বললেন, জেলেরা বলছে মাস্টার বাহিনী। বললাম, সত্যিই দস্যুরা আক্রমণ করেছে তো? বললেন, একদম একশ’ ভাগ নিশ্চিত। বললাম, কোন বাহিনী সেটা নিশ্চিত করতে হবে ভাই। মাস্টার বাহিনী সারেন্ডার করেছে, তাদের অস্ত্র সব জমা হয়ে গেছে, তাহলে তারা আবার সাগরে যায় কী করে? ভালো করে খোঁজ নেন। ততোক্ষণে স্থানীয় সাংবাদিকরা খবর পাঠাতে শুরু করেছেন।

এর আগে দস্যুদের আক্রমণ, মাছ লুট, অপহরণ কিংবা মুক্তিপণ আদায় নিয়ে খুব বেশি খবর আসতো না। মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমের এনিয়ে তেমন মাথা ব্যাথাও ছিলো না। সারেন্ডারের পর দস্যুতার খবরে বেশ আলোড়িত উপকূল। নিউজরুম গুলোও সোৎসাহে স্ক্রল দিচ্ছে- “বঙ্গোপসাগরে গণডাকাতি। মাছ ছিনতাই, জেলে অপহরণ”। খেয়াল করলাম, সাগরে অতীতে সংঘটিত অপহরণের খবর এতো চটজলদি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার হতো না। হয়তো, বনদস্যুদের নিয়ে আমাদের কাজগুলো অন্যদের আলোড়িত করছে। এটা ভালো। কিন্তু মূল ঘটনাটি নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। তাই আমার টিভিতে সংবাদটি প্রচার করিনি। বললাম, পুরো ব্যাপারটি নিশ্চিত হই, তারপর খবর দেওয়া যাবে।

পুরোটা দিন খুব ভালো করে খবর নিচ্ছি। বিকালের দিকে মজনু ও আলিফের সাথেও কথা হলো। তারাও সাগরে যায়নি। তাহলে ডাকাতিটা করলো কে? পাথরঘাটা থেকে সবশেষ খবর পেলাম যে শুধু মাছ লুট হয়েছে একটি ট্রলার থেকে। ইলিশ বোঝাই ছিলো ট্রলারটি। কিন্তু কাউকে অপহরণ করেনি দস্যুরা। একটি ফিশিং ট্রলারে করে নাকী আক্রমণ করেছে দস্যুরা। সবার মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা। কাউকে চিনতে পারেনি জেলেরা। কেউ বলছে ডাকাতেরা বলেছে তারা সুন্দরবনের ডাকাত। কেউ বলছে, দস্যুদের ভাষা পূর্ব দিকের, মানে চট্টগ্রামের ওদিকের। কেউ বলছে, অনেকগুলো অস্ত্র, কেউ বলছে দস্যুদের হাতে দা’ ছিলো।

সন্দেহ হচ্ছে খুব। সকাল থেকে আমার সোর্সরা কাজ করছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকে ফোন করে জানতে চাইছেন। কিন্তু আমি নিজেই তো বুঝতে পারছি না কী হয়েছে আসলে? সন্ধ্যা হতে হতে একটা বিষয় নিশ্চিত হলাম যে সুন্দরবনের কোনো দস্যু বাহিনী সাগরেই যায়নি। এদিকে কোনো অপহরণের ঘটনাও ছিলো না। শুধু মাছ লুট হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাইদের বললাম, ওই জেলেদের লুট করা মাছগুলো কোথায় বিক্রি হলো সেই খবর নিতে হবে। উনারা বললেন, দেশের কোন আড়তে ওই কয়টা মাছ বিক্রি হলো তা বের করবো কী করে? বললাম, বেশি দূরে যেতে হবে না। আশেপাশের আড়তগুলোতে খোঁজ নিন।

সুন্দরবনের কোনো দস্যুদল এই ঘটনা ঘটায়নি, নিশ্চিত আমি। এদিকে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ ভর্তি ট্রলারের মাচ লুটের খবর নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন সুন্দরবনের এক মহাজন। তিনি বলে বেড়াচ্ছেন যে বনদস্যুদের সারেন্ডার করিয়ে কোনো লাভ হয়নি। বরং ওরা জামিন নিয়ে আবার সুন্দরবনে নেমেছে, ডাকাতি শুরু করেছে। এই চক্রটি শুরু থেকেই বনদস্যুদের সারেন্ডারের বিপক্ষে।

রাতের বেলা পাথরঘাটার এক সোর্স ফোন দিলো। জানলাম, ডাকাতির ঘটনাটি সাজানো অথবা কোনো সুযোগ সন্ধানীদের অপকর্ম। মাঝে মাঝে মহাজনদের চোখে ধূলা দিয়ে সাজানো হয় এমন নাটক। একটি সিন্ডিকেটের কাছে সাগরে বসেই মাছগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। দেনা-পাওনা নিয়ে কোনো ঝামেলা না হলে সেটি ডাকাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আসলে বন-সাগরে দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয় না। পুলিশ, কোস্টগার্ড বা RAB-এর কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগও আসে না। ঘটনার তদন্ত বা অনুসন্ধানও হয়না। আমি চাই দস্যুতার ঘটনা ঘটলে মামলা হোক। কিন্তু ট্রলার মালিক ও মহাজনরা কিছুতেই মামলা করেন না, করতে চান না।

মাছ লুটের ঘটনাটি নিয়ে আমার অনুসন্ধান আর এগোয়নি। এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে হুটহাট কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে না।

রাতে মেজর আদনানের সাথে অনেক ক্ষণ আলাপ হলো। বললাম, মজনু বাহিনীর প্রধান মজনু’র সাথে কথা হচ্ছে। কিন্তু তার বিষয়ে আমি সন্তুষ্ট না। মজনু অস্ত্রের যে হিসাব দিচ্ছে তা সঠিক না। আমাকে বিভ্রান্ত করছে সে। শুনেছি সারেন্ডারের আগে বেশির ভাগ অস্ত্র বিক্রি করবে মজনু। ক্রেতা নোয়া বাহিনী। আদনান বললেন, অপেক্ষা করি আমরা। বললাম, মজনুর ইচ্ছা খুলনা RAB-এ সারেন্ডার করবে। বললেন, যেখানেই করুক, সারেন্ডার করলেই হয়। বললাম, তোমরা দুই ব্যাটেলিয়ন একসাথে কাজ করলে ভালো হতো। বিষয়টি আমার জন্য অস্বস্তির।

মেজর আদনান বললেন, জলদস্যুরা সুন্দরবনের। সেটা আমাদের কর্ম এলাকা নয়। তবে দস্যুরা আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা বা এওআর-এর মধ্যে এসে অপরাধ ঘটায়। আমার এলাকার জেলেরা দস্যুতার শিকার হয় বঙ্গোপসাগরে। বললেন, সরকার আমাকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়েছে। আর সাগরে এওআর হিসাব করে কাজ করা যায়? অর্থাৎ মজনু বা ইলিয়াসের সারেন্ডার নিয়েও তিনি কাজ করতে চান।

রাতেই RAB- এর গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আজাদকে ফোন দিলাম। বললাম, মজনু ও ইলিয়াস বাহিনীর সাথে কথা অনেক দূর এগিয়েছে। এখন তারা খুলনায় সারেন্ডার করবে নাকী বরিশালে? বিষয়টি নিয়ে জটিলতায় আছি। আপনি সিদ্ধান্ত দিন। আমি এই অস্বস্তির মধ্যে থাকতে চাই না। আর কাদের কাছে সারেন্ডার করবে তা নিশ্চিত না করে কাজও এগুদে পারছি না। এসময় মজনু ও ইলিয়াসের বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান জানালাম। বললাম, শিগগিরি তাদের সাথে আমার দেখা হবে। উনি বললেন, কাজ এগিয়ে নিন।

বললেন, ওরা খুলনায় সারেন্ডার করলে আপনার কোনো সমস্যা আছে? বললাম, একদমই না। সেক্ষেত্রে খুলনার কোন কর্মকর্তার সঙ্গে কথাবার্তা বলবো ঠিক করে দিন। আমি তাঁর সঙ্গে মজনু ও ইলিয়াসের যোগাযোগ করে দিবো। তারপর তিন পক্ষ্য মিলে কাজ এগিয়ে নিবো।

আজাদ ভাই বলছিলেন, মজনু তো বড় দস্যু বাহিনী। ইলিয়াসও আমাদের তালিকার শীর্ষে আছে। জাহাঙ্গীরকে নিয়ে খুব চাপের মধ্যে আছি আমরা। এই তিনটি দস্যুদলকে সারেন্ডার করাতে পারলে কাজের কাজ হবে। বললাম, জাহাঙ্গীরের সাথে আমার সম্পর্ক বেশ খারাপ। বাঁকী দুটি দলের বিষয়ে আশাবাদী আমি।

বললাম, আজকে বঙ্গোপসাগরে যে দস্যুতার কথা ছড়িয়েছে সে বিষয়ে একটু বাড়তি খোঁজ নিবেন? আমার কাছে কিন্তু খবর ভিন্ন। নিজেরা নিজেরা একটা ঘটনা ঘটিয়ে জলদস্যুদের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা চলছে। আসলে সুন্দরবন আর সাগরে কতো কিছু ঘটে, আমরা শুধু বিভ্রান্তিতে থাকি। গোয়েন্দা প্রধান বললেন, খোঁজ নিবেন। কথা শেষ করার আগে বললেন, কেউ কেউ সারেন্ডারে নাখোশ। আপনি সতর্ক থাকবেন।

(ছবি: ৩১ মে ২০১৬ | মংলা)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top