হঠাৎ দস্যুনেতা মজনুর নিমন্ত্রণ! দোটানায় আমি! | রূপান্তরের গল্প ১৩৭ | Rupantorer Golpo 137 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৩৭ : মজনু তো ভাই মেলা টাকার মালিক। কয়েক কোটি টাকা তার জমানোই আছে ব্যাংক-এ। পশ্চিম সুন্দরবনের এক ছোট মাছ ব্যবসায়ী ফোন করে বলছেন এসব কথা। বললাম, আপনি কি শুধু মাছ ধরেন? নাকী অন্য কিছু করেন? ইনিয়ে বিনিয়ে যে উত্তর দিলেন তিনি, তার অর্থ হলো সবার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক তাঁর। মানে ডাকাতদের সাথে যোগাযোগ আছে আবার প্রশাসনের সাথেও ভালো সম্পর্ক। মানে তিনি একজন সোর্স।
বললেন, মজনুকে একটু চাপ দিলে সব বেরিয়ে আসবে ভাই। আপনি শুধু যেভাবে বলবো সেভাবে কাজ করবেন। বললাম, অস্ত্রগুলো সব বের করবে সে? বললেন, না ভাই, মেশিনের কথা বলিনি। বলছি টাকাগুলো বের করে নিতে হবে। বললাম, সব টাকা তো সে জেলেদের কাছে থেকে জুলুম করে নিয়েছে। সোর্স বললেন, বের করতে পারলে আপনার আমার কিছু থাকবে। আমি কথা হারিয়ে ফেললাম! এই সোর্স আমাকে টাকার অফার দিচ্ছে?
মজনুর সাথে যে আমার কথা চলছে তা চেপে গেলাম। ভাবলাম দেখি কতোদূর যায়! কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম কাহিনী ভিন্ন। এই মাছ ব্যবসায়ী সব জানেন। মজনুর ওদিক থেকে শুরুতেই দশ লাখের অফার ছিলো। ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম সারেন্ডার করতে এক টাকাও লাগে না। পরে কেউ মজনুকে বুঝিয়েছে যে আমি দশ লাখে সন্তুষ্ট নই। তাই মজনু’র অফারটি প্রত্যাখ্যান করেছি। ঘুষ বা উপহারের মধ্যস্ততা করতে মজনুর পক্ষে ওকালতি করছেন এই ব্যবসায়ী ওরফে সোর্স! কী সাংঘাতিক ব্যাপার! ফোন রাখতে রাখতে বললাম, আপনার সাথে পরে কথা বলবো।
মজনুকে ফোন দিলাম। ইচ্ছামতো বকাঝকা করলাম। বললাম, আপনার সারেন্ডার করার দরকার নাই। ডাকাতি করছেন সেটাই করতে থাকেন। আর সারেন্ডার করতেই যদি চান তাহলে সরাসরি RAB-এর মাধ্যমে করেন। আমি এর মধ্যে নাই। মজনু স্যরি বললেন। ক্ষমা চাইলেন। বললেন, তাদের সাথে যারাই কথা বলে, তারাই টাকা চায়, মাছ চায়। না চাইলেও কিছু একটা উপহার দেওয়া না কী ওখানকার রীতি। বললাম, এই টাকা তো জেলেদের রক্ত! আপনারা কেমন করে ওই ঘাম ঝরানো মানুষদের রক্ত চুষে খান? আবার সেই টাকা বিলিয়ে বেড়ান? সেদিন মাথা বেশ গরম।
মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডারের আগে এতো কিছু জানতাম না। এখন বনের ভিতরের ঘটনাগুলো জানতে শুরু করেছি। জঙ্গল আর লোকালয়ের মধ্যে কারা কী করছে বুঝতে পারছি। কোনো ব্যবসায়ী কেন কোনো দস্যুদের বন্ধু, আবার আরেক ব্যবসায়ী কেন সেই দস্যুদের শত্রু, এসব ধীরে ধীরে বুঝছি। তার সাথে সাথে এটাও বুঝতে পারছি যে এখনও অনেক কিছু আমার জানার বাইরে। এই সুন্দরবনটা বাইরে থেকে দেখতেই সুন্দর। জঙ্গলে নামলে বোঝা যায় কতোটা কর্কষ আর ভয়ঙ্কর এই বন।
খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের সাংবাদিকদের সঙ্গে ততোদিনে আমার একটু দূরত্ব হয়েছে। অল্প কয়েক জন ছাড়া বাঁকী কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। অথচ কিছুদিন আগেও কতো সুন্দর সম্পর্ক ছিলো। যারা জানেন না যে সুন্দরবনে আমি কী নিয়ে কাজ করছি তারা অনেক কথা বলতে পারেন। যারা আর্থিক বা অন্য কোনো ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা নেতিবাচক কথা বলতেই পারেন। কিন্তু মোহসীন উল হাকিম টাকা নিচ্ছে দস্যুদের কাছ থেকে, কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে, এসব কথা উনারা বললে খারাপই লাগে। উনারা তো সবই জানেন, চিনেনও আমাকে।
খুলনার এক প্রিয় সাংবাদিক ভাই একদিন বলেই বসলেন যে সাংবাদিকের কাজ এসব না। আপনি সুন্দরবন যাওয়া বন্ধ করেন। দস্যুদের নিয়ে কিছু করার থাকলে সরকার করুক। বলেছিলাম, সরকার তো দাদা মানুষ না! আর একজন নাগরিক হিসাবে আমি আমার কাজ করে যাবো। আমার কথায় ক্ষুব্ধ তিনি। মাস্টারের সারেন্ডারের পর তিনিও কটু কথা বলেছেন। এখন সাংবাদিকরাও যদি আমাকে ভুল বোঝেন, পছন্দ না করেন তাহলে এই অঞ্চলে আমার বন্ধু কে? অন্য অঙ্গনের লোকজন তো তাঁদের চেহারা দেখিয়েছেন!
বন্ধু ছাড়া এই পথ পারি দিবো কী করে? এতো সমালোচনার মোকাবেলা একা একা করবো কী করে? শুভাকাঙ্খীরা বলেন, সুন্দরবনের মানুষেরা আপনার সাথে আছে। কিন্তু নামের পাশে বদনামও করছে লোকজন। বিশেষ করে সোর্সরা আমার নামে দস্যুদের কাছে টাকা চাচ্ছে। এরকম দুই তিনটি ঘটনা নিশ্চিত হয়েছি। এখন কাজ করবো? না কী বদনাম ঠেকাতে কাজ বন্ধ করবো? না কী সুন্দরবনের কাজ বন্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার পুরনো কাজগুলো চালিয়ে নিবো? দিন শেষে আমি সাংবাদিক। এই কাজ করেই আমার পেট চলে।
অফিসে কথা বললাম। আমাকে সুন্দরবনে কাজ চালিয়ে যেতে বললেন সংশ্লিষ্টরা। ওদিকে RAB-এর গোয়েন্দা প্রধান বলছেন কাজ এগুতে। বরিশাল থেকে মেজর আদনান বললেন, একটা কাজ শুরু হলো। শেষ না করলে কেমন হয়? বললাম, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিবো। সেই থেকে ভাবছি। সব ভাবনা গিয়ে ঠেকছে সুন্দরবনে।
এর মধ্যে সাতক্ষীরায় একটা কাজ পড়লো। শ্যামনগরের ধুমঘাটে অল্পনা রাণী নামের এক নারী দেশি সবজির বীজ সংরক্ষণ করেন। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া সবজি চাষ করেন নিজে, অন্যদের উৎসাহিত করেন। এবিষয়ে নিউজ করতে গেলাম। দুপুরের দিকে ফোন দিলেন দস্যুনেতা মজনু। বললেন, এতো কাছে আসছেন? আগে জানাননি কেন? বললাম, আগে জানালে কি দেখা করতেন? দস্যুনেতা বললেন, আজকে এদিকে থেকে যান। আমি লোকালয় থেকে বেশ দূরে আছি। আপনি আসতে পারলে রাতেই দেখা হবে। তখন জুলাই মাস, ২০১৬ সাল।
(ছবি : মজনু বাহিনীর প্রধান মজনু নিজে রান্না করতেন)