ঢুকবো সুন্দরবনে, দেখা হবে মজনু বাহিনীর সাথে | রূপান্তরের গল্প ১৩৮ | Rupantorer Golpo 138 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৩৮ : অল্পনা রাণীর বাড়িটি শ্যামনগরের ধুমঘাটে। সুন্দরবন উপকূলের এই অঞ্চলটিতে সবশেষ লবণ পানি উঠেছিলো আইলার সময়। তারপর আর জলোচ্ছাসের পানি আসেনি। চিংড়ি ঘের করার জন্য এই অঞ্চলের মানুষ লবণ পানি টেনে আনেনি। তারা সবুজ বাঁচানোর চেষ্টা করছে। সেই মানুষদের একজন অল্পনা। বসত ভিটার সঙ্গে কিছু জমি আছে। সেখানে দেশি জাতের কয়েকশ’ প্রজাতির শাক-সবজির গাছ। গোয়ালে আছে দেশি গরু, হাঁস-মুরগি কয়টাও দেশি। সবুজের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে অল্পনা পুরস্কার পেয়েছেন।
মুগ্ধ হয়ে দেশি প্রজাতির ফসল-সবজি বাঁচানোর যুদ্ধ দেখছি মুগ্ধ হয়ে। ২০১৬ সালের জুলাই মাস। বৃষ্টি নামছে একটু পর পর। অল্পনার উঠান ভর্তি কৌটায় সাজানো কয়েকশ’ প্রজাতির বীজ। নিউজ এর কাজ করছিলাম মন দিয়ে। পাশেই সুন্দরবন। কাউকে সেভাবে জানাইনি। ভেবেছিলাম কাজটি করেই ফিরে আসবো ঢাকায়।
মজনুর ফোন। কুশল বিনিময় করলাম। মজনু বললেন, আপনি ধুমঘাটে আসছে কিন্তু আমাকে কিছু বললেন না যে ভাই? বললাম, আমি তো অন্য কাজে আসছি। আর আপনি তো আসতেও বলেননি। আসলে মজনুকে নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। কৌশলগত কারণে তাকে চাপে রাখা প্রয়োজন। তাই খুব একটা যোগাযোগ করতাম না। সারেন্ডারের বিষয়েও তেমন কথা বলতাম না। কারণ মজনু তার অস্ত্রগুলোর হিসাব দিচ্ছেন না। শুনছি কিছু অস্ত্র বিক্রির চেষ্টা করছেন তিনি। সবগুলো অস্ত্র জমা না দিলে সেই সারেন্ডার করিয়ে লাভ নাই। কারণ সুন্দরবনে একটি অস্ত্র থাকলে সেখান থেকে একটি বড় দস্যুদল তৈরি হয়ে যায়।
কেমন আছেন মজনু ভাই? দলের লোকজনের খবর কী? বললেন, সবাই ভালো। বললাম, সাগরে দস্যুতায় যাবেন কবে? বললেন, সারেন্ডার করা ছাড়া আমার আর কোনো উদ্দেশ্য নাই আপাতত। বাড়ি ফিরবো ভাই। অনেক বছর ধরে পলাতক জীবন কাটাচ্ছি। কখন কে মেরে দেয় তার ঠিক নাই। আগেও সারেন্ডার করার চেষ্টা করছি ভাই। কিন্তু কেউ ভরসা দেয় না। ক্রসফায়ারের টেনশন নিয়ে আত্মসমর্পণ করা যায়? বললাম, মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা তো বেঁচে আছে। জামিন নিয়ে যার যার বাড়িতে আছে। কাজ করছে। সংসারও চালাচ্ছে তারা। মাস্টারসহ সবাই নিরাপদে আছেন। তাদের কেউ বিরক্ত করছে না।
মজনু বললেন, ওদের সাথে কথা হয় ভাই। আর আপনার করা সংবাদগুলোই দেখেছি। সেজন্যই তো সারেন্ডার করবো। বললাম, সবগুলো অস্ত্র-গুলি জমা না দিলে আমি এর মধ্যে নাই। মজনু বললেন, আপনি কি আজকেই চলে যাবেন? বললাম, আপাতত ঢাকায় ফিরবো ভাই। বললেন, দুইটা দিন থেকে গেলে হতো না? বললাম, থাকলে কী হবে? মজনু বললেন, থাকলে একটু দেখা করতাম!
দেখা করা যায়। কিন্তু আমি তো জঙ্গলে নামার প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি। এছাড়া সাতক্ষীরা সুন্দরবনে হুট করে নামতে পারবো না। এদিকে খুব বিশ্বস্ত মানুষ তো নাই। ট্রলার নিবো কার? পথ দেখাবে কে? মজনু বললেন, ওই দায়িত্ব আপনা না। আমি নিয়ে আসবো আপনাকে। আপনি শুধু আজকে থেকে যেতে পারেন কী না দেখেন। বললাম, নেটওয়ার্কে আছেন কিছুক্ষণ? জানাচ্ছি আমি।
ফোন দিলাম RAB-এর গোয়েন্দা প্রধানকে। জানালাম, মজনু দেখা করতে চায়। আমিও যেতে চাই। আবারও জানতে চাইলাম, তারা সারেন্ডার করবে কার কাছে? খুলনায় না বরিশালে। লে কর্নেল আজাদ বললেন, এবার খুলনায় হোক আত্মসমর্পণ। ফোন দিলাম খুলনা RAB এর অধিনায়ক খন্দকার রফিকুল ইসলামকে। বিস্তারিত জানালাম। বললাম, ফিরে এসে কথা হবে। বরিশালের মেজর আদনানকেও জানিয়ে রাখলাম সবকিছু। এরপর অফিসে ফোন দিয়ে ট্যুর এক্সটেন্ড করলাম। জানালাম, এবার মজনু বাহিনীর সাথে দেখা হচ্ছে। তবে এখনই তারা সাক্ষাৎকার পাবো কী না জানি না। হুট করেই সিদ্ধান্ত। বাসায় ফোন করেও জানালাম বিস্তারিত।
তখন রমজান মাস। ইফতারের পর একজনের সাথে দেখা হবে। তিনিই আমাদের নিয়ে যাবেন সুন্দরবনে, মজনু বাহিনীর ডেরায়। মজনি বললেন, আমাকে বাজার সদাও করতে হবে না। সুন্দরবনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি বুঝতে পারলে ঝামেলা হতে পারে। বললাম, এই মুহুর্তে আমাকে সবকিছু গোপণ রাখতে হবে। আমার উপস্থিতি যেটুকু জানাজানি হয়েছে তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। নতুন পরিকল্পনার কথা কাউকে জানানো যাবে না। মজনু ভাইকে বললাম, প্রম্তুতি নেন। আর যিনি আমাকে নিয়ে যাবেন তার ফোন নাম্বার দিন। মজনু বললেন, আমার ভাই ওমুক আপনাকে ফোন দিবে।
বুঝতে পারছিলাম না যে এতো কম সময়ের মধ্যে এতো কিছুর আয়োজন হবে কী করে? দুই দিন সুন্দরবনে থাকবো। সেভাবে বাজার সদাও করতে হবে। কিন্তু শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ কিংবা নিলডুমুরে গেলে আমাকে দেখে ফেলবে মানুষ। খবর ছড়িয়ে যাবে। তাই প্রথম কাজ নিজেকে আড়ালে রেখে এক বেলা সময় পার করা। অল্পনা রাণীর কাছে থেকে বিদায় নিলাম, তাঁদের জানালাম ঢাকা ফিরবো।
এবার আমার সফর সঙ্গী ভিডিওগ্রাফার পলিন নাই। সাথে আছেন বাঁধন। আছেন সাতক্ষীরার সহকর্মী আহসান রাজীব। তখন বাজে বেলা এগারোটা। ফোন দিলাম শ্যামনগরের সাংবাদিক সালাহউদ্দীন বাপ্পী ভাইকে। বললাম, আমি আপনার কাছাকাছি। এক বেলা মাছ ধরবো কোথাও গিয়ে। বাপ্পী ভাই সাথে সাথে সব ব্যবস্থা করে ফেললেন। মৌতলার একটি গ্রামে উনার এক বন্ধুর পুকুরে মাছ ধরতে বসে পড়লাম। মজনুর সাথে কথা ছিলো, উনার লোক আমাকে ফোন দিবে ইফতারের আগে আগে। মুন্সিগঞ্জ থেকে আমরা নামবো সুন্দরবনে। ওই ব্যক্তির নাম আলমগীর (ছদ্মনাম)।
বড়শি নিয়ে আমরা বসেছি একটি বাড়ির পুকুরে। প্রত্যন্ত গ্রাম। চারপাশে চিংড়ির ঘের। বেশ লম্বা রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয়। একদম গ্রামীণ পরিবেশ। সুন্দরবন থেকে একটু দূরে। সেখানকার মানুষ আমাকে চিনেনও না। তাই সচ্ছন্দে সময়টুকু কাটলো। পরিবেশটাও গ্রামীণ, ভালো লাগার মতো। বাপ্পী ভাই স্থানীয় সাংবাদিক, বেশ সিনিয়র। সুন্দরবন সম্পর্কে অনেক বেশি অভিজ্ঞতা তাঁর। প্রথম বনদস্যু মোতালেবের সঙ্গে তিনিই আমাকে কথা বলিয়ে দেন ২০১০ সালে। এক কথায় দস্যু জগতে আমার কাজের হাতে খড়ি উনার মাধ্যমে। সুন্দরবনে আমরা একসাথে মাছ শিকারে গেছি কয়েক বার। দোবেঁকী, আঠারো বেঁকী, কাছিকাটা, পূষ্পকাটি, কদম তলা, কলাগাছিয়া, কৈখালী, নিল ডুমুর, কলবাড়ীসহ বন উপকূলের অনেক জায়গা চিনেছি তাঁর মাধ্যমে।
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জের আশেপাশের নদীগুলোতে ঘুরে ঘুরে মাছ ধরতাম আমরা। আসলে মাছ ধরার ছদ্মবেশে আমি খুঁজতাম বনদস্যুদের। একবার মালঞ্চ নদী আর টাট খালের সংযোগস্থলে দূর থেকে একটি ছোট দস্যুদলকে দেখেছিলাম। আমাদের ট্রলার দেখে তারা অন্যদিকে সরে যায়। তখন কদমতলা ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা মোকাম্মেল ভাই অনেক সহযোগিতা করেছিলেন। বুড়িগোয়ালিনীর স্টেশন কর্মকর্তা কবীর ভাইয়ের কথা ভুলবো না। বনরক্ষীরা শুরুতে ভুল বুঝতেন। ধীরে ধীরে আমার কাজের বিষয়ে জানতে পারেন। মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর উনাদের মধ্যে কয়েকজন বেশ সহযোগিতা করেছেন।
জলদস্যু দল মজনু বাহিনী পশ্চিম সুন্দরবনে থাকে। এটুকুই জানি। এবিষয়ে কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছি না। অল্প কয়েকদিন ফোনে কথা। জটিলতায় ভরা সুন্দরবনের দস্যু জগৎটাকে কেবল চিনতে শুরু করেছি, ভালো করে বুঝিনি তখনও। তারপরও ঝুঁকি নিতে হবে। আপাতত বিষয়টি নিয়ে মজনু ভাবুক। আমরা এ বেলা মাছ ধরি। সন্ধ্যা হোক। আলমগীর ফোন দিক। তারপর উঠবো এখান থেকে। পশ্চিম সুন্দরবনের কাউকে জানতে দেয়া যাবে না আমি আজ সুন্দরবনে ঢুকবো।