রূপান্তরের গল্প ১৩৯ | Rupantorer Golpo 139

দস্যুনেতার চর আলমগীরের ফোন, সন্ধ্যায় থাকবেন মুন্সিগঞ্জ বাজারে! | রূপান্তরের গল্প ১৩৯

দস্যুনেতার চর আলমগীরের ফোন, সন্ধ্যায় থাকবেন মুন্সিগঞ্জ বাজারে! | রূপান্তরের গল্প ১৩৯ | Rupantorer Golpo 139 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৩৯ : বাঘে ছাড়ে কিন্তু ডাকাতে ছাড়ে না। আবার ডাকাতেও কখনও ছাড়ে। কিন্তু মজনু বাহিনী সামনে পড়লে ছাড় পাওয়া যায় না। নিজে মারপিট করে না। কিন্তু ওই দলে দুই/চারজন দস্যু থাকে যারা বেদম মারপিট করে। সেই ভয়ঙ্কর দস্যু মজনুর সাথে আজ দেখা হবে। কোনো রকম পরিকল্পনা ছিলো না। কিন্তু কেমন করে সবকিছু মিলে গেলো! আবারও মনে হলো, সুন্দরবন আমাকে ছাড়বে না। সন্ধ্যার পর সুন্দরবনে নামবো আমরা। তার আগে নিজেদের একটু আড়াল করতে মাছ ধরতে বসেছিলাম মৌতলায়।

মৌতলা নামটি যেমন সুন্দর, তেমনি দেখতেও অদ্ভুত সুন্দর। সাতক্ষীরার এই অঞ্চলের গ্রামগুলো ছবির মতো। বিশাল বিশাল চিংড়ির ঘের। কিন্তু সেই ঘেরগুলোতে কোনো ব্যস্ততা নাই। রাতের বেলা মাছ ওঠে। ভোরবেলা চলে যায় আড়ত বা কাটায়। মাছ বেচাকেনা শেষ হয়ে ভোরবেলাতেই। তারপর বড়ফ ভর্তি বাক্সে ভরে তোলা হয় ট্রাকে। চিংড়ি মাছ চলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সকাল হতে হতে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে মানুষ।

সারাদিন ঘরে বসে, চায়ের দোকানে অথবা ক্যারম বা দাবা খেলে সময় কাটে। কেউ বসে তাশ খেলতে। চা-আড্ডায় কেটে যায় সারাদিন। সাদা সোনা নামে অর্থকরী পণ্য বাগদা চিংড়ির কারবার চলে এখানে। লবণ পানির কারণে গলদা হয় না। এই ঘেরের কারবারে বেশি মানুষের প্রয়োজনও হয় না। ফসলের ক্ষেতের মতো মৌসুমী শ্রমিকও লাগে না। তাই সাতক্ষীরাসহ সুন্দরবন উপকূলের মানুষের জীবন অন্য রকম, দেশের অন্য অঞ্চলের মতো না। কৃষি কাজ এখানে নাই বললেই চলে। তাহলে এতো মানুষ করে কী? কী করে সংসার চলে তাদের? বিষয়টি বেশ জটিল!

এই উপকূলের প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবনে যায়, জঙ্গল করে। মানে বনের খাল-নদীতে মাছ-কাঁকড়া ধরে। মধুর মৌসুমে কিছু মানুষ মধু কাটতে যায়। ওই জীবনকে লিখে বা বলে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নাই।

প্রান্তিক পরিবারগুলো না খেয়ে আছে এমন না। তবে সেই খাবারটুকু জোগাড় করতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয় প্রতিদিন। জঙ্গলে যারা মাছ-কাঁকড়া ধরতে যায় তারা প্রতিবার ঘর ছাড়ার সময় একরকমের চির বিদায় নিয়ে যায়। বাঘ-কুমিরের আক্রমণে জীবন যাওয়ার শংকা থাকে। হতে পারে অন্য কোনো দূর্ঘটনা। নদীতে ডুবে মারা যায় অনেকে। কারও মৃত্যু হয় বিষধর সাপের দংশনে। পানিতে কখনও হাঙ্গরের আক্রমণ হয়। হঠাৎ অসুস্থ্য হয়েও মারা যায় মানুষ। হাসপাতালে তবে সবাই সেই দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে জঙ্গল করে। লবণ পানির ওই কর্কষ পৃথিবী তাদের এক রকম সয়ে গেছে।

গোন আসলেই সুন্দরবনে যেতে হবে। চাঁদের হিসাবে দশমীর রাত বা একাদশী থেকে গোন শুরু। মানে মাছ ধরার সময়। গোন চলে অমাবশ্যা বা পূর্ণিমার পর পর্যন্ত। সাগর নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষরা দিন-রাতের হিসাব করে চলে না। মাছ ধরা চলে গোন হিসাব করে। পূর্ব উপকূলে গোনকে বলে জো। মরা গোনকে বলে ভাটা। বইয়ের ভাষায় ভরা কাটাল ও মরা কাটাল।

গোনের সময় সপ্তাহ খানেক বনের ভিতরে নৌকায় কাটে জঙ্গল জীবন। বনে প্রবেশের আগে অনেকগুলো কাজ থাকে। নৌকা-জাল ঠিকঠাক করতে হয়। তারপর দালাল ধরতে হয়। বন বিভাগের রেভিনিউ, অফিস খরচ, ফরেস্টের ডিউটির টাকা জোগাড় করে সেই দালালের হাতে দিতে হয়। আলাদা করে বনদস্যুদের চাঁদার টাকাটাও ওই দালালদের দিয়ে টোকেন নিতে হয়।

বনে প্রবেশের সময় জেলেদের কিছু নগদ টাকাও রাখতে হয়। বন বিভাগের মুখোমুখি হলে ডিউটির টাকা দিতে হয়। সবকিছু পার করে দেখা হয়ে যায় বনদস্যুদের সাথে। পশ্চিম সুন্দরবনে ডাকাতদের যন্ত্রণা খুব বেশি। তারা বেশ হিংশ্রও। এদিকের জঙ্গলে মজনু, নোয়া মিয়ার অবস্থান একটু দক্ষিণে। মাঝ সুন্দরবন ও লোকালয়ের কাছে ঘুরে বেড়ায় আলিফ, মজিদ, মুন্না, জিয়া, জোনাব, নুরুল আলম, আলম, বাক্কার, সাহেব আলী, কাজলসহ কয়েকটি দস্যুদল। ডিঙ্গি নৌকায় করে নিরবে দস্যুতা করে বেড়ায় এরা।

একজন জেলে কয়টি দস্যুদলকে চাঁদা দিবে? চাঁদা দেওয়া থাকলেও দস্যুদের সাথে দেখা হলে ডিউটির টাকা দিতে হয়। অদ্ভুত একটা বিষয়। ডিউটির টাকা নাম দিয়ে উপরি নেয় সরকারী লোকজন, দস্যুরাও। আগে বড় দস্যুদের টোকেন নিলে তারাই নির্বিঘ্নে মাছ ধরার ব্যবস্থা করতো। কিন্তু এখন সব বেসামাল।

মৌতলার সেই পুকুর পাড়ে মাছ ধরছি ঠিকই। কিন্তু মন পড়ে আছে সুন্দরবনে। দূর্ধর্ষ দস্যুনেতা মজনুর ডেরায় যাবো। রাতেই দেখা হবে। মজনুসহ সুন্দরবনের দস্যুদের ছবি বলতে তখন কিছু পাওয়া যেতো না। সতর্কতার সঙ্গে নিজেদের আড়াল করে রাখতো তারা। এর আগে রাজুকে দেখেছি, মাস্টারদের দেখলাম, ইলিয়াস ও জাহাঙ্গীরকেও দেখেছি। বসে বসে মজনুর চেহারা কল্পনা করছি। ভাবছি এতো কিছুর মধ্যে দিয়ে লোকটি বেঁচে আছে এখনও! তার আশেপাশের প্রায় সবাই ক্রসফায়ারে গেছে, কেউ কেই নিরুদ্দেশ! অথচ খুলনায় তার বাড়ি আছে, জমি আছে। দেশে বিদেশে সম্পদ তার। নিশ্চয়ই খুব বুদ্ধিমান!

এমন নির্ভার দস্যু দর্শন আমার আগে কখনও হয়নি। এবার আমার কাজ শুধু মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছানো। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের একটি ইউনিয়ন মুন্সিগঞ্জ। দক্ষিণ পশ্চিমে শেষ বাস স্ট্যান্ড। এর পরেই চুনা নদী। তারপরেই সুন্দরবন। এখানকার নদী খালগুলো পশুর বা শিবসা নদীর মতো বড় না। অবশ্য খোলপেটুয়া বেশ চওড়া নদী। মালঞ্চ এখানে তুলনামূলক ছোট। পশ্চিমের সীমান্ত নদীগুলো একটু বড়। সুন্দরবনের সব নদী উত্তরে ছোট হলেও দক্ষিনে সেগুলো বিশাল আকার ধারণ করেছে। এপাশ ওপাশ দেখা যায় না। মোহনায় গেলে রীতিমতো ভয় লাগে। সেখানে নদীগুলো শান্ত না।

বিকাল চারটা’র দিকে ফোন আসলো। ওপাশ থেকে আমার পরিচয় নিশ্চিত করলেন আলমগীর। তারপর বললেন, মজনু ভাই আপনাকে কিছু বলেছে? বললাম, কখন, কোথায় আসবো? সবকিছু গোপন আছে তো? আলমগীর বললেন, কোনো সমস্যা নাই। আমি বাজার করবো। ইফতারের পর পর মুন্সিগঞ্জ থেকে নৌকা ছাড়বো। সবকিছু রেডি থাকবে। বললাম, একটু বেশি করে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি নিবেন। উনি বললেন, পানি নিয়েছি। আপনি বললেন যখন তখন পাঁচ লিটারের কয়টা বোতল কিনে নিবো নৌকায় উঠার আগে।

আপনার সাথে কয়জন আছে? জানতে চাইলেন আলমগীর। বললাম, আমি, বাঁধন, রাজীব আর নিজাম ভাই। মানে মোট চারজন। বললেন, অসুবিধা নাই। বাজারে যাচ্ছি। ফোনটা বন্ধ রাখবো। টেনশন করবেন না। ইফতারের পর মুন্সিগঞ্জের বটতলায় এসে দাঁড়াবেন। আমি আপনাদের খুঁজে নিবো।

ছবি: (মাছ ধরতে ধরতে অপেক্ষা, সাথে নিজেদের আড়ালে রাখার কৌশল ছিলো)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top