নৌকার খোল-এ জ্যান্ত ছাগল! | রূপান্তরের গল্প ১৪১ | Rupantorer Golpo 141 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৪১ : ঝিঁঝি পোকা ডাকছে একটানা। এক সেকেন্ডের জন্য থামছে না। চুনা নদীতে ভাসছি আমরা। বাম পাশের জঙ্গল ধরে আগাতে চাচ্ছি। কিন্তু ভাটায় চর জেগেছে। তাই ডিঙ্গি নৌকা সেই চরের কোল ঘেঁসে আগাচ্ছে। সামনে পিছনে বৈঠা বাইছে দুইজন। পানিতে বৈঠা চালানোর শব্দ চলছে ছন্দে ছন্দে। সাথে ঝিঁঝি পোকার ডাক মিশে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক পরিবেশ।
স্রোতের বিপরীতে নৌকা বাওয়া কঠিন। হাঁপিয়ে গেছেন দু’জনই। শুধু হুম হুম করে শব্দ বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে। এই পরিবেশ আমার চেনা। কিন্তু রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে নি:শব্দে চলার চেষ্টা অন্য সহযাত্রীতের কাছে ভীতির। ছোট্ট ওই ডিঙ্গি নৌকার ভিতরে ছয়জন বসা। এতোগুলো মালপত্র নিয়ে ডুবু ডুবু নৌকায় চুপচাপ বসে আছি। ভয় কমাতে ফিসফিস করে কথা শুরু করলাম। আলমগীর ভাইকে বললাম, কতোক্ষণ চুপ করে থাকতে হবে? আমার সহযাত্রীরা কিন্তু ভয় পাচ্ছে। আকাশেও মেঘ জমেছে। বৃষ্টি-বাদল আসলে কোথায় যাবো? ছাতাও আনিনি আমরা। উনি বললেন, ঘন্টা খানেক এই নদীতেই থাকবো। তারপর উঠবো মালঞ্চ নদীতে।
ফিসফিস করে গল্প করছি বাঁধনের সাথে। সুন্দরবনের এই পরিবেশে সে একদম নতুন। আবার সাঁতারও জানে না। পরিবেশ হাল্কা করার জন্য বাঁধনের সাথে গল্প করছি ফিসফিসিয়ে। নৌকায় আমরা দু’জন শুধু মুখোমুখি বসা। অন্যরা বসা নৌকার পিছনের দিকে। বাঁধনকে বললাম, বাম পাশের জঙ্গলটাই সুন্দরবন। এখানে কুমিরের চাপ কম। তবে বাঘের চাপ আছে। হরিণ আছে অল্প। এই ভাটার সময় ভালো করে তাকালে ওদের দেখতে পাবে। হরিণ দেখার চেষ্টা করো।
এবার আলমগীর ভাই একটু বিরক্ত। বললাম, ফিসফিস করে কথা বললে কী সমস্যা ভাই? মানে একদম চুপ থাকবো? উত্তর দিলেন না। বৈঠা বাওয়ার গতি বাড়িয়ে দিলেন। আমরা একদম চুপ হয়ে গেলাম। এখন ফিসফিস করেও কথা বলছি না। এর মধ্যে হঠাৎ চিৎকার! ছাগলের ডাক!
ছাগল ডাকছে নৌকার ভিতর থেকে। কী ব্যাপার? খোলের ভিতরে ছাগল? বৈঠা ছেড়ে এবার হো হো হো করে হেঁসে উঠলেন আলমগীর ভাই। সাথে সাথে সবাই হেসে ফেললাম। বললাম আস্ত একটা ছাগল নৌকাতে নিছেন ভাই? উনি বললেন, মজনু ডাকাতের মেহমান হয়ে যাচ্ছেন জঙ্গলে। ওরা একটু আপ্যায়ন করবে না? বললাম তা না হয় করলো। কিন্তু ছাগলটাকে থামান।
নৌকার এমন অবস্থা যে নড়াচড়ার উপায় নাই। কোনো রকমে শক্ত হয়ে বসে থাকলাম। পিছন থেকে মাঝি ভাই উঠে আসলেন। নৌকার পাটাতন সরিয়ে ছাগলটাকে বের করলেন। এরপর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক চেষ্টা করছেন। আলমগীর ভাই বললেন মুখে লবণ দাও। লবণ পাবো কোথায়? বাজারের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে লবণের প্যাকেট বের করলেন আলমগীর। এক মুঠো লবণ ছাগলের মুখে দিয়ে চেপে ধরলেন। কিন্তু কাজ হলো না। নদীর ডান পাশ ধরে লোকালয়। ভেড়ি বাঁধে বসা লোকজন টর্চ মারছে। কী একটা অবস্থা। আমরা নিঃশব্দে আগানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু এই ছাগলটা সব নষ্ট করে দিলো!
ওপাশ থেকে হাঁক দিলো একজন। এই, কারা তোমরা! কই যাও? আলমগীর ভাই পাল্টা জবাব দিলেন। বললেন, বাজার করে বাড়ি যাই, কদম তলায়। ভাটা ঠেলে কেন যাচ্ছে নৌকা? কী উত্তর দিবো?
ওদিকের লোকজন জানে যে ভাটায় নৌকা চলে অতি জরুরি পরিস্থিতিতে। এছাড়া উজানে চলা নৌকা মানেই ঝামেলা। আবারও লাইট মারছে ওরা। এবার আমি বললাম, বাড়ি গিয়ে তারাবীর নামাজ ধরবো। মিথ্যা বললাম। কারণ ঝামেলা বাধার আগেই সরে যেতে হবে। নৌকার লোকজনদের বললাম, আপনার বৈঠা ধরেন। ছাগলের ব্যবস্থা আমি করছি। কী করবো তা অবশ্য জানি না।
একটু মেজাজও খারাপ হলো। বললাম, ছাগল নিতে বলছে কে? আমি তো বলিনি। এক দুই দিন থাকবো। যা আছে তাই দিয়ে চলে যেতো। খালি খালি ঝামেলা বাড়ান আপনারা। এসময় নৌকার পিছন থেকে রাজীব বললেন, ছাগলের ক্ষুধা লাগছে মনে হয়। একটু পাতা খাওয়ালে থামবে মনে হয়। ভালো বুদ্ধি। কিন্তু এখানে তো কাঁঠাল বা কলা গাছ নাই। মাঝি ভাই বললেন, কেওড়া পাতা খায়। বললাম, জঙ্গলের কোল ঘেঁষে আগান আপনারা।
সুন্দরবনের এদিকটাকে প্রচুর গাছ। কিন্তু কেওড়া গাছ খুঁজে পাচ্ছি না একটাও। নৌকা চলছে এবার নদীর তীর নদী ধরে। এখানে চর নাই। কিছুক্ষণ আগে ভাটা শেষ হলো। স্রোতের চাপ কমেছে। তাই নৌকা এবার চলছে দ্রুত গতিতে। এদিকে ছোট ছোট বিরতি দিয়ে ছাগলটা ডেকেই যাচ্ছে। গায়ে হাত বুলিয়ে থামানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু একটু পর পর নিরবতা ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমাদের লুকিয়ে থাকার চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। আলমগীর ভাই বললেন একটু সামনে পশুরতলা খাল। ওই খালের মুখে কেওড়া গাছ আছে।
ছোট একটা টর্চ নিয়ে আলো ফেলে ফেলে আমি কেওড়া গাছ খুঁজছি। কোনো খবর নাই। এদিকের জঙ্গলে গড়ান গাছ বেশি। একটু পর পর বাইন গাছ। ভিতরে ভিতরে গেওয়াসহ নানা জাতের গাছ। কিন্তু কেওড়া গাছের খোঁজ নাই। এভাবে প্রায় আধা ঘন্টা চললাম। পশুরতলার আগেই কেওড়া গাছ পেলাম। নৌকা থামিয়ে কাঁদা ভেঙ্গে দৌড়ালেন মাঝি ভাই। কয়েকটা ছোট ছোট ডাল ভেঙ্গে আনলেন পাতাসহ। পা ধুয়ে নৌকায় উঠে আবারও বৈঠা ধরলেন।
আমি কেওড়া পাতা ধরলাম ছাগলের মুখে। এবার উনি একটা দুইটা করে পাতা খাচ্ছেন। আর নির্দিষ্ট বিরতিতে ব্যা ব্যা করে ডেকে যাচ্ছেন। হাসতে হাসতে বললাম, সুন্দরবনের এই বিপদগুলো অন্য রকম। পৃথিবীর কোথাও বোধ হয় এ জাতীয় ঝামেলায় পড়তে হয় না। একটু পরে মনে পড়লো, বেচারা ছাগলটা ভয় পেয়েছে। নৌকা থেকে শুরু করে সবকিছুই তার কাছে অচেনা। এখন শুধু কেওড়া পাতা খাইয়ে তাকে চুপ করানো যাবে না।
পশুরতলার ভাড়ানীতে গিয়ে নৌকার গতি কমলো। সামনে পিছের দুইজন ঘেমে একাকার। মাঝি বলছেন পশুরতলার ভাড়ানী ফুঁড়ে যাই। আর আলমগীর ভাই বলছেন, কদমতলা দিয়ে যাবো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কারণ ওখানকার খাল, নদী আর ভাড়ানীগুলো আমার খুব চেনা না। এছাড়া রাতের বেলা বলে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার বোঝার দরকারও নাই। আমাকে মজনুর কাছ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া উনাদের দায়িত্ব।
দুজনের মধ্যে একটু বচসা হলো। শেষ পর্যন্ত আলমগীর ভাইয়ের পথে যাবো বলে সিদ্ধান্ত হলো। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ তখন বুঝিনি। পরে বুঝেছি যে পশুরতলা ভাড়ানীতে জোনাব বাহিনী থাকতে পারে। এই ছোট দস্যুদলটি বেশ ঝামেলার। যদিও জোনাবের সাথে আমার ফোনে কথা হতো। কিন্তু রাতের বেলায় কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। পশুরতলা খাল ও ভাড়ানীতে শুধু জোনাব না, আলিফ কিংবা আলমের দলও থাকতে পারে। বললাম, বড় নদী ধরে চলেন। পরে যা হবে দেখা যাবে। এমনিতেই মরা গোন। আকাশে মেঘ করেছে। চাঁদ-তারার আলোটাও নাই। এই নিম অন্ধকারে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। শুনেছি জোনাব কথায় কথায় গুলি করে দেয়।
আমাদের নৌকা চললো বরাবর সোজা পশ্চিমে। একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি ডান পাশে অনেকগুলো চিংড়ির ঘের। এখানে মানুষ জন কম। সোজা ডান পাশে যে আলো দেখা যাচ্ছে সেটা একটা ফরেস্ট অফিস, কদমতলা স্টেশন। ওখান থেকে বামে চলে গেছে মালঞ্চ নদী। আমরা ওই নদী উঠবো।
(ছবি: চুনা নদী, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা বন উপকূল)