সিগন্যাল দিয়ে ডেকে নিবে বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ১৪২ | Rupantorer Golpo 142 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৪২ : একবার টাট-এর মুখে মাছ ধরতে বসেছিলাম। ছোট একটা ট্রলারে বাপ্পী ভাই আর আমি। যতোদূর মনে পড়ে ২০১২ সালের কথা। মালঞ্চ নদীর যেখানে টাট খালটি অতিক্রম করেছে সেই জায়গাটিকে জেলেরা বলেন টাট-এর মুখ। বিশাল দোয়া। পানি কোথাও একশ’ হাতের বেশি। বড়শি ফেললে সূতা ছাড়তেই থাকি, ছাড়তেই থাকি, তলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হুইলের সূতা শেষ হয়ে যায়। ওখানে সময় করে বসতে পারলে মেদ-মোচন মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু এতো সময় কোথায়? এছাড়া পশ্চিম সুন্দরবনের এই জায়গাটি বনদস্যুদের চলাফেরার পথ।
সেবার মাছ ধরেছি কয়েকটা। বড়শিতে কাঁকড়াও উঠেছে। এক টানে একটা কাউইন মাছ আর একটা টেংড়া মাছ একসাথে উঠলো। মালঞ্চে জেলেরা দাওন বড়শি ফেলে। সেদিনও ফেলা ছিলো বড়শি। শেষ ভাটায় জেলেরা এসে বড়শি টানলো। একটা বেশ বড় সাইজের মেধ মাছ উঠলো। মাছটি কিনতে চাইলাম। কিন্তু বেচবে না। বললো, মহাজনের কাছে থেকে দাদন নিয়েছে তারা। মাছ তাকেই দিতে হবে। নৌকা বেয়ে চলে গেলো জেলেরা। আমরা বসেই রইলাম।
মাছ ধরা বেশ শক্ত নেশা। আমাকেও ধরে ফেলেছে এই নেশায়। তবে তার চেয়ে বড় নেশা সুন্দরবন। দস্যুদের নিয়ে কাজ করার চেষ্টা যখন থেকে তখন থেকেই সুন্দরবনের নেশায় পড়েছি। লবণ পানির এই বৈরী পরিবেশের মধ্যে যে মাদকতা আছে সেটাই সুন্দরবনের নেশা।
সুন্দরবনের সৌন্দর্য খুঁজতে বাঘ-কুমির খুঁজতে হয় না আমার। ওই লবণ পানি, পাগলাটে বাতাস, ঝুম বৃষ্টি, জোয়ার ভাটায় পানির স্রোত ঘুরে যাওয়া, পাখির শব্দ, ঝিঁঝি পোকার ডাক, সময় সময় কুকু পাখির ডেকে ওঠা, কক কক করতে করতে বকদের উড়ে যাওয়া, রঙিন মাছরাঙ্গার মাছ শিকার, কয়েক জাতের ঈগল পাখির পানিতে ছোঁ মেরে মাছ ধরা, চরে কুমিরের রোদ পোহানো, উদ বিড়ালের দল বেঁধে খাল পার হওয়া, বড় বড় গুঁইসাপের ভেসে বেড়ানো, বানরের লাফঝাঁপ, জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে হরিণের সতর্ক তাকিয়ে খাকা কিংবা বন্য শুকরের নির্লিপ্ত ঘুরে বেড়ানো! সবকিছুই সুন্দর, অসম্ভব সুন্দর। তখনও সেভাবে বাঘ দেখা হয়নি। তবে বাঘের পায়ের ছাপ, কার্তিক মাসের সন্ধ্যাবেলা সুন্দরবনের বাঘের গম্ভীর ডাক বুকে কাঁপন ধরায়। সবকিছুই অসম্ভব সুন্দর। তবে সুন্দরবনে গেলেও সবকিছুর মধ্যে মানুষ খুঁজি আমি।
বনে জঙ্গলে মানুষের উপস্থিতি অনেকের কাছে অনাকাঙ্খিত। কিন্তু আমার কাছে মানুষই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। এই ঝুঁকির পৃথিবীতে যারা আসে তাদের পেট চালানোর রসদ আসে সুন্দরবন থেকে। জেলেদের মাছ শিকারের প্রক্রিয়া অনেক বেশি জটিল এবং পরিশ্রমের। তবুও তাদের আসতে হয় জীবন বাজি রেখে। এই জীবন বাজি রাখা মানুষগুলোর জন্য কেউ কথা বলে না। অথচ কতো দামি সম্পদ আহরণ করে তারা। কতো বিপদ কাঁধে নিয়ে বেঁছে আছে এই মানুষগুলো। আমার কাছে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্রের একটি অনুসঙ্গ মানুষ।
বড়শি ফেলে এসব ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি টাট খালের পশ্চিম দিক থেকে একটি ডিঙ্গি নৌকা আসছে। ৫/৬ জন একসাথে বৈঠা বাইছে। অনেকটা নৌকা বাইছ এর মতো। বাঁক ঘুরে আমাদের দেখেই থেমে গেলো তারা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নৌকাটি ঘুরে গেলো। বনের ভিতরে মাছ-কাঁকড়া শিকারীদের নৌকায় দুইজন করে থাকে। সর্বোচ্চ তিনজন। এক নৌকায় এর বেশি মানুষ মানেই সন্দেহের ব্যাপার। মানে ওটা বনদস্যুদের নৌকা। বুকের মধ্যে একটু ধক করে উঠলো ওদের দেখে। ভাবছি ট্রলার ছেড়ে একটু দেখে আসবো ওদের? কিন্তু সেটা বড় ঝুঁকি নেয়া হবে।
সিদ্ধান্ত বদলে বসে থাকলাম সেখানেই। বনদস্যুদের প্রচুর চাপ তখন সুন্দরবনের এ পাশটায়! তখন পর্যন্ত মোতালেব, আলিফ, জোনাব আর মান্নান ছাড়া আর কারও সাথে কথা হয়নি। আরও দল আছে। যাদের সঙ্গে আমার পরিচয় নাই। মজনু বাহিনীর সঙ্গে দেখা হবে মালঞ্চ নদীর কোনো পাশ খালে। অথচ ওই জায়গাগুলো আগে এড়িয়ে চলতাম।
এসব ভাবতে ভাবতে বাস্তবে ফিরে এলাম। নৌকায় থাকা ছাগলটির সাথে সহকর্মী বাঁধনের বেশ ভাব জমেছে। এখন আর ডাকাডাকি করছে না। ছাগল থেমেছে কিন্তু ওপাশ থেকে ডাকছে বন বিভাগের লোকজন। আমরা চলে এসেছি কদমতলা। ফরেস্ট অফিসের জেটি থেকে টর্চ-এর ইশারায় ডাকছে তারা।
আমরা দাঁড়াবো না। কিছুতেই না। এতোদূর এসে তরী ডুবানো যাবে না। জায়গায় জায়গায় বনরক্ষীদের মধ্যে কিছু মানুষ খুব বেশি অসহযোগিতা করেন। এখানে তেমন কেউ থাকলে পুরো সফর পন্ড হবে। মাঝে মাঝে আবার মামলা-টামলা দেয়ারও ভয় দেখায় কেউ কেউ। বনদস্যুদের সাথে দেখা করার সময় ঝামেলা এড়াতে সতর্ক থাকি, এড়িয়ে চলি, সামনে পড়লে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।
কিন্তু পালাবো কী করে? খোলা নদী। চারপাশে কোনো ছোট খাল নাই। আমরা আছি নৌকায়। ট্রলার ছাড়লে দুই মিনিটে এসে ধরে ফেলবে আমাদের। কী করবো ভাবছি। এসময় নৌকা থেকে আলমগীর ভাই চিৎকার করে তাঁর পরিচয় দিলেন। বললেন, এই, কী সমস্যা তোমাদের? এতো ডাকাডাকি করো কেন? বললেন, মেহমান নিয়ে সাহেবদের কাছে যাচ্ছি। ওপাশ থেকে বলা হলো, আলমগীর নাকী? আচ্ছা যাও, ফিরার সময় দেখা করে যাইও। তার মানে ফরেস্টারদের সাথে চেনা পরিচয় আছে। বনদস্যুদের কাছে যাওয়া আসার বিষয়টিও তাঁরা জানেন।
নৌকার আহ্নি ঘুরলো দক্ষিণে। এবার পিছনের মাঝি সামনে চলে গেলেন। আলমগীর ভাই পিছনে। এতোক্ষণ সবকিছু ভালোই ছিলো। মালঞ্চ নদীতে উঠতেই দুলে উঠলো নৌকা। জোয়ারে ফুলছে পানি। মেঘে ঢাকা পুরো আকাশ। দমকা বাতাস ছেড়েছে। মাঝ নদীতে এবার একটু ভয়ই পেলাম। নিজের জন্য না। বাঁধন ও আমার অন্য সহযাত্রীদের নিয়ে ভয়। হুট করে নিয়ে এসেছি এই জঙ্গলে। আবার ফিরিয়েও আনতে হবে, অক্ষত অবস্থায় বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কী জবাব দিবো?
বাঁধনের কী অবস্থা? ভয়ে পাইছো? বাধন বললো, না ভাই। আপনি সামনে আছেন ভয় কীসের? বললাম, আমি যে সাঁতার জানি তাতে নিজেকে বাঁচানোই মুশকিল। নৌকা ডুবলে তোমাকে বাঁচাবো কী করে? বাঁধন বললো, পানির বোতলগুলো ধরে ভেসে থাকবো ভাই। দেখলাম একটি পাঁচ লিটারের পানির বোতল কোলে নি্রযে বসে আছে সে। বললাম, বোতলগুলো পানিতে ভরা। ওগুলো ভাসবে না। একটা বোতলের পানি ফেলে দাও। সেটা ধরে বসে থাকো।
আলমগীর ভাইকে বললাম, নৌকায় ভেসে থাকার মতো কিছু রাখেন না ভাই? বললেন, এই বাদায় ওসব চলে না। এআ নৌকা শক্ত আছে, ডুববে না ভাই। আপনারা একটু চুপচাপ বসেন তো! আরও মেলা পথ যেতে হবে। তখন রাত দশটার মতো বাজে। আলমগীর ভাইয়ের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এর কারণ টের পেলাম কিছুক্ষণের মধ্যে। জোয়ার শুরু হয়েছে। মানে পানির স্রোত দক্ষিণ থেকে উত্তরে। আর মালঞ্চে এসে আমরা দক্ষিণে রওনা হয়েছি। অর্থাৎ আবার উজান ঠেলতে হচ্ছে আমাদের। তার মানে আবার কষ্ট বাড়লো সামনে পিছনের দুইজনের।
কোন খালে থাকবে ওরা? মানে বনদস্যুদের বহর থাকবে কোথায় বলেছে? আলমগীর ভাই বললেন, নদীর পশ্চিম পাশ ধরে যেতে বলেছে। আমাদের দেখলে ডেকে নিবে।
(ছবি: মালঞ্চ নদী, পশ্চিম সুন্দরবন)