খালের আগায় নৌকায় বসা দস্যুনেতা মজনু, চারপাশে সশস্ত্র পাহাড়া! | রূপান্তরের গল্প ১৪৪ | Rupantorer Golpo 144 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৪৪ : অন্ধকার সুন্দরবন। ছোট্ট খাল- ছোট হাতিভাঙ্গার আগায় আমরা। সেখানে নৌকা বহর নিয়ে বসে আছেন সুন্দরবনের কুখ্যাত জলদস্যু নেতা মজনু। সুন্দরবনের জেলেরা কেউ ডাকে মজনু সাহেব, কেউ বলে মনজু সাহেব। এই নাম জটিলতায় মজনুর নামে করা আগের কিছু দস্যুতার মামলাও জটিলতায় পড়েছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসি।
খালে ঢোকার পর বনদস্যু এনামুল বলছিলো সামনেই আছে সাহেবরা। মানে দস্যুনেতা ও তার সঙ্গীরা। মিনিট পাঁচ চলার পর বললাম আর কতো দূর? নৌকার তলা ঠেকে যাচ্ছে তো। ডানে বামের জঙ্গলও কাছে চলে এসেছে। মানে খালটি আবারও সরু হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আড়াআড়ি ভাবে পড়ে আছে ভাঙ্গা কেওড়া গাছ। দুই দফা বাইন গাছের ডালের সঙ্গে ধাক্কাও খেলাম। নৌকা নিয়ে যাচ্ছি আর ভাবছি, কেউ যদি নিশ্চিত জানে যে মজনু বাহিনী এই খালে আছে, তবুও অভিযান চালিয়ে তাদের ধরতে পারবে কেউ?
চ্যালেঞ্জগুলো বলি। প্রথমে জানতে হবে কোথায় আছে দস্যুরা। সেই পর্যন্ত দ্রুত পৌঁছাতে হবে, অভিযানের খবর কেউ জানবে না, সঠিক খাল চিনতে হবে, দস্যুদের সম্ভাব্য পালানোর খালগুলো সম্পর্কে জানতে হবে, সেসব খালে অবস্থান নিতে হবে। জোয়ারে খাল ভরা পানি থাকতে হবে। স্টিডবোট বা ট্রলার এসব খালে ঢুকবেও না। তারপর নি:শব্দে তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে।
এখন সমস্যা হলো সঠিক জায়গার খবর জানবেন কী করে? সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওখানে যাবেন কী করে? আপনি তো খাল চিনেন না। সোর্স একটু এদিক সেদিক করলেই শেষ। স্পিডবোট বা ট্রলারে আসলে শব্দ হবে। নিঃশব্দে আসতে হলে ডিঙ্গি নৌকায় আসতে হবে। ওই ছোট নৌকায় কয়জন আসবেন? কয়টা নৌকা নিয়ে আসবেন? নৌকা নিলে আপনাকে মাঝিও নিতে হবে দুইজন করে। তারা বিশ্বস্ত নাও হতে পারে। আবার তাদের সাথে করে নিয়ে আপনি সশস্ত্র দস্যুদের সাথে গোলাগুলি করবেন কী করে? ওদিক থেকে গুলি হলে তো সামনের জেলেরা মারা পড়বে? জবাব দিতে পারবেন? আবার ওদিকেও তো সাধারণ জেলেরা থাকতে পারে, অপহৃতরা থাকতে পারে। না জেনে গুলি করতে পারবেন?
সব কাটিয়ে না হয় পৌঁছালেন খালের মুখ পর্যন্ত। সেখানে ও আশেপাশে জঙ্গলের ভিতরে পাহাড়া থাকে। আপনি তাদের দেখতে পাবেন না। কিন্তু আপনাকে তারা দেখে ফেলবে, দৌড়ে ভিতরে খবর দিবে। বিকল্প খাল দিয়ে তারা বেরিয়ে পড়বে অথবা জঙ্গলে উঠে হাঁটা দিবে। আপনি কি ওদের সাথে সুন্দরবনের ভিতরে দৌড়ে পারবেন? ওরা থাকবে গাছের আড়ালে। আর আপনি থাকবেন খেলা জায়গায়। আপনাকে দেখছে দস্যুরা, আর আপনি তাদের দেখছেন না। আপনি কোনো না কোনো ঘাট থেকে নৌযান নিয়ে রওনা দিবেন অভিযানে। সেখানেও দস্যুদের সোর্স আছে। ট্রলার ও স্পিডবোট চালকদের কেউ কেউ অভিযানের খবর জানিয়ে দেয়। তখন লটবহর নিয়ে সঠিক জায়গায় গেলেও বনদস্যুদের আর খুঁজে পায় না আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
গহীন বনে ঢুকে বনদস্যুদের খুঁজে বের করা, তাদের আইনের আওতায় আনা বেশ কঠিন, চ্যালেঞ্জে ভরপুর। অবশ্য বনদস্যু-জলদস্যু নিধনে চলমান অভিযানগুলো দস্যুদের কোণঠাসা করেছে। সে কারণেই তারা আত্মসমর্পণের সুযোগটি নিতে চাচ্ছে। গল্পে ফিরি।
এনামুল ও তার সাথের দস্যু আমাদের বাম পাশ ধরে হাঁটছে। ছোট হাতিভাঙ্গা খালটি ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। আমাদের নৌকা ঠেকে গেছে কাঁদায়। আধা জোয়ারে পানি কিছুটা বেড়েছে বলে এটুকু আসতে পেরেছি। নৌকা নিয়ে মজনু বাহিনীর আস্তানা পর্যন্ত যেতে অপেক্ষা করতে হবে। বললাম, পানি না বাড়া পর্যন্ত এখানে আটকে থাকবো? পিছন থেকে কাঁদায় নেমে পড়লেন আলমগীর ভাই। ধমক দিয়ে নামালেন মাঝি ভাইকেও। একটা গালি দিয়ে বনদস্যু দুইজনকে নৌকা ধরতে বললেন। এরপর চারজন মিলে ঠেলা শুরু করলো। কাঁদার উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নৌকা।
আরও দশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। এর মধ্যে ভাঙ্গা গাছ সরিয়ে নৌকাটি এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তখন জঙ্গল দিয়ে অর্থাৎ ডাঙ্গা দিয়ে হেঁটে আমাদের এগিয়ে নিতে আসলো রহমত নামের এক দস্যু। বললো, আরেকটু সামনে গেলেই পানি পাবো আমরা। প্রায় একশ’ মিটার পর পানিতে ভাসলো নৌকা। কাঁদা পানি থেকে উঠে নৌকায় বসলেন মাঝি ও আলমগীর ভাই। বৈঠা বেয়ে এগুচ্ছি আমরা। সামনে ছোট ছোট আলো জ্বলছে। কয়েকটি নৌকা পাশাপাশি রাখা। ওরাই মজনু বাহিনী।
পৌঁছে গেলাম। আমাদের নৌকা ভিড়লো বনদস্যুদের বহরে। তিনটি ডিঙ্গি নৌকা পর পর রাখা। ১৫/২০ জন সশস্ত্র সঙ্গী নিয়ে মজনু সেখানে অপেক্ষায়?
একটু হতাশই হলাম। এতো বড় দস্যুদল ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে সুন্দরবনে দস্যুতা করছে? নাকী এরা আমাকে এগিয়ে নিতে এসেছে? মজনুর মতো ডাকসাইটে দস্যুনেতার তো ডিঙ্গি নৌকায় থাকার কথা না! হয়তো আশেপাশে কোথাও ওদের ট্রলার রাখা! প্রথম নৌকায় থাকা বনদস্যুরা সালাম দিলো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম নৌকায়। প্রায় পাঁচ ঘন্টা টানা বসে থেকে কোমড় আর পা ব্যাথা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস পথে বৃষ্টি হয়নি। তাহলে কষ্ট আরও বাড়তো। আলো আঁধারিতে সবার চেহারা বুঝতে পারছি না। ওরা হাত বাড়িয়ে দিলো। করমর্দন করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, মজনু ভাই কই? বহরের মাঝের নৌকা থেকে সালাম দিলো মজনু। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না তাকে। মাঝের নৌকার পাটাতনের তক্তার উপর বসে আছে মজনু। হাতে একটি দোনলা বন্দুক। তার চারপাশে চারজন তরুণ সশস্ত্র যুবক দাঁড়ানো। প্রত্যেকেরই আঙ্গুল বন্দুকের ট্রিগারে। দস্যুদের প্রথম নৌকায় উঠে মজনুর নৌকায় উঠতে উঠতে বললাম, আপনারা সবাই ভালো? সবাই একসাথে বললো, ভালো আছি ভাই। আপনি ভালো? বললাম, ভালো নাই। ছয় ঘন্টা হয়ে গেছে চা খাই না!
মজনু বললেন, এই চুলা জ্বালাও। পাশ থেকে রহমত বললো, ও ভাই, আমাদের এখানে কিন্তু দুধ চা হবে না। আপনি তো আবার দুধ চা খান। বললাম, আপাতত জীবনটা বাঁচাও তোমরা। চুলা জ্বালাও।