মজনু ডাকাতের ভাসমান ডেরা-নৌকা বহর | রূপান্তরের গল্প ১৪৫ | Rupantorer Golpo 145 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৪৫ : জঙ্গলের লোকজন র’ চা খায়। কড়া লিকার। গরম পানিতে একগাদা চা পাতা ঢেলে দেয় তারা। তারপর বেশ কিছুক্ষণ জ্বাল দিয়ে একদম কালো বানিয়ে ফেলে চা। কাঁচের কাপে নিলে এপাশ ওপাশ দেখা যায় না। এর সাথে বেশি করে চিনি দিয়ে যে চা বানানো হলো তা খেয়ে মাথাটা চক্কর উঠলো। প্রথম চুমুকের পরই ফিরিয়ে দিলাম কাপ। বললাম, একটু হাল্কা লিকার করে দেওয়া যায়? সাথে সাথে চুলার সামনে বসে থাকা ছেলেটি বললো, এখনই দিচ্ছি ভাই। একটু বসেন।
আমি বসা বনদস্যুদের মাঝের নৌকাটিতে। অন্যগুলোর থেকে এটি একটু বড়। ঠিক মাঝখানে নরম তোষক বিছানো। দুই পাশে কাঠের পাটাতন। ছিমছাম সাজানো নৌকাটি দস্যুনেতার। মুখোমুখি বসা মজনু আর আমি। বললাম, আপনি তো এমনিতেই ভালো ছিলেন। নতুন করে ডাকাতি করতে নামলেন কেন? বললেন, পালায়ে থাকবো কতো বছর? নিজের বাড়ি আছে খুলনায়। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে। তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। কিন্তু বাপের পরিচয় তো দিতে পারে না। আর আমি তো স্বেচ্ছায় সুন্দরবনে ডাকাতি করতে আসিনি। পরিবেশ পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে। বললাম কাল সারাদিন আছি। এসব গল্প শুনবো। তার আগে বলেন, সত্যি সত্যি আত্মসমর্পণ করবেন? লোকে কিন্তু ভিন্ন কথা বলে!
মজনু বললেন, আমার শত্রু বেশি ভাই। এই জঙ্গলে অনেকে ডাকাতি করে গেছে। বড় বড় লিডারর হয় ক্রসফায়ারে মরছে, অথবা নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে। যারা পালিয়ে বেঁচে আছে তাদের বেশির ভাগই পরিচয় লুকিয়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়। পালিয়ে ভারতে গেছে যারা তাদের মধ্যে রাজু আর ইলিয়াস ছাড়া আর কেউ ভালো আছে? দেখাতে পারবেন? সবাই দিনমজুরি করে চলে। দুই বেলার খাবার জোগাড় করতে কেউ ভ্যানগাড়ি চালায়। কেউ আবার ওপাশের সুন্দরবন উপকূলে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে থাকে। সময় সময় নেমে ডাকাতি করে। আবার উঠে যায়।
জোনাব, আমীর, জিয়া, মাসুম, কাজলেরা তো এভাবেই চলে। এদের মধ্যে আমি একটু ভালো আছি। নিজের কিছু ব্যবসা আছে। খুলনায় জমি-বাড়ি আছে। সুন্দরবনে আমার নামে একটা ডাকাত দল চলে। আমার অস্ত্রসস্ত্রও তো আছে কোটি টাকার। এগুলো বিক্রি করে দেশান্তরী হতে পারি। কিন্তু ওই জীবন আর ভালো লাগে না ভাই। এখন সারেন্ডারের সুযোগ আসছে। এই সুযোগ কাজে না লাগালে আর বাঁচবো কী করে? বললাম, অস্ত্রগুলো তো আপনি বিক্রি করে দিচ্ছেন শুনলাম।
বললাম, সত্যি করে বলেন তো ভাই, অস্ত্র-গুলিগুলো বিক্রি করছেন কী না? মজনু বললেন, সব অস্ত্র বিক্রি করলে সারেন্ডার করবো কী নিয়ে? ওই নোয়া মিয়া কান্নাকাটি করতিছে। মাস্টার তার সবগুলো অস্ত্র নিয়ে গেছে। এখন জঙ্গলে টিকে থাকতে হলেও কিছু মেশিন দরকার, গুলির দরকার। বললাম, তার দরকার সে বুঝবে। আপনাকে তো অস্ত্র বিক্রি করতে বলিনি। বলেছি, অস্ত্র আর গোলাবারুদ যা আছে, যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। এই অবস্থাতেই আপনাকে সারেন্ডার করতে হবে। মাঝখানে আর কোনো কথা বললে হবে না।
মজনু বললেন, অস্ত্র তো ভাই বিক্রি করিনি। এমনিতেই তাকে সহযোগিতা করছি। বিশ্বাস না হলে কালকে ফোনে নোয়া মিয়ার সাথে কথা বলিয়ে দিবো। বললাম এখন একটু চেষ্টা করেন। দেখেন পান কী না। আপনাদের এই বিষয়টিতে কোনো গ্যাপ রাখতে চাই না। বনদস্যুরা সারেন্ডার করবে। আমার মাধ্যমে করতে গেলে শর্ত একটাই। অস্ত্র-গুলিগুলো সব জমা দিতে হবে। একটা গুলির খোসাও জঙ্গলে রেখে যাওয়া চলবে না।
রহমতকে ডাকলেন মজনু। বললেন, ফোনটা খুলে দেখো নেট পাও কী না! পেলে নোয়া মিয়ার ফোনে ফোন লাগাও। এই রাতে ফোনে পাওয়ার কথা না। তবুও ভাই বলছেন যখন তখন একটু চেষ্টা করো। রহমত একজন তরুণ বনদস্যু। আগে দেখিনি। বয়স খুব বেশি হলে ২৫। হাল্কা গড়নের ছোট-খাটো ছেলেটি মজনু বাহিনীর মুহুরি, অর্থাৎ ম্যানেজার। পোসেস থেকে ফোন বের করলো সে। অন করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই নেটওয়ার্ক আসলো। কয়েক বার চেষ্টা করও নোয়া মিয়াকে পাওয়া গেলো না। তারপর মিসড কল অ্যালার্ট চেক করে রহমত জানালো ইয়াকুব সাংবাদিক ফোন দিছে। ইয়াকুব (ছদ্মনাম) সাংবাদিককে দেখিনি। তবে ফোনে তার সাথে কথা হয়েছে কয়েকবার। বাড়ি ওদিকেই। কোন পত্রিকার সাংবাদিক জানি না। তবে বন উপকূলে কাজ করতে গেলে তার নাম শোনা যায়।
ফোন দিতেই রিং ঢুকলো। বাটন ফোনে লাউড স্পিকার দেওয়া। ওপাশ থেকে ফোন ধরলেন সাংবাদিক ভাই। বললেন, মজনু ভাইয়ের সাথে কথা বলতে চান। মজনু বললেন, লাউডে দেওয়া ফোন। সাংবাদিক সাহেব বললেন, ও ভাই, মোহসীন ভাই নাকী সুন্দরবনে ঢুকছে? শুনলাম কোনো ডাকাত বাহিনীর কাছে গেছে? সে তো মাস্টার বাহিনীকে সারেন্ডার করাইছে। এবার পশ্চিম বাদায় আসছে। মজনু বললেন, আপনি সিওর মোহসীন ভাই ঢুকেছেন বনে? ওপাশ থেকে ইয়াকুব ভাই বললেন, একশ’তে একশ’। সন্ধ্যার পর মুন্সিগঞ্জ থেকে রওনা দিছে। এরপর কোন দিকে গেছে জানি না। আমি শুনছি কথোপকথন। মনজু বললেন, ও ভাই, মোহসীন ভাই এখন আমার এখানে। নেন কথা বলেন।
সালাম দিয়ে কথা শুরু করলাম। বললাম, কেমন আছেন ভাই? বললেন, আমি ভালো আছি ভাই। আপনি ভালো? বললাম, ভালো না থাকলে এ পর্যন্ত আসা যায়? বললাম, কোথায় আপনি? বললেন, বড় হাতিভাঙ্গায় ভাই। আপনাদের পাশের খালে। বললাম, এই রাতে জঙ্গলে কী করতে আসছেন? বললেন, মাছ মারতে আসছি ভাই। আমার একটা জাল-নৌকা আছে।
গোনমুখ আসলেই জেলেরা আসে, সঙ্গে আমিও আসি। নিজেই জাল ধরি সুন্দরবনে। অবাক হলাম, বললাম, আপনি না সাংবাদিক? বললেন, এই অঞ্চলে সাংবাতিকের কাজ করে পেট চলে ভাই? বললাম, তাই বলে জঙ্গলে মাছ ধরবেন? বললাম, আপনি তো পাশের খালেই আছেন। মজনু ভাইয়ের এখানে আছি আমি, চলে আসেন। এবার একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ইয়াকুব সাংবাদিক। বললেন জোয়ার তিনপোয়া হয়ে গেছে ভাই। আমার একটু জাল টানতে যাওয়া লাগবে। বিদায় দিলাম আমি। মজনুকে তিনি বললেন, ভাই কিন্তু আমাদের খুব সম্মানী লোক। আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি থাকে না যেন। মজনু বললেন, ভাবছিলাম হরিণ মেরে খাওয়াবো। কিন্তু মোহসীন ভাই তো হরিণ খায় না। আসার আগে শিকার করতে নিষেধও করছেন। সেজন্য একটা ছাগল আনাইছি।
মজনু বলছেন, কেবল গোন শুরু হলো। জেলেরা নামবে আজ রাতে। তুমি জাল ধরো। বড় মাছ পেলে জানিও। মজনু বললেন, আমরা রাতের জোয়ারে জায়গা বদল করবো। কালকে নেট পেলে কথা হবে। বড় মাছ পেলে নিয়ে আসবে। ভাইকে কিছু বড় মাছ, চিংড়ি মাছ দিতে হবে না? আমি বললাম, মাছ লাগবে না ভাই। সম্ভব হলে কাল দেখা করবেন। কথা শেষে ফোন বন্ধ করতে বললাম। কারণ এই ইয়াকুব ভাই যখন আমার বনে নামার খবর জানেন তখন আরও অনেকেই খবর পেয়ে গেছেন। পুলিশ, RAB বা কোস্টগার্ড এই নাম্বার ধরে আমাদের অবস্থান জেনে গেলে সর্বনাশ হবে।
ভাবছি বনদস্যু মজনুর সাথে ইয়াকুব সাংবাদিকের সম্পর্ক কী? কিছু সাংবাদিকের সুন্দরবনে ব্যবসা আছে জানি। কিছু নামধারী সাংবাদিক সুন্দরবনের দস্যুদের কাছে থেকে সুযোগ সুবিধাও নেয়। কিন্তু কেউ নিজে জঙ্গলে নেমে জাল টানেন, মাছ ধরেন, রীতি মতো জেলেদের মতো, ভাবতে পারিনি।
অবশ্য ভাবনার চেয়ে অনেক বেশি ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি সুন্দরবনে। অনেক নতুন নতুন বিষয় জানছি। আবার অনেক ভুল ধারণাও ভাঙ্গছে দিনে দিনে। যাই হোক, দাপুটে বনদস্যু মজনু বাহিনীর ডেরায় পৌঁছে গেছি। সুন্দরবনের দস্যুরা এখন স্থায়ী আস্তানা করে না। নৌকা বা ট্রলারে থাকে। এগুলোকে ভাসমান ডেরা বলা যায়। বর্তমানে পশ্চিম সুন্দরবনের ছোট্ট খাল ছোট হাতিভাঙ্গায় আছি। পুরো জোয়ার হতে আরও ঘন্টা খানেক লাগবে। তারপর খাল থেকে বের হয়ে ভাটি দিবো। দিনের আলো ফোটার আগে ঢুকে পড়বো অন্য কোনো খালে। যেখানে ঝামেলা হলে নিজেদের আড়াল করার সুযোগ থাকবে। প্রয়োজনে পালানোর জন্য ভাড়ানী ও খাল থাকতে হবে, এমন খাল খুঁজবো আমরা। কাল সারাদিন সেখানেই থাকবো।
সশস্ত্র বনদস্যুদের সাথে সুন্দরবনে সময় কাটানো বেশ রোমাঞ্চকর। তবে ঝুঁকি অনেক। জীবনটাকে হাতে নিয়ে চলতে হয়। মজনু বাহিনীর অস্ত্র-গুলির অভাব নাই। তবে যতোটুকু জানি, এই দলে বন্দুক যুদ্ধ করার মতো দক্ষ বনদস্যু নাই।