রূপান্তরের গল্প ১৪৬ | Rupantorer Golpo 146

রওনা হলো দস্যুবহর, যাচ্ছি কালির খাল | রূপান্তরের গল্প ১৪৬

রওনা হলো দস্যুবহর, যাচ্ছি কালির খাল | রূপান্তরের গল্প ১৪৬ | Rupantorer Golpo 146 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৪৬ : খালের মুখে পাহাড়ায় আছে কেউ? বড় নদীতে নজর রাখা হচ্ছে তো? জানতে চাইলাম। বললাম, মাস্টারের সাথে দেখা করতে গিয়ে ঝাইলোর খালে গোলাগুলিতে পড়ছিলাম। টাওয়ারের ওরা অসতর্ক ছিলো সেদিন। কোনো রকমে প্রাণে বেঁচেছিলাম। দস্যুরা বললো, খালের মুখে শুধু না, জায়গায় জায়গায় লোক আছে। লোকালয় থেকে কেউ আসলে কদমতলা থেকে জানায়ে দিবে, তারও আগে মুন্সিগঞ্জ ঘাটেও আমাদের লোক আছে।

বললাম, কলাগাছিয়া বা দোবেঁকীর ওদিক থেকে কেউ আসলে? বললো, টাওয়ার থেকে সব দেখা যাবে। বনদস্যুদের টাওয়ার মানে হলো মাচা। বড় বাইন বা কেওড়া গাছের উপর গাছ কেটে মাচা বানানো হয়। সেখানে বসে দূরে নজর রাখা, পাহাড়া দেওয়া যায়। মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্কও থাকে সেখানে। বললাম, ঢোকার সময় টাওয়ার তো দেখলাম না। বললো, আশে পাশে জায়গায় জায়গায় মাচা করা আছে। বড় নদী থেকে হুট করে দেখা যায় না। ওই টাওয়ারগুলোর আশেপাশেই নোঙ্গর করে দস্যুরা।

নৌকায় বসে মজনুর সাথে কথা বলছিলাম। ওদিকে আমাদের নৌকা থেকে বাজার-সদা আর ছাগলটি পার করে নিলো দস্যুরা। সেই কাজ তদারকি করছেন আলমগীর ভাই। দস্যুদলের সবাইকে চিনেন তিনি। প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে ডাকছেন। ওরাও উত্তর দিচ্ছে। আমার সহযাত্রীরা তখনও ওই নৌকাতেই বসা। বললাম, তোমরা একটু উঠে দাঁড়াও। নড়াচড়া না করলে কেমন করে হবে?

নড়াচড়া করবে কী ভাবে? জায়গা কোথায়? ডিঙ্গি নৌকা থেকে বাজার সরানোতে কিছু জায়গা বের হয়েছে। আমি চলে এসেছি মজনুর নৌকায়। ওরা শুয়ে বসে আরাম করছে। নিজাম ভাই আর রাজীব ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমাক। এই জঙ্গলের ভিতরে কিছু করারও নাই এখন। জোয়ারের পানিতে ভরে গেছে খাল। দুই পাশের ডাঙ্গায়ও এক হাঁটুর বেশি পানি। কাঁদা, কাঁটা, ঝোপ ঝাড় মিলিয়ে ওখানে আর ওঠার সাহস করিনি। বনদস্যু রহমত বললো, একটু পরেই রওনা দিবো আমরা। নিচের দিকে যাবো, পরিস্কার দেখে একটা জায়গায় থাকবো কাল সারাদিন। ওখানে মনের মতো করে হেঁটে বেড়াতে পারবেন।

রাত দুইটার মতো বাজে। খাল ছাড়ার তোড়জোড় চলছে। বললাম, আপনারা রাতের খাবার খাইছেন? বললো, সন্ধ্যার আগেই খাওয়া দাওয়া কমপ্লিট। বললাম, ভাত আছে? ক্ষুধা লাগছে। সেই ইফতারের সময় একটু খেয়েছি। তারপর আর পেটে কিছু পড়েনি। কিছু একটু খাওয়া দরকার। বাবুর্চি জানালো, ভাত-তরকারি তো শেষ। বললো ভাত চড়াবো এখন? বললাম, না থাক। অন্য কিছু থাকলে দাও। নৌকার পাটাতনের নিচ থেকে একটা ব্যাগ বের করলেন মজনু। বিস্কিটের প্যাকেট বের করে দিলেন। বললেন, আমরা দুই বেলা ভাত খাই। সকালে আর দুপুরে। অন্য সময় চা-বিস্কিট অথবা মুড়ি। এরা ট্রলার নিয়ে চলে না। তাই সাচ্ছন্দ বলতে বেশি কিছু নাই।

একটু অধৈর্য আমি। বললাম, চলেন রওনা দেই। রহমত বললো, খালের মাথা থেকে একজন আসবে। ওদিকের খবর জানাবে তারপর আমরা নৌকা ভাসাবো। এদিক থেকে কুঁই দিলো একজন। ওপাশ থেকে উত্তর আসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে এক দস্যু এসে জানালো বড় নদী ক্লিয়ার।

দস্যুদের তিনটি আর আমাদের একটি নৌকা। চার নৌকার বহর ভাসলো খালে। শুরুতে দস্যুদের একটি নৌকা। তারপর দস্যুনেতার নৌকা, যেটিতে আমিও বসা। তারপর আমাদের নৌকাটি। শেষে দস্যুদের আরেকটি নৌকা। ভরা জোয়ার বলে খাল থেকে বের হতে সমস্যা হচ্ছে না। নদীর মুখে আসতেই বনের ভিতরে কী যেন নড়েচড়ে উঠলো। খট করে শুকনো কাঠ ভাঙ্গার শব্দ হলো। মুহুর্তেই সবাই সতর্ক হলাম। বন্দুক হাতে নেমে পড়লো এনামুলসহ দুই জন। অন্যদের আঙ্গুল ট্রিগারে। বুকটা ধকধক করছে। আমি ভাবছি কেউ আসলো না তো? আর ওরা ভাবছে বাঘ আসলো নাকি?

মিনিট দুই পর ফিরে আসলো দস্যুরা। কী ওটা এনামুল? বললো, মনে হয় জনিবন্ধু। সে আবার কে? নৌকার দস্যুরা হেঁসে উঠলো। বললো, জঙ্গলী শুকরকে আমরা জনিবন্ধু বলি। সিওর তো? মানুষ বা বাঘ না তো? ওরা বললো, বিশাল একটা মহিষের সমান বন্যশুকর আছে ওখানে। আমাদের দেখে একটু সরে দাঁড়িয়েছে। আর আমরাও ভয়ে ফেরত আসছি।

মজনু বললেন, এই জঙ্গলের বাঘেরও ধর্ম আছে, কিছু নিয়ম মানে তারা। কিন্তু শুকরেরা কখন যে কী করবে কেউ জানে না। আর বড় শুকরগুলো বাঘের চেয়ে হিংশ্র হয়। ওদের সাথে ঝামেলা করে পারা যায় না। বললাম, হাতে বন্দুক থাকলেও ভয়? ঢাঙ্গা থেকে নৌকায় উঠতে উঠতে এনামুল বললো, জনিবন্ধু অ্যাটাক করলে বন্দুক তোলার সময় পাবেন না মামা। আর ওদের গায়ে এতো শক্তি যে গুলি কয়টা লাগলেও আপনাকে আক্রমণ করবেই। আপনাকে টারগেট করলে ও মরতে মরতে হলেও চড়াও হবে। খুব ভয়ঙ্কর এই শালারা! বললো, সুন্দরবনে আসলে শুকরদের এড়িয়ে চলবেন মামা। এদের বিশ্বাস নাই।

সবাই নৌকায় উঠলো। দুই পাশ ভালো করে দেখে মালঞ্চ নদীতে উঠলাম। তখন ভাটা শুরু হয়ে গেছে। মানে পানির স্রোত দক্ষিণমুখী। আমরাও নামবো ভাটিতে, মানে দক্ষিণে।

কতদূর যাবো আমরা? জানতে চাইলাম মজনুর কাছে। বললেন, আপাতত কালির খালের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা। কালির খাল? সেটা তো সেই শিবসার বাওনে, নিশানখালীর ওখানে! এনামুল বললো, না মামা। এটা সেই কালির খাল না। মালঞ্চের বাওনের খাল। ঘন্টা খানেক লাগবে যেতে।

আগাচ্ছি আমরা। নৌকা চলছে একটার পিছনে একটা একটা। বইঠা বেয়ে যাচ্ছি কিন্তু বৈঠার শব্দ নাই বললেই চলে। বুঝলাম বনদস্যুদের বহর চলছে। মানে নিঃশব্দে চলার চেষ্টা। এমন ভাবে বৈঠা বাইছে সবাই যেন শব্দ না হয়। বেশি শব্দ হলে দূর থেকে তাদের অবস্থান জেনে যাবে অন্যরা।

ডানপাশে একটা মাঝারি আকারের খাল পড়লো। জিজ্ঞেস করলাম, কোন খাল এটা? মজনু বললেন, এটা ইয়াকুব সাংবাদিকের খাল। মানে বড় হাতিভাঙ্গা। বললাম, এখন ঢুকলে পাবো তাকে? বললো, পাবেন না ভাই। ভিতরের কোনো জোলা খালের আগায় থাকবে। জোলা খাল মানে খুব ছোট খাল। হুট করে খুঁজে পাবো না।

ইয়াকুব সাংবাদিককে এক নজর দেখার ইচ্ছা আমার। এরকম সাংবাদিক কাম জেলে সুন্দরবন ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না। নৌকা এগিয়ে চললো মালঞ্চের পশ্চিম পাশ দিয়ে একদম জঙ্গল ঘেঁষে। এই সফরে চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া নিয়ে একটু কষ্ট হচ্ছে। আমার জন্য সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো দুধ চা নাই। আগামী দুই দিনও পাবো না। আমার আবার নেশা দুধ চায়ের। মনে মনে ভাবলাম এরপর জঙ্গলে নামার সময় নিজেই এক প্যাকেট গুঁড়া দুধ কিনে রাখবো।

সামনে বেশ কয়েকটি পাশ খাল আছে। সেখানে অন্য দস্যুদল থাকতে পারে। তাই আমরা উঠবো মাঝ নদীতে। বন্দুকের গুলির রেঞ্জ এর বাইরে দিয়ে চলতে হবে। নৌকায় কোনো আলো জ্বলবে না। কথাবার্তাও বলা যাবে না সামনের পথটুকুতে।

আহ্নি ঘুরলো নৌকার। যাচ্ছি মাঝ মালঞ্চে। আমার মাথায় ওই বড় হাতিভাঙ্গা খালের ইয়াকুব সাংবাদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এই উপকূলে সাংবাদিকের অভাব নাই। কে কোন পত্রিকা বা টেলিভিশনে কাজ করে বোঝা মুশকিল। কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক আছেন উপজেলা পর্যায়ে। আর জেলা পর্যায়ে আছে টেলিভিশনগুলোর একজন করে প্রতিনিধি। অথচ বন উপকূলের গ্রামে গ্রামে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া মানুষের অভাব নাই। কিন্তু সুন্দরবন নিয়ে সংবাদ দেখি না। এই যে বনদস্যুদের দাপট, জেলেদের ওপর তাদের অত্যাচার নির্যাতন, বন বিভাগের অনিয়ম, মহাজনের নিপীড়ন, অবৈধ সূদের কারবারীদের দৌরাত্ব নিয়ে তাদের কাজ সেভাবে দেখি না। বরং কিছু সাংবাদিক রীতিমতো ব্যবসা করেন সুন্দরবনে, তারা প্রভাবশালীও।

সাংবাদিক ব্যবসা করতে পারবেন না তা নয়। কিন্তু এই জঙ্গলে মাছের ব্যবসা সাধারণ বিষয় না। বনদস্যুদের সাথে বন বিভাগের লোকজনদের সাথে বিশ্বস্ততা ও লেনদেনের সম্পর্ক না থাকলে সুন্দরবনের ব্যবসায়ী হওয়া যায় না। এছাড়া নামের সাথে সাংবাদিক থাকলে লোকালয়ে বেশ ছাড়ও পাওা যায়। বাড়তি কিছু সুযোগও থাকে।

মনে পড়ে গেলো রামপালের হাকিম ভাইয়ের কথা। হাকিম সাংবাদিক নামে রামপাল-মংলার ওদিকে পরিচিত তিনি। আমার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক। স্থানীয় সাংবাদিক তিনি। আবার সুন্দরবনেও আছে বড় ব্যবসা। মংলায় মাছের আড়তে প্রতিদিন বড় বড় মাছের চালান ওঠে তাঁর।

রাজু ডাকাতের আমলে অর্থাৎ ২০১১/১২ সাল পর্যন্ত মধ্য সুন্দরবন ছিলো হাকিম সাংবাদিকের দখলে। পশুর আর শিবসা নদীর মাঝের খাল-নদীতে জেলেদের সাথে দেখা হলেই বলতো তাদের মহাজন হাকিম সাংবাদিক। রাজু’র পর শহীদুল যখন দস্যুনেতা, তখন সেই জায়গায় ব্যবসা করতো মনা নামের এক সোর্স কাম ব্যবসায়ী। মনা আমারও সোর্স ছিলেন। ছিলেন RAB, কোস্টগার্ড, পুলিশ, নৌ পুলিশেরও সোর্স। বন বিভাগকে চাপে রেখে মাছের ব্যবসা চালাতেন তিনি। ক্রসফায়ারে শহীদুলের মৃত্যুর পর ইলিয়াস যখন নেতৃত্বে আসে তখন সেই মনা সাহেবকে বিদায় নিতে হয়।

বহুমুখি আচরণ ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ইলিয়াস এই মনাকে খুব অপছন্দ করতো। সেই জায়গায় আবার হাকিম সাংবাদিক দখলে নেন। আত্মগোপনে থাকা রাজুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো তাঁর। সুন্দরবনের জোংড়া, ঝাপসি, মরাপশুর, ভদ্রা, আদাচাই, নিশানখালী, ইলশেমারী, পাশাখালী অঞ্চলে প্রচুর মাছ হয়। তাই এই জায়গা দখলের লড়াই চলে মাছ ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কে কোথায় ব্যবসা করবে তা নির্ধারণ করে বড় দস্যুদলগুলো।

সুন্দরবনে তখন বন বিভাগের কর্তৃত্ব বলে কিছুই ছিলো না। এদিকের সুন্দরবন কার কার দখলে আছে জানা নাই এখনও। খোঁচ খবর নিতে শুরু করেছি, জেনে যাবো কিছুদিনের মধ্যে। কারণ বনদস্যুদের অত্যাচার নিয়ে অভাব অভিযোগ আর কান্নাকাটি করলেও তারাই দস্যুদের প্রধান সহযোগী, এক রকমের পার্টনারশিপে চলে সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়ার ব্যবসা। তখন শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনীর এক সাংবাদিকের নামও শুনছিলাম। সপরিবারে অবৈধ পারশে মাছের পোণার ব্যবসা করতেন তিনি। পোণার ব্যবসাও কোটি টাকার।

যে ব্যবসায়ীরা সুন্দরবনে মাছ ধরার কারবার করেন, তাঁদের সঙ্গে বনদস্যুদের নিবিড় সম্পর্ক দেখেছি। সত্যি বলতে বনদস্যুদের সাথে সেরকম সম্পর্ক ছাড়া সুন্দরবনে ব্যবসা করার সুযোগ নাই। লেনদেন বা অন্য কোনো সম্পর্কের সূত্র ধরে এসব হয়। এবিষয়ে এখনও খুব বেশি জানি তা না, তবে জানছি ধীরে ধীরে। পুরোটা বুঝতে সময় লাগবে।

মজনু বাহিনীর নৌকা বহর মাঝ নদীতে চলে এসেছে। মাঝখান দিয়েই আগাবো আমরা যাতে দুই পাশের জঙ্গল থেকে কেউ গুলি করলেও আমাদের নাগাল না পায়। ভাটার স্রোত আর দখিণা বাতাসে পানি বেশ গরম। ছোট ছোট নৌকাগুলো নিয়ে তাল সামালানো যাচ্ছে না। আরেকটু বাতাস বাড়লে ডুবে যেতে পারি। মজনু বললেন, নদীর পূর্ব ধরো সবাই। কোনো রকমে পাড়ি দিলাম নদী। তারপর একটা খালে ঢুকলাম। আমরা এইখাল ওই খাল করে পৌঁছাবো কালির খালে। মজনু বাহিনীকে আক্রমণ করার মতো বড় কোনো দল এদিকে নাই। কিন্তু জোনাব বাহিনী থাকলে গুলি করে বসতে পারে। শিকারীদেরও চলাফেরা আছে এই জঙ্গলে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top