সরু খাল ধরে লম্বা পথ, ক্ষতবিক্ষত হলো শরীর | রূপান্তরের গল্প ১৪৭ | Rupantorer Golpo 147 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৪৭ : ট্রলারে থাকলে নিজেদের বেশ সুরক্ষিত মনে হয়। বেলায়েত সরদারের ট্রলারে কতো জায়গায় গেলাম! বঙ্গোপসাগরে ফেয়ারওয়ের বয়া নামক জায়গায় সরদারের ট্রলারে ঘুরে বেড়িয়েছি। তিন নম্বর সিগন্যালের মধ্যে দুবলা থেকে পশুর পাড়ি দিতে কলিজা লাগে। সেই ঝুঁকিও নিয়েছি দিনে ও রাতে। আবার ডাকাতে গুলি করলে নিজেদের আড়াল করার জায়গা থাকে ট্রলারে। ইঞ্জিনের গতি বাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করা যায়। কিন্তু ডিঙ্গি নৌকায় বসে কি নিজেদের নিরাপদ মনে করার সুযোগ আছে? আর সেই নৌকা যদি হয় বনদস্যুদের তবে অনেক রকমের ঝুঁকিতে পড়ার শংকা থাকে।
অনেকের মতো আমিও ভাবছি মজনু বাহিনীর মতো বড় দস্যুদল কেন নৌকায় করে ঘুরে বেড়াচ্ছে? উত্তর যা পেয়েছি তা হলো, পশ্চিম বাদায় ডাকাতি করতে গেলে নিঃশব্দে চলাফেরা করতে হয়। জেলেদের ধরতে ও নিজেদের আড়াল করতে এখানে নৌকার বিকল্প নাই।
লোকালয়ের কাছাকাছি যারা দস্যুতা করে তারা সকলেই নৌকা ব্যবহার করে। জঙ্গলে নিজেদের লুকিয়ে রাখা, ঝামেলা হলে অতি সরু খাল-ভাড়ানী ধরে পালিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকাই সেরা। যদি কোনো সশস্ত্র দল সামনে চলেও আসে, বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে যায় তখন পাড়ে নৌকা ঠেকিয়ে নেমে যেতে সময় লাগে না। একবার জঙ্গলের মাটি পায়ে পেলে তাদের আর ধরে কে? তবে নিচের দিকে অর্থাৎ সাগর উপকূলে চলাফেরার জন্য মজনু বাহিনী ট্রলার ব্যবহার করে। আমি জিজ্ঞেস করিনি তবে নিশ্চিত যে দূরের কোনো খালে মজনু বাহিনীর একটি ট্রলার অন্তত রাখা আছে।
মরা গোনে দূর সুন্দরবনে জেলেরা সেভাবে থাকে না। মাইনষালার কাছের বনে যারা জাল বায় বা কাঁকড়া ধরে তাদের ধরতেই নৌকা নিয়ে চলাফেরা করে তারা। মাইনষালা মানে হলো লোকালয়। এরা যেসব অঞ্চলে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সেখান থেকে মসজিদের আযানও শোনা যায়। এসময় মাইনষালা থেকে প্রয়োজনীয় বাজার-সদা, অস্ত্র-গুলি পৌঁছে দেয় নিজেদের লোকজন।
মজনু বাহিনীর নৌকা বহর চলছে। ভোর চারটা বেজে গেছে। আমি বসা দস্যুনেতা মজনুর নৌকায়। চারটি নৌকার তিনটিতেই সশস্ত্র বনদস্যুরা সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে বসে আছে। সবারই অস্ত্রে গুলি লোড করা, আঙ্গুল ট্রিগারে। শুধু সেফটি লক খুলে ট্রিগার টেনে দিলেই ধুম!১২ থেকে ১৫ জন দস্যু আছে। প্রত্যেকের হাতেই অস্ত্র। তারপরও নিজেকে খুব নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
মালঞ্চ নদীর রোলিং খেয়ে আমরা ঢুকেছি মাঝারি একটি খালে। এটি কালির খালের ভাড়ানী। এই খাল ধরে চারপাশে বের হওয়া যায়। আমরা যাচ্ছি কালির খালে। নৌকা চলছে। বড় খাল থেকে একটি মাঝারি খালে ঢুকলাম। অন্ধকার চারপাশ। তবে অন্ধকারেও মনে হচ্ছে সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। অনেক ক্ষণ অন্ধকারে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিলো একটি বেশিই দেখতে পাচ্ছি। সুন্দরবনের মানুষেরা অবশ্য অন্ধকারে আরও ভালো দেখেন।
মাঝারি খালটিতে স্রোত বইছে উল্টো দিকে। তীব্র স্রোত। বৈঠার বেগ বাড়লো। রহমত বললো, যতো কষ্টই হোক এগিয়ে যেতে হবে। কারণ এর পরের ভাড়ানীটি খুবই সরু, লম্বাও আছে। জোয়ার থাকতে থাকতেই ওই খাল পাড়ি দিতে হবে। মিনিট কুড়ি পর পেলাম ওই খাল। কিন্তু এই খালে ঢুকবো আমরা? ও রহমত, ভুল হচ্ছে না তো? এনামুল দিলো উত্তর। বললো, এটাই কালির খালের সবচেয়ে সহজ ভাড়ানী। একটু কষ্ট হবে আপনাদের। তবে এই পথ ছাড়া উপায়ও নাই।
ঢুকলাম ছোট্ট সেই খালে। মুখের দিকে কোনো রকমে ঢুকতে পারলেও ত্রিশ সেকেন্ড পরই আটকে গেলো সামনে নৌকা। আধা ভাটি হয়ে গেলে এই পথে আর চলা যায় না। দস্যু সদস্যরা নেমে পড়লো সাথে সাথে। বন্দুক রেখে দা-কুড়াল নিয়ে পথ পরিস্কার করলো। তারপর আবার চলা শুরু করলাম। প্রায় পৌনে এক ঘন্টা চললাম ওই সরু ভাড়ানী খাল দিয়ে। পথে পড়া গাছপালা আর ডালগুলো কেটে পরিস্কার করছে সামনের নৌকার ছেলেরা।
মজনু বললেন, এভাবে আমরা কোথাও যাই না। এই যে গাছগুলো কাটা। এগুলো দেখলে যে কেউ বুঝবে যে সামনে ডাকাত দল আছে। চুপচাপ বসে থাকলেও এই পথে একটানা বিভিন্ন ধরণের গাছের ডাল-পাতা গা ঘেঁষে গেছে। এক হাত ও বুক, কাঁধের কয়ক জায়গা ছিঁড়ে গেছে। জায়গাগুলো জ্বলছে। মনে মনে বললাম, ওর জ্বলা ও জ্বলুক। আমাদের জায়গা মতো পৌঁছাতে হবে। তারপর পেটের জ্বালা থামাতে হবে।
মজনু বাহিনীর তিন নম্বর নৌকাটি সবার শেষে। তার আগে আমাদের নৌকা। সেখানে সহকর্মীরা আছেন। বাঁধনকে ডাক দিলাম। সব ঠিকঠাক তো বাঁধন? রাজীব আর নিজাম উদ্দীনের খবর কী? ওরা বললো ঠিক আছে। আরেকটা মাঝারি খালে বের হলাম আমরা। তারপর খালের মাঝখান দিয়ে চলছি। এবার স্রোতের সাথে সাথে যাচ্ছি, মানে জোয়ারে যাচ্ছি আমরা।
কালির খাল আর কতদূর ভাই? বললো আর ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। জায়গাটি ভালো না। বাঘের চাপ বেশি। ছোট ছোট দস্যুদল ঘাপটি মেরে থাকে। আবার শিকারীদেরও চলাফেরা আছে এদিকে। নিচের দিকে ফিরিঙ্গি, কুকুমারি অঞ্চলের কেওড়া বনগুলোতে শিকার করে বেড়ায় তারা। বনদস্যুরা আর কাউকে পরোয়া না করলেও শিকারীদের ভয় পায়। কারণ দূর থেকে নিশানা ঠিক করে টার্গেটে গুলি করতে ওস্তাদ তারা। শিকারীদের গুলি মিস হয় না।
কালির খালে গিয়ে থামলো আমাদের নৌকা বহর। বড় খালে তো থাকা যাবে না। ওই ছোট হাতিভাঙ্গা খালের মতো ছোট্ট আরেকটা খালে ঢুকবো। তখন প্রায় আলো ফুটে গেছে। চারপাশটা অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ভাবছিলাম, গত তিন/চার ঘন্টার পথে একটি জেলে নৌকাও পড়লো না সামনে। ডাকাত সরদার মজনু বললেন, মরা গোন-এ এমনিতেই জেলে কম থাকে। আর যারা ছিলো তারা আমাদের দেখে সরে গেছে। ডাকাতের সামনে কে পড়তে চায়?
ছোট খালটির কোনো নাম নাই। কিন্তু বাইন আর গড়ান বন সেখানে জমাট বাঁধা। জঙ্গলটা বেশ উঁচু। গাছের তলাও পরিস্কার। মানে এখানে হরগজা, হেঁতাল, গোলপাতা, প্রেমকাঁটার মতো ঝামেলার গাছপালা নাই। একটু ভিতরে গিয়ে থামলাম।
বাবুর্চি কোথায়? জেগে আছো? পিছনের নৌকা থেকে আওয়াজ আসলো, জ্বি ভাই আছি। কী করতে হবে বলেন। বললাম, ক্ষুধায় তো জীবন শেষ হয়ে গেলো। সকালের নাস্তা হবে কখন? বলতে বলতে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। আলমগীর ভাই চোখ মেললেন। লম্বা একটা ঘুম তিনি এর মধ্যেই দিয়ে ফেলেছেন। বললেন, বাবুর্চি, বাজারগুলো একটু চেক করে নাও, তালিকা মিলিয়ে দেখো সবকিছু ঠিক আছে কী না! আমি বললাম, বাজার পরে দেখো। আমাকে একটু চা বানায়ে দাও। বাঁধনকে বললাম, শুকনা খাবারগুলো বের করো।
টিনের তৈরি দুইটি চুলা আছে এই বহরে। লাকড়ির চুলা। পাটাতনের নিচে লাকড়ি সাজানো, বাবুর্চি ছেলেটাকে বললাম, সব কি সুন্দরী গাছের লাকড়ি? বললো, সুন্দরী জ্বলে ভালো ভাই। রান্না করতে বেশ কায়দা হয়। বললাম, গড়ান, গেওয়া তো এদিকে বেশি পাওয়া যায়। সুন্দরী তো দেখিই না। ছেলেটি বললো, আগের দুই দিন তারা নিচের দিকে ছিলো মানে সাগরের দিকে।
মামদো নদীর শেষ দিকের জঙ্গলে সুন্দরীর বাগান আছে। মান্দারবাড়িয়া, বেহালা খাল, কয়লা খালের ভিতরে, তালতলায় সুন্দরী হয়। পশ্চিম সুন্দরবনের শুধু নিচের দিকে সুন্দরী গাছ হয়। লবণাক্ততার কারণে এদিকের গাছপালার ধরণ ভিন্ন। বেশির ভাগ গাছ গড়ান ও গেওয়া। সাগর কূলে গোলপাতার বাগান আছে, জানা গাছের সংখ্যাও বেশি।
মালঞ্চ নদীর যে দিকটায় আছি সেদিকে গড়ান গাছের বাগান বেশি। আছে কিছু বাইন গাছ। আর মাঝে মাঝে কেওড়া আর গেওয়ার বন। এদিকে কাঁকড়ার জেলেদের বিচরণ বেশি। লোকালয় ঘেঁষা বলে খালপাটা, টোনা জাল, টানা জাল আর ঝাঁকি জালের ছড়াছড়ি। বেন্দী জালও আছে কম বেশি। মালঞ্চ, মামদো, আইড়ো শিবসা, আড়পাঙ্গাসিয়া, রায়মঙ্গল, গাঁড়া, সায়া নদীতে দাওন বড়শি ফেলে জেলেরা।
চরপাটা জাল দিয়ে মাছ ধরা চলে নদীগুলোর বাওনের চরে। ফিরিঙ্গি, খোপড়াখালী, হেঁতালবুনিয়া, কাগা, দোবেঁকী, আঠারো বেঁকী, কুঞ্চে, তালপট্টীর চর, পাগড়াতলী, কয়লা, বেহালা, মান্দারবাড়ীয়া, কালীর চর, পুতনীর দ্বীপ মিলিয়ে চলে চরপাটা জাল। ওদিকে খালপাটা জালেও অভাব নাই। মজনু বাহিনীর মূল রোজগারের মাধ্যম এই জেলেরা। নিয়মিত গোন হিসাবে চাঁদা ওঠে। জেলেরা জায়গা ভেদে অন্য দস্যুদলগুলোকেও চাঁদা দেয়। অপহরণ করে জেলেদের আটকে রাখা, মুক্তিপণ আদায় ছিলো নৈমিত্তিক ঘটনা।
নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু জানছি, শিখছি। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় ঢুকছে না। ডিঙ্গি নৌকায় থাকা জলদস্যু মজনু তো বঙ্গোপসাগরেও দস্যুতা করে। গভীর সাগরে গিয়ে জেলেদের আক্রমণ করে, ২০ থেকে ৫০/৬০ জন জেলে অপহরণ করে আবার এই বনে ফিরে আসে তারা। কেমন করে? কীসে চড়ে তারা সাগরে যায়? আবার ফিরেও আসে?
(ছবি: কালির খালের ভিতরে সরু খাল। দস্যুরা থাকতো রকম ছোট খালগুলোতে)