বাঘ-হরিণ সব গেলো কোথায়? | রূপান্তরের গল্প ১৪৯ | Rupantorer Golpo 149 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৪৯ : গত সন্ধ্যায় নেমেছি। সেই থেকে সুন্দরবনে আছি। নৌকা নিয়ে ঘুরছি। গহীন বনের ভিতরের ছোট খালগুলো দিয়ে লম্বা পথ চললাম। এখনও আছি সুন্দরবনের গভীরে। কিন্তু একটা হরিণও দেখলাম না। বিষয়টা কি? বাঘের কথা নাই বা বললাম। আগে এদিকের খালের ঠোঁটায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখতাম। এখন কোনো জায়গায় সেই আলামতও দেখি না। সকালে কয়েকটা বানরকে দেখলাম উঁকিঝুঁকি দিতে। পাখিরও দেখা নাই। এই খালটা এমন স্তব্ধ হয়ে আছে যেন একটু আগে জাল টেনে সব মাছ উঠিয়ে নিয়েছে কেউ। বিষয়টা কী?
বাঘ-হরিণ কি সব মেরে ফেলছো তোমরা? পাশের নৌকায় বসা এনামুলকে জিজ্ঞেস করলাম। বললো, আমরা বাঘ মারি না। কিন্তু কেউ কেউ শুনছি মারে। একটা বাঘ মারতে পারলে নাকী ২০/৫০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। আকাশ বাবু বাহিনী তো নামে ওই বাঘ মারার অর্ডার নিয়ে। বললাম, একটু ভালো করে বুঝাও তো বিষয়টা। ঘটনাটা কী ঘটছে তাহলে? এবার পাশ থেকে একজন বয়স্ক দস্যু বললো, অভিজিৎ-পূষ্পজিত নামের দুই ভাই আছে, বাড়ি বাজুয়া। তারা দেখবেন সারা বছর ডাকাতি করে না।
প্রজনন মৌসুমে বাঘেরা যখন পুরো বাদা ঘুরে বেড়ায়, ডাকাডাকি করে, তখনই নামে ওরা। পূষ্প একজন পাকা শিকারী। মাটির হাঁড়িতে মুখ দিয়ে হুবুহু বাঘের ডাক দিতে পারে। আর বাঘ যখন তার সঙ্গীকে খোঁজে তখন ওই ডাক শুনে আর থাকতে পারে না। ছুটে আসে। ওরা বন্দুক নিয়ে আশেপাশের কোনো গাছে বসে অপেক্ষা করে। তারপর বাঘ আসলেই গুলি করে। শুনেছি বাঘ মারার জন্য বন্দুকে বিশেষ গুলি ব্যবহার করে ওরা। বললাম, সত্যি কথা এটা? বললো, সত্য মিথ্যা জানি না। তবে ওই আকাশ বাবু বাহিনী সারা বছর ডাকাতি করে না। ওরা আমাদের মতো জেলেদের কাছ থেকে চাঁদাও নেয় না। তাহলে ডাকাতি করতে আসে কেন জঙ্গলে? ওদের চলে কী করে? আবার সুন্দরবনে তো সারা বছর থাকেও না।
বাঘ শিকার সুন্দরবনের জন্য বিরাট ক্ষতি। এরা সেই ক্ষতিটা করছে। শিকারীদের নিয়ে ধারণা খুব বেশি নাই। তবে জানার চেষ্টা করি সব সময়। প্রবীন ওই দস্যুর কথায় যুক্তি আছে। তবে বাঘ শিকারের বিষয়টি পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না। শিকারের কিছু গল্প শুনেছি। কয়েক জন বাঘ শিকারীর সাথে দেখাও করেছি এর মধ্যে। কিন্তু বাঘ নিয়ে কোনো কথা বলতে চায় না তারা। হরিণ শিকারের কথা অকপটে বলে। দস্যুদের অনেকের মুখে প্রতিপক্ষ দস্যুকে মেরে ফেলার কথাও শুনি। কিন্তু বাঘ শিকার নিয়ে কথা বললেই চুপ করে যায় সবাই।
মংলার এক বাঘ শিকারীর কথা মনে পড়ছে। মিন্টু শিকারী নামে পুরো সুন্দরবনের মানুষ এক নামে চিনতো। দস্যুনেতা রাজু বাহিনীর সাথে গভীর সম্পর্ক। চিলা বাজারে চা খেতে খেতে গল্প করছিলাম একবার। বললেন, হরিণ শিকার করেন অহরহ। কিন্তু বাঘ মারে না। আমি জানি মিন্টু বাঘ শিকারী। সম্পর্ক রাখতাম তার সাথে। ২০১০/১১ সালের দিকে ফোনে কথা হতো নিয়মিত। দস্যুনেতা রাজু’র কাছ পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য যোগাযোগ রাখতাম এই শিকারীর সাথে। পরের দিকে সে বিশ্বাস করতো আমাকে। কিছু কিছু গোপন কথাও বলে ফেলতো গল্পে গল্পে।
মিন্টু শিকারীর সাথে শেষ দেখা ওই চিলা বাজারেই। বললো, সিডরের বছরে অর্থাৎ ২০০৭ সালে একবার করমজলের ভিতরে হরিণ শিকারে গেছি। সাথে আরও তিনজন। শিকার তাদের নেশা ও পেশা। তখন বন উপকূলে হরিণের মাংস বিক্রি হতো দেদারসে। কারও আস্ত হরিণ লাগলে সে ব্যবস্থাও ছিলো। কেউ জীবিত হরিণ চাইলেও দিতো তারা। সেক্ষেত্রে খরচ বেশি দিতে হতো। দেশের অনেক গন্যমান্যের সাথে মিন্টুর সম্পর্ক ছিলো সরাসরি।
মূল গল্পটা বলেন দাদা। বললাম, বাঘের গল্প শুনতে চাই। শিকারের গল্প বলেন। ছোট করে যা বললো সে তার মূল অর্থ হলো, হরিণ মারতে যেয়ে একটা বাঘ মেরে ফেলছি। করমজলের পিছনের খালে একটি কেওড়া গাছে উঠে কুঁই দিলাম। শিকারীরা গাছের মগডালে বসে হরিণ ডাকে। মিন্টু শিকারী না কী এক জায়গায় বসে অনেকগুলো হরিণ শিকার করতে পারতো। ঘুরেফিরে হরিণ শিকারে চলে যাচ্ছিলো গল্প। আবার বললাম, বাঘের গল্পটা বলেন ভাই। তারপর গরগর করে বলে ফেললেন বাঘ শিকারের গল্প। কুঁই শুনে হরিণ না এসে বাঘ আসলো। দিলাম গুলি! এর পর পর নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন তিনি। তারপর আর খুঁজে পাইনি তাকে। সুন্দরবনের বাঘ শিকারীদের খবর কিছু পাই। কয়েকটি দস্যু দলের সাথে শিকারীদের যোগাযোগ ছিলো, পার্টনারশিপও ছিলো শুনেছি।
মিন্টু শিকারীকে ভালো করে চিনেন মজনু বাহিনীর ওই প্রবীন সদস্য। বললেন, এই শিকারীরাই সুন্দরবনটাকে শেষ করে দিলো। বললাম, শিকারীরা না হয় বাঘ মারলো। আপনারা হরিণ মারলেন। তাহলে নদী-খালে মাছ দেখি না কেন? উনি বললেন, জেলেরা বিষ দিয়ে মাছ ধরে।
পাশ থেকে এনামুল বললো, উপর বাদায় এমন কোনো খাল নাই যে বিষ পড়ে না। বিষে বিষে সব শেষ। দেখেন না যে জঙ্গলের পাখিও কতো কমে গেছে। আগের মতো পাখি দেখা যায়? এক সময় চরের উপর নেট পেতে রাখলেই বাটাং পাখির ঝাঁক ধরা পড়তো। এখন সেই পাখিও কমে গেছে। বিষেই সর্বনাশ করে ফেলছে। বললাম, বিষ নিয়ে এতো হায় হায় করছো তোমরা। বিষের জেলেদের আটকাও না কেন? কোনো জবাব নাই।
রান্না শেষ হলো। মজনুর ডেরায় আমরা মোট ২২ জন। এর মধ্যে খাল থেকে দুইটা নৌকা ধরে আনলো বাবু। এই বাবুর বাড়ি দাতিনাখালী। গুটগুটে বাবু নামে পরিচিত দস্যু জগতে। ওরা কারা? কাঁকড়ার জেলে। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলো। আমাদের দেখে ফেলেছে বলে ধরে নিয়ে আসলাম। কাঁদার উপর দিয়ে ঠেলে এনেছে নৌকাগুলো।
কী খবর তোমাদের? টিকেট আছে? ডিউটির টাকা দিছো? রহমত জিজ্ঞেস করলো। একটা হাঁসি দিয়ে একজন বললো, বাড়ি- গাবুরা, মানে মজনুর আদি বাড়ির লোকজন তারা। এর মধ্যে ঘুম ভেঙ্গেছে দস্যু নেতার। কাঁকড়ার জেলেরা এগিয়ে গেলো। হাত কচলাতে কচলাতে বললো, কেবল নামছি সাহেব। কাঁকড়া ধরে বিক্রি করে তারপর গোনের টাকা দিবো। তার মানে টাকা দিতেই হবে দস্যুদের। এলাকার লোক হিসাবে একটু ছাড় পাবে হয়তো। মজনু তাদের আটকে রাখতে বললেন।
কয়েকটি প্লেটে খাবার সাজানো হলো। দস্যুনেতার নৌকায় দেওয়া হলো আমাদের খাবার। সবাই মিলে একসাথে খাওয়া যাবে না। এতোগুলো প্লেটও নাই। দস্যুদের ডেরায় একসাথে খেতে বসার নিয়মও নাই।
খেতে খেতে মজনুকে বললাম, আমাদের কাজ কখন শুরু করবো? মানে আপনার ইন্টারভিউটা নিতে হবে। কাজ শেষ করে আজকেই ফিরে যেতে চাই। অন্যদের সাথেও কথা বলবো। বললেন, ছাগলটা বানানো শেষ করে আসুক। দুপুরের রান্নাটা শেষ করে তারপর শুরু করবো। সাক্ষাৎকার দিতে রাজী হবে কী না তা নিয়ে সংশয় ছিলো। এবার চিন্তামুক্ত হলাম। দস্যুনেতা কথা বলতে রাজি। তার মানে মজনু ডাকাত সত্যি আত্মসমর্পণ করবে!
সারা রাতের ক্লান্তি উগে গেলো। সকালের নাস্তার প্লেটটি হাতে নিলাম। তবে মুখে দিয়ে পুরো হতাশ হতে হলো। চিংড়ি মাছটা কাঁচা কাঁচা। সবজিও ভালো করে সিদ্ধ হয়নি। কোনো রকমে খাওয়া শেষ করার চেষ্টা করলাম। এসময় কাঁকড়ার নৌকা থেকে কাঁকড়া ভুনা নিয়ে আসলো একজন। সেটাও চেষ্টা করলাম। নাহ! একদম স্বাদ নাই। রান্নাগুলো হয়নি একদম। আবার মনে পড়লো বেলায়েত সরদারের কথা!
আমরা কেউই ঠিকমতো খেতে পারলাম না। মজনু বললেন, রান্নাটা কেমন হয়ে গেলো ভাই। তবে দুপুরের রান্নাটা আমি করবো। বললাম, আপনি রান্না পারেন? বাবুর্চি ছেলেটা বললো, আমি তো শুধু হেল্প করি। আমাদের দলে রান্না করে সাহেব নিজেই। দস্যুনেতা কেন রান্না করবেন? মনে মনে ভাবছিলাম, কী কারণে সাহেব রান্না করবে? নিশ্চয়ই কারণ আছে! ভিতরে ভিতরে খোঁজ খবর নিয়ে বুঝলাম, দস্যু জগতে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। খাবারের মধ্যে কিছু মিশিয়ে দেওয়ার ঘটনা অনেক ঘটেছে।
একগাদা ওষুধ খাই। একটু ঘুমাতেও পারি না। জঙ্গলে নামার পর আছি দৌড়ের ওপর। কখনও কোস্টগার্ড তাড়ায়, কখনও RAB এর অভিযান চলে। আগে আলিফ, আলম, মিলনেরা আমার দল চালাতো। এখন তারা চলে গেছে। নিজেরাই ডাকাত বাহিনী চালায়। এই পশ্চিম বাদায় আমার শত্রু সেভাবে নাই। কিন্তু কাউকে তো বিশ্বাসও করতে পারি না। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। আমি তো জঙ্গলে নেমে ডাকাতি করতে চাইনি। খুলনার সাহেবরা আমাকে নামিয়েছে। মোতালেবের ক্রসফায়ারের পর আল আমিন নিলো দলের দায়িত্ব।
তখন আমার কিছু অস্ত্র খাটতো এই দলে। কিন্তু আল আমিন যখন বেঈমানী করলো তখন খুলনার মাসুদ সাহেব আমাকে নামায়ে দিলো। জিজ্ঞেস করলাম, মাসুদ মানে কি গালকাটা মাসুদ? মজনু বললেন, জ্বি ভাই। এই বাদায় অস্ত্র-গুলি সব সেই সাপ্লাই দিতো। পরে ক্রমফায়ারে তার মৃত্যু হয়। আমি জঙ্গল ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাই। কিন্তু পালিয়ে থাকবো কতোদিন? খুব কষ্টের জীবন আমাদের। পালায়ে থাকতে হবে না হয় জঙ্গলে এসে ডাকাতি করতে হবে। ওই যে একবার নামলাম জঙ্গলে আর ফিরতে পারলাম না।
মজনু বললেন, এই যে আমার হাত পায়ের অবস্থা দেখেন। কী একটা রোগ হইছে। এর ওষুধ একটাই, জঙ্গল ছাড়তে হবে। লবণ পানি লাগলেই এই ঘা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো ওষুধে কাজ হয় না। ডাক্তার বলছে, এভাবে চলতে থাকলে এই অসুখ সারবে না। ক্যান্সারে রূপ নিবে। আমি বাঁচতে চাই ভাই। এই ছেলেগুলোর বয়স কতো! সারেন্ডারের যে সুযোগটা তৈরি হইছে, তা কাজে লাগাতে চাই। বললাম, আমিও চাই জঙ্গল ছেড়ে উঠে আসেন আপনারা।
কিন্তু সেজন্য আপনার অস্ত্র-গুলি সব জমা দিতে হবে। কারও কাছে এসব আর বিক্রি করতে পারবেন না। জঙ্গলে আপনার অনেকগুলো অস্ত্র আছে জানি। এই দিকে কোথাও চাপানো আছে কিছু অস্ত্র। সেগুলো আপনি বিক্রি করতে চান নোয়া মিয়ার কাছে। আমি সব খবর রাখি। বললাম, এই কাজটা করবেন না। বললেন, ওর কাছে তো টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে ফেলেছি ভাই। কয়টা অস্ত্র চাপানো ছিলো। সে বিপদে আছে।
মজনু বললেন, মাস্টার বাহিনী তার সব অস্ত্র নিয়ে গেছে। সেগুলো নিয়ে ওরা সারেন্ডার করলো। তারপর কয়টা মেশিন খুলনার পার্টি থেকে কিনে আবার নামলো নোয়া মিয়া। তোর তো বাড়ি ফেরার রাস্তা নাই। এরপর মাস্টার চলে গেলো আপনার মাধ্যমে। এখন খুব অসহায় সে। একটু সহযোগিতা না করলে চলবে কী করে সে? বললেন, নেটওয়ার্ক পেলে তার সাথে কথা বলিয়ে দিবো।
আমি শক্ত অবস্থানে। বললাম, অস্ত্রগুলো সব হাত বদল হয়ে গেলে কিছু করার নাই। সেগুলো যদি আপনার হেফাজতে থাকে, তবে অস্ত্রগুলো তাকে আর দিবেন না। আমি কিন্তু আপনাদের বিশ্বাস করে পুরো সারেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সরকারের কাছে আমার একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। আপনারা নয়ছয় করলে আমার সম্মান থাকবে না। এমনিতেই সমালোচনার শেষ নাই।
বললাম, সুন্দরবন নিয়ে সরকার খুব সিরিয়াস। যে করেই হোক আপনাদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে তারা। এই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে ক্রসফায়ার ছাড়া আপনাদের আর কোনো ভবিষ্যৎ নাই। আমি আপনার নিমন্ত্রণে এসেছি ঠিকই। কিন্তু কথাবার্তা না মিললে আমি নিজেই এর মধ্যে থাকবো না। পাশ থেকে ওই মুরুব্বি দস্যু বললেন, আপনি না থাকলে আমরাও সারেন্ডার করবো না।
আমি বললাম, নিয়ে যাবো বলেই তো এসেছি। আপনারা তৈরি হন। এই জঙ্গল থেকে ডাকাতরা না উঠলে জেলে-বাওয়ালীরা শান্তি পাবে না। ডাকাত সব উঠে গেলে সুন্দরবনও বেঁচে যাবে। তখন শিকার কমে যাবে। বিশেষ করে বাঘ শিকার তখন শূণ্যে নামবে। ওপরে বসে যতোই কান্নাকাটি করি, জঙ্গলে সশস্ত্র ডাকাত যতোদিন থাকবে ততোদিন এই বনের কোনো প্রাণিও নিরাপদ না।
(ছবি: নৌকায় বনদস্যুরা। সুন্দরবনের গহীনের একটি খাল। ভরা জোয়ারে তোলা ছবি। ২০১৬ সাল)