কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, দস্যুনেতা নিজেই রান্না করেন | রূপান্তরের গল্প ১৫০ | Rupantorer Golpo 150 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৫০ : মাঝারি একটা বাইন গাছে ঝোলানো ছাগল। ভোঁতা দা দিয়ে মাংসগুলো কেটে নামাচ্ছে একজন। পাশে দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন আলমগীর। বললাম, এতোক্ষণেও কাটাকুটির কাজ শেষ হয়নি? ওরা বললো, একটা মাত্র দা পাইছি। সেটাও ভোঁতা, ধার নাই। ও দিয়ে ছাগল বানানো যায়? বলতে বলতে ওই দা দিয়ে একটা গর্ত খুঁড়ে তার ভিতরে ছাগলের চামড়া, ভুঁড়ি ও মাথা পুঁতে ফেলা হলো। রক্ত পরিস্কার করে গর্তে ফেললো যাতে কোনো আলামত না থাকে।
এই সুন্দরবনে কাউকে অনুসরণ করতে হলে প্রযুক্তির সাথে সাথে এই আলামত ধরে এগুতে হয়। তার সঙ্গে জোয়ার ভাটার হিসাব মিলাতে পারলে ধারণা করা যায় যে দস্যুরা বা শিকারী কোন দিকে গেছে বা যেতে পারে। কিছু আলামত রেখেই যায় মানুষ। জেলেদের বা ডাকাতদের খুঁজতে হলেও এই ধারণা কাজে লাগবে। কিন্তু এবিষয়ে অনেকের ধারণা নাই। কেউ এতো কষ্ট করতেও চায় না। ঝুঁকি থাকে। তাই জঙ্গলে এসে দস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান করতে পারে না আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে রাতের বেলা এই জঙ্গলে কখনও অভিযানে নামে না তারা। অথচ ডাকাতরা চলাফেরা করে রাতের বেলাতেই।
জিজ্ঞেস করলাম, কতোক্ষণ লাগবে আপনাদের মাংস রেডি করতে? বললো, আরও এক ঘন্টা লাগবে। তাহলে একটু ঘুরে আসি আমরা বনের ভিতর থেকে। আলমগীর ভাই বললেন, খালি হাতে যাবেন না ভাই। হাতে একটা বন্দুক রাখেন। বললাম, বন্দুক আমি চালাতে জানি। কিন্তু আমার লাইসেন্স নাই। বললেন, অবৈধ বন্দুকের আবার লাইসেন্স? সবাই হেসে উঠলো। বললাম, একজন বন্দুকধারী সঙ্গে আসেন।
দস্যু সরদার মজনুর সাথে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকলাম। হাল্কা কাঁদা। খালি পায়ে হাঁটছি। জায়গায় জায়গায় শ্বাসমূল আর ছোট ছোট হরগজা কাঁটা। বাড়তি সতর্ক থাকি। কারণ আমার পায়ের তালু খুব নরম। সারা বছর জুতা পড়ি বলে কাঁটা অনায়াসে ঢুকে পড়ে তালুতে। প্রতিটি সফর শেষে সময় নিয়ে পায়ের তালু থেকে কাঁটা তুলতে হয়।
এই রহমত, মালের উপর একটা মাচা করো। ভাইয়েরা বসবে না? এমন ভাবে করো যাতে একটু ঘুমাতেও পারে মোহসীন ভাই, বাতাস লাগে এমন জায়গায় বানাবে মাচা। মজনুর নির্দেশের সাথে সাথে দুই জেলেকে নিয়ে কাজে নেমে পড়লো রহমত। বললাম, আমার ঘুম আসবে না ভাই। আপনার সাথে শ্যুটিং এর কাজটা করেই রওনা দিবো। আপনাদের বিদায় দিয়ে ফিরার সময় ঘুম দিবো। মজনু বললেন, দিনের বেলায় তো ছাড়বো না আপনাকে। রাতের জোয়ারে উঠবেন আপনারা।
জঙ্গলকে সুন্দরবনের মানুষেরা বলে “মাল” বা “বাদা”। সেই মালে নেমে অ্যকশন শুরু করে দিলো রহমত আর ওই জেলেরা। কুড়াল দিয়ে কাটা শুরু হলো গাছ। এদিকে সুন্দরী গাছ নাই। গড়ান আর বাইনের গাছ দিয়ে মাচা হবে। না হলেও ৫০টি গাছ কাটা হলো মাঝারি সাইজের। রহমতের নেতৃত্বে চলছে মাচা তৈরির কাজ।
খালের গোঁড়ায় ডিউটি করা দুই দস্যু ফিরেছে। খাওয়া দাওয়া সেরে তারা ঘুম দিবে। নতুন করে দুইজন পোসেস-এর গুলি চেক করে নিলো। চার ঘন্টার জন্য পাহাড়ায় গেলো তারা। বললাম, সতর্ক থেকো তোমরা।
এদিকে দিনের জোয়ার শুরু হয়েছে। দিন বলতে সকাল। সুন্দরবনে সবার ঘুম ভেঙ্গে যায় সাত সকালে। সুন্দরবনে থাকলে আমি প্রত্যেকটা সূর্যোদয় দেখি। তারপর ধীরে ধীরে সূর্য ওঠে, আলো বাড়ে। রোদ ওঠে। শেষ ভাটায় মাছেরা ছটফট করে। জঙ্গলের ভিতর থেকে হরিণ ডাকাডাকি করে। পৌষ থেকে-আশ্বিন-কার্তিক মাসস পর্যন্ত দূর থেকে বাঘের ডাক শুনি মাঝে মাঝে। পশ্চিম সুন্দরবনের এই কালির খালে এসে হরিণ দেখা তো দূরের কথা ওদের ডাকাডাকিও শুনলাম না।
শেষ ভাটায় খালের দোয়ায় আর কিছু না হলেও বড় বড় সিলেট মাছ লেজে বাড়ি দেয়। ছটফট করে পাঙ্গাস মাছ। ভেসে বেড়ায় কাকিলার মাছেরর ঝাঁক। তীরের জঙ্গল ঘেঁষে পোকা-মাকড় ধরতে লাফ দেয় রুছু মাছ। ওদিকটাকে পাতাড়ি বা ভেটকি মাছও চেহারা দেখায় সময় সময়।
শেষ ভাটায় ঝাঁকি জাল নিয়ে নামলে প্রচুর চিংড়ি আর পারশে মাছ হয়। কিন্তু এদিকে মাছের চিহ্ন দেখছি না। কাঁকড়ার জেলে ভাইরা বললেন, কয়রা আর কালাবগী থেকে বিষের পর্টি আসে। মরা গোনে তারা এক মাথা থেকে বিষ মারা শুরু করে। মণকে মণ চিংড়ি মাছ তুলে নিয়ে যায়। এসব খালে মরে ভেসে থাকে অন্য মাছ। কাঁকড়াও মরে যাচ্ছে ভাই। বললাম, ওরা বিষ মারে মারে, আপনারা কিছু বলেন না? ফিসফিস করে কানের কাছে এসে বললেন, ডাকাত পার্টির সাথে কন্ট্রাক্ট করে আসে, ফরেস্টও চুক্তি করা। তাহলে কে কাকে ধরবে? কিছু বললে আমাদেরই জঙ্গলে আসা বন্ধ করে দিবে সাহেবরা।
ঘন্টা খানেক হাঁটাহাঁটি করলাম বনের ভিতরে। জোয়ার আসছে। পানি না ওঠা পর্যন্ত মাটির সাথে একটু সম্পর্ক গড়ি। মানে কাঁদায় হেঁটে বেড়াই। এর মধ্যে ছাগলের মাংস কেটে আনলেন আলমগীর ভাই। নৌকায় বসে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মসলা কাটা-বাটা চলছে। বড় হাঁড়িতে মাংস চড়ানো হবে। নৌকার বড় চুলাটিও তুলনামূলক ছোট। তবুও নৌকাতেও রান্না চড়ানোর সিদ্ধান্ত হলো। বললাম, এই চুলায় এতো বড় হাঁড়িতে রান্না করা যাবে? ওরা কানে নিলো না।
এবার দস্যুনেতা কাজে নামলেন। মসলা মাখিয়ে নেওয়া হলো। ছাগলের মাংসের ঝোল হবে না ভুনা হবে জানি না। যা হয় হোক। দুপুরের খাবারটা জমবে। ভাবছি, দস্যুনেতা কেন রান্না করছেন? ততোক্ষণে দস্যুদলের বাঁকী সদস্যদের সাথে ভাব জমে গেছে। গুটগুটে বাবু নামের এক যুবক আমার পাশে পাশেই থাকছে। তাকে বললাম, রান্নার জন্য আলাদা বাবুর্চি থাকে। তোমাদের দলে লিডার নিজেই রান্না করছেন কেন? বললো, জটিল প্রশ্ন করলেন ভাই।
আসলে এই জগতে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। বললাম, বিশ্বাস না করলে বেঁচে থাকা যায়? সারাক্ষণ অবিশ্বাস নিয়ে কী করো বাঁচো তোমরা? বাবু বললো, আমাদের জীবনটাই এরকম। বিশ্বাসঘাতকতা সেকেন্ডে সেকেন্ডে। মানে, গুলি করে না মারলো, খাবারে বিষ মিশায়ে দিলে বা ঘুমের ওষুধ মিশালে কী অবস্থা হবে বলেন? এরকম অ্যাক্সিডেন্ট তো সুন্দরবনের দস্যু জগতে অহরহ হয়! সাথে সাথে রাজু বাহিনীর একটি ঘটনা মনে পড়লো।
২০১১ সালে রাজু’র দলের সাথে দেখা করে যাওয়ার পর ঘটেছিলো ভয়ঙ্কর এক দুর্ঘটনা। সুন্দরবনের শিবসা নদীর বাওনে আদাচাই ফরেস্ট অফিসের খালে অবস্থান করছিলো তারা। রাজু’র ব্যক্তিগত কাজ কারবারগুলো করতো বাচ্চু নামের এক কিশোর। খুব বিশ্বস্ত। তাকে সবাই নানা বলে ডাকতো। আরিফ নামের আরেক তরুণ ছিলো, রাজুর দূর সম্পর্কের ভাগ্নে। সেও দস্যুনেতার পাশে পাশেই থাকতো। এই দুইজন মিলে একটা মহাপরিকল্পনা এঁটেছিলো। গোপনে ঘুমের ওষুধ বা বিষ জাতীয় কিছু আনিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো তারা। সেবার রাজুর তিনটি ট্রলারের মধ্যে দুটি ট্রলার অন্য জায়গায় ছিলো। মূল ট্র্রলারটি নিয়ে বন বিভাগের অফিসের সামনে তারা বিশ্রাম নিচ্ছিলো।
সুযোগ মতো আরিফ সেই ওষুধ খাবারের হাঁড়িতে মিশিয়ে দেয়। বিকালে সেই বিষ মিশানো খাবার খেয়ে সবাই বিশ্রামে চলে যায়। তখন রাজু বাহিনীকে আক্রমণ করার কেউ ছিলো না। তাই সতর্কতাও ছিলো ঢিলাঢালা। আর সেই সুযোগটাই নিলো বাচ্চু ও আরিফ। সবাই খেলেও পরে খাবে বলে তারা এড়িয়ে গেলো। কেউ সন্দেহ করেনি। কারণ দুজনই রাজুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে সবাই অচেতন। কেবিনের ভিতরে অচেতন দস্যুনেতা নিজেও। সেই কেবিনে লুকানো ছিলো নগদ টাকার ব্যাগ। বাচ্চু জানতো কোথায় রাখা সেই ব্যাগ। পাটাতনের ভিতর থেকে টাকা ভর্তি বাজারের ব্যাগ বের করে বাচ্চু। কিছুদিন আগে ৮০ লাখ টাকা এসেছে। দুই ব্যাগে ভাগ করে রেখেছিলো রাজু। কিন্তু বাচ্চুরা তা জানতো না। তাই একটি ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। আদাচাই খাল সাঁতরে পেরিয়ে তারা হাঁটা দেয়। লোকালয়ে উঠে যাবে তারা। বাজারের ব্যাগে ৪০ লাখ টাকা! পালিয়ে যেতে পারলেই হলো। ভয়ঙ্কর ছিলো সেই যাত্রা।
ঘন্টা দুই পর বন অফিস থেকে এক বনরক্ষী এসে দেখেন দস্যুরা সব মরার মতো শুয়ে আছে। ডাকতে গিয়ে দেখেন বেহুঁস সবাই। সাথে সাথে রাজুকে তুলে নিয়ে যান তিনি। মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে হুঁস ফিরে তার। এর মধ্যে রাজু বাহিনীর একটি ট্রলার আসে। সবাই মিলে সেবা দিয়ে বাহিনীর অন্যদের জ্ঞান ফিরায়। তারপর দেখে বাচ্চু আর আরিফ নাই। তিনটি অস্ত্র আর টাকার ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে গেছে তারা। রাজুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত দুইজন বেঈমানী করেছে। খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সবাইকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে তারা!
ভাগ্যিস অচেতন অবস্থায় তাদের গুলি করে মেরে যায়নি বাচ্চুরা! জ্ঞান ফিরার পর একটু সুস্থ্য হয়েই সবাইকে ডাকলো রাজু। বললো, বাচ্চু ও আরিফকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় ধরে আনো। যে আনতে পারবে তাকে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দিবো। দলে দলে ভাগ হয়ে সবাই নেমে পড়লো অভিযানে।
সে দফায় দস্যুরা প্রাণে বেঁচেছে। বাচ্চু ও আরিফের ভাগ্য কী ঘটেছে সেবিষয়ে পরে আসবো। মজার কথা হলো, এর আগে রাজুও প্রতিপক্ষের খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে বেঈমানী করেছে, কেড়ে নিয়েছে তাদের অস্ত্র। সুন্দরবনের দস্যু গামা বাহিনীকে দুই দফা দাওয়াত দিয়ে এনে বেঈমানী করেছে রাজু। পশ্চিশ সুন্দরবনেও দস্যুদের মধ্যে এভাবে খাবারে ওষুধ মিশিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ঘটনা ঘটেছে।
মজনু বাহিনীর মজনু নিজেও নিজের লোক পাঠিয়ে জোনাব বাহিনীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে। তারপর কেড়ে নিয়েছে তাদের অস্ত্র। সুন্দরবনের দস্যু জগতে এরকম অজশ্র ঘটনা আছে। পাশের জনকে গুলি করে মেরে ফেলার ঘটনাও কম নাই। (প্রসঙ্গ ক্রমে সেই গল্পগুলো লিখবো সামনে)। শুধু এটুকু জানিয়ে রাখি, রাজুকে অচেতন করে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া আরিফ মাস্টার বাহিনীর সাথে আত্মসমর্পণ করেছে।
খালের পাশে পরিস্কার জায়গায় মাচা তৈরি হচ্ছে। মজনুসহ আমরা নৌকায় ফিরলাম। মসলা মাখানো ছাগলের মাংস চুলায় চড়ালেন দস্যুনেতা মজনু।
(ছবি: দস্যুনেতা মজনু রান্না করছেন। কালির খাল, সুন্দরবন, সাতক্ষীরা। জুন ২০১৬)