তিন কাঠিতে রান্না, জঙ্গলের বিশেষ চুলা | রূপান্তরের গল্প ১৫১ | Rupantorer Golpo 151 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৫১ : ঝাল-মসলা বাড়িয়ে দিয়েন ভাই। আমরা কিন্তু একটু ঝাল খাই। বললাম, আপনারা ঝাল খান কেমন? মজনু বললেন, এই জঙ্গলে সবার গ্যাসের সমস্যা ভাই। তাই ঝাল মসলা কম খাই। তবে আজকের রান্না আপনাদের পছন্দ মতো হবে।
জোয়ার তখন অর্ধেক হয়ে গেছে। খালের ভিতরে ঢুকে পড়েছে পানি। নৌকার বসে সেই পানি তুলে গোসল সেরে নিলো কয়েক জন। আলমগীর ভাই জঙ্গলের ভিতরে বসে দস্যুদের সাথে গল্প করছেন। ডাক দিলাম তাঁকে। বললাম, কাল থেকে তো ভালো মন্দ খাওয়া হলো না ভাই। বললেন, একটা হরিণ মেরে আনবো ভাই? বললাম, সে কথা তো বলিনি। আপনি নাকী ভালো রান্না করেন? একবেলা খাওয়াবেন না? বললেন, ও রহমত, জঙ্গলে আসলাম মেহমান নিয়ে। তোমরা শিকার টিকার করে রাখতে পারলে না? মজনু বললেন, আমার দলে যে কয়জন আছে তার মধ্যে ভালো শ্যুটার নাই একজনও? মানে শিকার করতে যে পাঠাবো কাউকে, তেমন শিকারী একজনও নাই। বললাম, শিকার করা যাবে না একদম!
নৌকার চুলায় রান্নাটা আগাচ্ছে না। হাঁড়ির তুলনায় চুলাটি ছোট হয়ে গেছে। বলতে বলতে দা নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন আলমগীর। মাঝারি সাইজের তিনটি গড়ান গাছ কেটে আনলেন। তারপর খালের ঠোঁটায় বানালো হলো চুলা। তিনটি কাঠ দিয়ে তৈরি ওই চুলাকে বলা হয় তিন কাঠি বা ত্রিকাঠি। সুন্দরবনে এই ত্রিকাঠি চুলা বেশ প্রচলিত। বিশেষ করে জোয়ারের পানি যেখানে ওঠে সেখানে উঁচু করে এমন চুলা বানিয়ে সারা হয় রান্না বান্না।
তিন পোয়া জোয়ার হয়ে গেছে। ভেসেছে নৌকা। অমাবশ্যার গোন। দিনের বেলা ভরা জোয়ার হবে বন্যা জোয়ার। মানে এই জঙ্গলও ডুবে যাবে জোয়ারের পানিতে। কিন্তু সে কথা কারও মাথায় নাই। তিন কাঠিতে আগুন জ্বালানো হলো। অর্ধেক রান্না হওয়া ছাগলের মাংসসহ হাঁড়িটি নৌকা থেকে নিয়ে বসানো হলো সেই চুলায়। দাউ দাউ করে জ্বলছে চুলা।
জোয়ার ভাটা এক অদ্ভুত জিনিষ। ছয় ঘন্টায় একটানা পানি বাড়ে। পরের ছয় ঘন্টায় নেমে যায়। অমাবশ্যা ও পূর্ণিমায় পানি ওঠে সবচেয়ে বেশি। আবহাওয়া একটু খারাপ হলেই জলোচ্ছ্বাস হয়ে যায়। আজকের আবহাওয়া বেশ গুমোট। পানি বাড়বে জোয়ারে। তাই জোয়ার শেষ হওয়ার আগেই রান্না শেষ করার চেষ্টা করছেন আলমগীর ভাই।
রান্নার দায়িত্ব বদল হলো। ওদিকে মাচা তৈরির কাজও শেষ। সহকর্মী বাঁধন, রাজীব ও নিজাম ভাইকে নিয়ে হাঁটা দিলাম। সঙ্গী হলেন মজনু ও গুটগুটে বাবু। মাচায় বসে সারেন্ডারের বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ হচ্ছে। মজনু বললেন, অস্ত্র-গুলি ও আমার সদস্যদের নিয়ে খুব দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে চাই। এখন কাদের কাছে সারেন্ডার করবো আমরা? বললাম, RAB-এর কাছে অবশ্যই। আর সদর দফতর থেকে বলেছে খুলনায় সারেন্ডার হবে। আপনারা রাজি থাকলে এখান থেকে ফিরে কথা আগাবো। মজনু জানালেন, খুলনা হোক বরিশাল হোক সেটা ব্যাপার না। আপনি মাঝখানে থাকলেই হলো। তারপর আরও নানা বিষয়ে গল্প হলো। জানলাম মজনু কী করে সুন্দরবনের মোস্ট ওয়ান্টেড মজনু ডাকাতে পরিণত হলো!
আমার মনেই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে শুরু থেকে। অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, মজনু কী ভাবে এতো বড় ডাকাত সরদার হলো? ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে বিষয়টি…!!
২০০২ সাল। সুন্দরবনের দস্যু জগৎ তখন টালমাটাল। লিটু সাহেব নামে খুলনার একজন টপ টেরর ছিলেন। সুন্দরবনের দস্যুতা তিনি এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। অস্ত্র নিয়ে স্পিডবোট চালিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে পড়তেন। তাকে জমা-খরচ না দিয়ে এই জঙ্গলে কেউ ব্যবসা করতে পারতো না। ২০০১/২০০২ সালে এক বিশেষ অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় লিটু। সাগর আর বনের খাল-নদীর মাছ ব্যবসা আর বনদস্যুতাকে ঘিরে শহরের বড় সিন্ডিকেটটি নড়েচড়ে উঠলো। অপরাধ জগতের মানুষেরা তখন পুরো সক্রিয়। বছর খানেকের মধ্যে অবৈধ অস্ত্রের যোগানদাতারাও ভিড়ে যায় সেই সিন্ডিকেটে।
তখন মোতালেব বাহিনী পশ্চিম সুন্দরবনের ডাকসাইটে দস্যুদল। আশি থেকে শ’খানেক সদস্য নিয়ে তারা দাপিয়ে বেড়াতো রায়মঙ্গলের এপাশ ওপাশ।
মজনু তখন মাছ ব্যবসায়ী। মজনু সাহেব নামে পরিচিত। যোগাযোগ ছিলো সেই সিন্ডিকেটের সাথে। খুলনার গালকাটা মাসুদ এর খাস লোক ছিলেন এই মজনু। মাছের ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের কারবার আর দস্যুতার টাকা নিয়ে ছিলো তার কাজ-কারবার। সুন্দরবনের দস্যুরা তাকে বেশ মানতো। কিন্তু মাঠে নেমে দস্যুতা করতেন না এই সাহেব।
২০১১ সালে এসে দস্যুনেতা মোতালেব ক্রসফায়ারে নিহত হন। এরপর সেই দস্যুদলের দায়িত্ব আসেন মংলার মিঠাখালীর আল আমিন। দলের সদস্যদের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিলো না। আবার অনেকেই মনে করতো যে মোতালেবকে ধরিয়ে দিয়েছেন আল আমিন নিজেই। এসব নিয়ে কানাঘুষা চলছিলো পুরো বন জুড়ে।
যেকোনো সময় দলের মধ্যেই অঘটন ঘটার সম্ভাবনা। সেই পরিস্থিতিতে ভারতে পালিয়ে যান আল আমিন। ক্রসফায়ারে নিহত দস্যুনেতা মোতালেবের ঘনিষ্ঠ বনদস্যুরা সকলে মিলে মজনু সাহেবকে জঙ্গলে পাঠিয়ে দেন। আপাতত দলটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে।
মিলন পাটোয়ারী, আলম সরদার, আলিফসহ বেশ কয়েকজন মিলে খুলনা থেকে জঙ্গলে নামিয়ে আনে মজনুকে। রূপসা থেকে ট্রলার, নৌকা, মটরসাইকেলে এক রাতেই তারা চলে আসে বন উপকূলে। আগে থেকে প্রস্তুত ছিলো নৌকা। রাতেই নৌকা ঢুকে পড়ে সুন্দরবনে। মজনু সেই থেকে পশ্চিম সুন্দরবনের বড় দস্যুদলটির সরদার। কয়েক বছর দস্যুতা করে ভারতে পালিয়ে যান এই দস্যুনেতা। সবশেষ সেখান থেকেই আবার দস্যুতায় নামেন। মজনু বাহিনীকে সারেন্ডার করানো যাবে ভাবিনি কখনও। শুরু থেকেই তার সাথে আমার কথা হতো ফোনে ফোনে।
সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জের দ্বীপ জনপদ “গাবুরা”-তে জন্ম মজনু ডাকাতের। জীবিকার প্রয়োজনে কখনও খুলনায় আবার কখনও ভারতে। কখনও জঙ্গলের ভয়ঙ্কর দস্যুনেতা। আবার কখনও ভারতে আত্মগোপণ করে থাকা ছাপোষা মানুষ। এভাবেই চলেছে প্রায় এক দশক।
এই জোয়ার শেষে ভাটা আসলে আমরা কাজে নামবো। কাজ বলতে আমাদের ক্যামেরার কাজ। ইন্টারভিউ ও কিছু ছবি তুলতে হবে। ক্যামেরায় আত্মসমর্পণের আবেদন করবে মজনু বাহিনী। সেই সাথে সারেন্ডারের লিখিত আবেদনও করবে তারা। মজনুকে বললাম, দলের সবাই কি সারেন্ডার করবে? কেউ কি অনাগ্রহী আছে? যদি থাকে তবে তাকে বের করে দিবেন। আর অন্য যারা পলাতক অবস্থায় আছে, তাদের নিয়ে আসবেন। বললাম, আমি এই দস্যুদলের সবাইকে চিনে রাখছি, সবগুলো অস্ত্রের হিসাবও কিন্তু মাথায় আছে। কাজেই অস্ত্রের মধ্যে যেন কোনো ভেজাল না ঢোকে। ভয় দেখানোর জন্য বললাম, গোয়েন্দাদের কাছেও কিন্তু আপনার সব হিসাব আছে। আবারও বলছি, অস্ত্রের হিসাবে কোনো গরমিল না হয়! মজনু কথা দিলেন, সবকিছু জমা দিবেন।
বনের ভিতরে দস্যুদের বানানো মাচায় বসা সবাই। বেশ মজবুত। মাত্র আধা ঘন্টা সময় লেগেছে গাছ কেটে এই মাচা তৈরি করতে। দস্যুরা প্রতি রাতে জায়গা বদল করে। যেখানে থাকে সেখানেই এমন মাচা বানিয়ে ফেলে। তারপর ফেলে চলে যায় আরেক জায়গায়। এভাবে এক একটি দস্যুদল তাহলে প্রতিদিন কতোগুলো গাছ কাটছে? কথায় কথায় গাছ কাটা, হরিণ শিকার, পাখি শিকার করে বনদস্যুরা। শুনেছি কেউ কেউ বাঘও মারে। কী সাংঘাতিক ঘটনা। মনজু বললেন, শিকার খুব একটা করে না তারা। বাঘ শিকার তো প্রশ্নই আসে না।
সময় গড়াচ্ছে। পানি উঠছে। এর মধ্যে ডাঙ্গায় উঠে পড়েছে পানি। জোয়ার শেষ হতে আরও এক ঘন্টা। এর মধ্যে পানি আরও এক দেড় হাত বাড়বে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঠোঁটার ওদিকে শোরগোল পড়ে গেলো। বুকটা ধক করে উঠলো। আবার কোনো ঝামেলা না তো? দৌড়াতে হবে আবার?