রূপান্তরের গল্প ১৫৩ | Rupantorer Golpo 153

আত্মসমর্পণে রাজি মজনু বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ১৫৩

আত্মসমর্পণে রাজি মজনু বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ১৫৩ | Rupantorer Golpo 153 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৫৩ : মজনু কিন্তু বেঈমানী করবে। মধ্যস্ততার করতে গেলে বিপদে পড়বেন। সে কিন্তু বেঈমানী করে কথায় কথায়। বনদস্যু দল মজনু বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে আমার সোর্সরা বার বার সতর্ক করেছে। এবার জঙ্গলে নামার আগে তাদের কাউকে জানাইনি। এমনিতেই গোপন রেখেছি বিষয়টি। গত রাত থেকে একটানা সেই কথাটি মাথায় ঘুরছে।

ভাত খেয়ে কাঁকড়ার নৌকায় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিশ্রাম নিতে গিয়ে গভীর সেই ঘুম কতোক্ষণের ছিলো বলতে পারছি না। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে গায়ে। নৌকার ওপর পলিথিন টানানো হয়েছে। কিন্তু পা দুটো ভিজছে বৃষ্টিতে। উঠে বসলাম। তাকিয়ে দেখি ডাঙ্গার উপর আমরা। মানে ভাটা হয়ে গেছে। জঙ্গলের পানি নেমে গেছে। নেমে গেছে ছোট সেই খালের পানিও। তার মানে অন্তত তিন ঘন্টার ঘুম হয়ে গেছে। পাশে অস্ত্র হাতে বসা গুটগুটে বাবু। বললো, আরেকটু ঘুমান ভাই। বৃষ্টি মনে হয় বেশ কিছুক্ষণ চলবে।

বনদস্যুদের নৌকায় ছই এর কাঠামো করা থাকরে। সুন্দরী বা গড়ান গাছ বাঁকিয়ে শক্ত করে বাঁধা থাকে। বৃষ্টি আসলেই পলিথিন টেনে দেওয়া হয়। খালের গোঁড়ায় পাহাড়ায় দাঁড়ানো দু’জন দস্যু ছাড়া বাঁকী সবাই নৌকার ছইয়ের ভিতরে। বাবুকে বললাম, বৃষ্টি থামলে কাজে নামবো। ভাটা হয়ে গেছে। এখন আমাদের মূল কাজটা সেরে নিতে হবে।

সুন্দরবনের দস্যুদের ডেরায় গেলে ছবি তোলার বিষয়ে সতর্ক থাকি। আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগে ভিডিও ক্যামেরা বের করি না। সন্দেহ হতে পারে এমন কোনো আচরণ করি না। মোবাইল ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি। সহকর্মীদেরও একই নির্দেশনা দেয়া। মোটকথা, ছবি তোলা নিয়ে কোনো সন্দেহ তৈরি না হয়। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় পিছন ফিরিয়ে ছবি তুলি। তারা যতোটুকুতে সম্মত হয় সেটুকুর মধ্যেই কাজ করি। এর আগে অনেক বনদস্যুর ছবি তুলেছি। কিন্তু প্রকাশ করিনি। আমাকে বিশ্বাস করার এটাও একটি কারণ।

অপরাধ জগতের এই মানুষদের নিয়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তাদের সাথে প্রচুর কথা হয়। কিন্তু তাদের তথ্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে দেইনি। আবার বাইরের কোনো তথ্যও তাদের দেইনি। বহুপক্ষের আস্থায় থাকাটা সহজ না। তবে চেষ্টা করি যাতে ভুল না হয়। জানতাম, একটা ছোট্ট ভুল থেকে এক বা একাধিক জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। দস্যুদের আত্মসমর্পণে মধ্যস্ততা করছি। সেটা আরও জটিল কাজ। সবচেয়ে বড় কথা এই কাজ করতে গিয়ে আমার উদ্দেশ্য ও সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে কেউ কেউ। পুরস্কার তো পাবোই না। বরং বিতর্কিত হয়ে যেতে পারি।

গভীর ঘুম থেকে উঠে এসব ভাবছি। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত আর কিছু করারও নাই। বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম কেন আসলে ডাকাতি করতে? বললো, এই জঙ্গল জীবনে অপরাধ করে না কে? এই যে আপনি জঙ্গলে আসছেন আমাদের সাথে দেখা করতে, এটাও অপরাধ। ভেবে দেখলাম, সত্যিই তো! প্রথমত নিয়ম না মেনে বনে ঢুকেছি। বন আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতোগুলো গাছ কাটা হলো, সেটাও অপরাধ। ক্যামেরা নিয়ে ঢুকছি সেটিও অপরাধ। ছাগল নিয়ে বনে প্রবেশও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এরপর বনদস্যুদের সাথে আছি। এই অবস্থায় ধরা পড়লে অস্ত্র মামলা খেতে হবে, দস্যুতার মামলাও হতে পারে।

বাবু বললো, এই যে কাঁকড়ার নৌকায় শুয়ে আছেন, এটাও অপরাধ। কারণ কাঁড়ার জেলেদের পাশ পার্মিট নাই। মূল কথা হলো, সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল আমরা। চলতে ফিরতে অপরাধের শেষ নাই। জেলেদের মাছ-কাঁকড়া নিজেদের মতো করে বিক্রির ক্ষমতা নাই। মহাজনরা পুরোটা খেয়ে ফেলে। আমরা জঙ্গলে আসি, কষ্ট করি, মাছ-কাঁকড়া ধরি। তারপর সেগুলো বিক্রি করতে গিয়ে লোকসানে পড়ি। তারপর সংসার চালাতে সূদে ঋণ নেই। সময় মতো সেই লোন শোধ করতে পারি না। সূদের কিস্তি ঠিকমতো দিতে না পারলে চেক এর মামলা খেতে হয়। দেখা যাচ্ছে ঋণ নিলাম ২০ হাজার টাকা। মাসে সূদ টানি হাজারে ৩০০ করে, মানে প্রতি মাসে সূদই দেওয়া লাগে ছয় হাজার টাকা। এখন সূদ দিবো না আসল শোধ করবো বলেন?

মাথাটা ঘুরে উঠলো। কী বলে এসব? হাজারে ৩০০ টাকা সূদ? বললো, এখানে জেলেদের পূঁজি গড়েই দেয় না মহাজনেরা। তাহলে কী কারণে জেলে থেকে ডাকাত হলে তুমি? বললো, চেক এর মামলা খেয়ে ফেরারি হইছি ভাই। ব্লাংক চেক নিলো সূদের কারবারী। নিলাম ২০ হাজার। কিন্তু চেক-এ এক লাখ টাকা লিখে মামলা দিলো। সেই মামলায় ওয়ারেন্ট হলো। আর বাড়িতে থাকতে পারলাম না। এরপর চলে আসলাম জঙ্গলে। যোগ দিলাম এই ডাকাত দলে।

এখানে যাদের কাছে চাঁদা নাও, ডাকাতি করো, সবই তো তোমার চেনা লোকজন। তাদের তো মারপিটও করো। খারাপ লাগে না? বাবু বললো, ভাবছিলাম তিন মাস ডাকাতি করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে উঠে যাবো। কেউ টের পাবে না। কিন্তু আপনজনরাই এলাকায় খবর দিয়ে দিলো, বাবু ডাকাতি করতিছে। চারপাশে ছড়িয়ে গেলো সেই খবর। শুনলাম আমার নামে হুলিয়া চলে। থরা পড়লেই ক্রসফায়ার। আর ফিরতে পারলাম না। আটকা পড়লাম জঙ্গলের দস্যু জীবনে। এখন সুযোগ আসছে। আমাদের নিয়ে যান ভাই। এরপর জেল জরিমানা যাই দেক মেনে নিবো। ফিসফিস করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের সাহেব সারেন্ডার করবে তো? পরে আবার নাটক করবে না তো? বাবু বললো, আর কয়দিন জঙ্গলে থাকলে এমনিতেই সাহেব শেষ হয়ে যাবে, ক্যান্সারে মারা যাবে। গায়ে কী একটা রোগ হয়েছে দেখেন না?

বৃষ্টি কমে আসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে থেমে যাবে মনে হচ্ছে। বাবুকে বললাম, ওই নৌকায় যাও। বাবুর্চিকে বলো এক কাপ চা খাওয়াতে। একদম হাল্কা লিকার করে দিবে। আর মজনু ভাইসহ অন্যদের তৈরি হতে বলো। পাশের নৌকায় আমার সহকর্মীরা। বাঁধনকে ডাকতেই বললো, ক্যামেরা রেডি ভাই। কাজ শুরু করবো কখন? বললাম, এখনই শুরু হবে। চা খেয়েই নেমে পড়বো। ওরা কাজে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দস্যু সরদারও দেখি কাপড় পাল্টাচ্ছেন। মানে সাক্ষাতকার দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

মজনু ধোঁকা দিবে সেই কথাটি মাথা থেকে সরছিলোই না। তবে নিজে থেকে আমাকে নিয়ে এসেছেন। অন্তত সেই জায়গা থেকে ভরসা করছি আমি। মাস্টার বাহিনীর পর মজনু বাহিনী সারেন্ডার করলে এর প্রভাব পড়বে পুরো সুন্দরবনে। অন্য দস্যুদলগুলো আগ্রহী হবে। গুটগুটে বাবু’র মতো জেলে থেকে দস্যুতায় নামা তরুণদের জীবনগুলো বেঁচে যাবে। আর এরা উঠে গেলে শান্তি পাবে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের জেলে-বাওয়ালীরা।

একটা নৌকা নামানো হলো মূল খালে। ভাটার সময় বলে কাঁদার উপর দিয়ে ঠেলে নামানো হলো। বাঁধন বললো ছবি তুলবে আরেকটি নৌকা থেকে। নামানো হলো দ্বিতীয় নৌকা। কালির খালে তখন সার ভাটি। মানে পানি একদম তলানিতে। এরকম সময় বাইরে থেকে লোকজন আসার সুযোগ ও সম্ভাবনা দুটোই কম থাকে। মোটামুটি দুশ্চিন্তামুক্ত পরিবেশে শ্যুটিং শুরু হলো। জলদস্যু নেতা মজনু ক্যামেরায় সাক্ষাৎকার দিলেন। আত্মসমর্পণের আগ্রহের কথা জানালেন। ভুল স্বীকার করলেন। সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। এরপর আত্মসমর্পণের লিখিত আবেদন তুলে দিলেন আমার হাতে।

ওই সফর থেকে ফিরে সংবাদটি প্রচার করবো। আর আত্মসমর্পণের লিখিত দরখাস্তটি পৌঁছে দিবো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। মজনু আবারও বললেন, কোনো রকম নয়ছয় করবো না ভাই। সত্যি সত্যি সারেন্ডার করবো। বাড়ি ফিরতে মন চায়। আমি যদি সারেন্ডার করি তাহলে পশ্চিম সুন্দরবনের কয়েকটি দল সারেন্ডার করবে। আলিফ, আলম তৈরি হচ্ছে, তারাও আমার পিছে পিছে আত্মসমর্পণ করবে। বনদস্যুদের বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু এই কাজে নেমে তাদের বিশ্বাস না করে কাজ আগানো যাবে না। ঝুঁকি আর ঝক্কি দুটোই আছে। সম্মান ক্ষতিতে পড়তে পারে, মারাও যেতে পারি কোনো দুর্ঘটনায়। কিন্তু নেমেই যখন পড়েছি এর শেষ না দেখে উঠবো না।

মজনুকে বললাম, আপনাকে কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু আমি আপনার ওপর পূর্ণ আস্থা রাখলাম। বাঁকী দায়িত্ব আপনার। মনে মনে ভাবছি, কোন জায়গায় সারেন্ডার করাবো তাদের? খুলনা না বরিশালে? আমি চাই খুলনা RAB- এ সারেন্ডার করুক। মজুনও তাই চাচ্ছেন। কিন্তু বরিশাল RAB-এর উপ অধিনায়ক আদনান কবীর বলেছিলেন, সুন্দরবনের সব কাজে তিনি থাকতে চান। এই সিদ্ধান্ত আমার জন্য নেওয়া সবচেয়ে কঠিন ছিলো।

(ছবি: মজনু বাহিনীর দস্যু। পশ্চিম সুন্দরবন। জুলাই ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top