রূপান্তরের গল্প ১৫৬ | Rupantorer Golpo 156

আপন মামাকেও ছাড় দিলো না বনদস্যুরা! | রূপান্তরের গল্প ১৫৬

আপন মামাকেও ছাড় দিলো না বনদস্যুরা! | রূপান্তরের গল্প ১৫৬ | Rupantorer Golpo 156 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৫৬ : মনের সুখে গান গাইছে রহমত। খালে তখন জোয়ার লেগেছে মাত্র। দখিণা বাতাস আর স্রোতের সাখে সাথে চলছে বৈঠা। অনেক দূর থেকে গানের শব্দ পাচ্ছিলাম। আমি এক কাপ গরম চা হাতে দাঁড়িয়ে। অন্যরাও সেখানেই দাঁড়ানো, খালের পাশে। বললাম, এই জোয়ার থাকতে থাকতে ফিরতি পথ ধরবো আমি। মজনু বললেন, আরেক দিন থাকলে হতো না ভাই? কিছুই তো খাওয়াতে পারলাম না। জঙ্গলে আসছেন আমার কাছে, কিছু মাছ নিয়ে যাবেন না? অন্যরাও এসে ঘিরে ধরলো। বললো, গত রাতে গোন লেগেছে নদীতে। জেলেরা নামছে জঙ্গলে।

আজ রাতের মধ্যেই মাছ চলে আসবে। এই যে ভাটা গেলো, এই ভাটাতে জাল তুলেছে জেলেরা। মজনু বললেন, আশেপাশে জেলে আছে কোন খালে খবর নাও তো! এনামুলকে বললাম, মাছের খবর নিয়ে লাভ নাই। নিবো না। ওদিকে অস্ত্রটি কোলে রেখে নৌকা বাইছে রহমত।

তীরে ভিড়লো নৌকা। ও রহমত কারা ওরা? নামতে নামতে সালাম দিতে দিতে উঠলো তিনজন। মজনু সাহেবকে মামা বলে ডাকছে তারা। বললাম, সুন্দরবনে এসে জঙ্গলে কী করেন? আপনাদের তো নৌকায় থাকার কথা! ডাঙ্গায় নেমে কাঁকড়া ধরা তো বেআইনী। কী দিয়ে ধরেন? বললো, আঁড়াকল, চারো আর দাওন। তিন সিস্টেমেই ধরি। বললাম, দাওন ছাড়া বাঁকী দুই পদ্ধতি নিষিদ্ধ। ওরা বললো, সবাই তাই করে। ডাকাত আর ফরেস্টারদের টাকা দিলে সব মাফ। বলতে বলতে মজনু বলে উঠলেন, তোমরা তো আমাকে দিলে না। ওই আলিফকে দিলা, মজিদকে টাকা দাও, জোনাবকে দাও।

আমার বেলায় তোমার টাকা থাকে না। জেলেরা বললো, টাকা দিছি ওমুকের মাধমে, তোমরা খাতায় লিখোনি। কথায় কথায় রহমত রেগে গেলো। বললো, নৌকায় চলো মামা। হিসাবের খাতা দেখলেই বুঝা যাবে কী দিছো না দিছো। জঙ্গলে আসলে টাকা দিতে হবে, মাফ নাই। বলতে বলতে মজনুর মূল নৌকার দিকে হাঁটা দিলো ওরা। ভিতর থেকে হিসাবের খাতা বের করে গোল হয়ে বসলো তারা। নৌকার পাশে দাঁড়ানো ওই তিনজন।

কুকু পাখি ডেকে উঠলো চারপাশ থেকে। তার মানে এক পোয়া জোয়ার হয়ে গেছে। কালির খালের পাশে দাঁড়ানো আমরা। ওরা স্যাভলন জাতীয় কী যেন নিয়ে আসলো। বললাম, এতো যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবো না। ওসব দিলে জ্বলবে খুব। আপাতত এভাবেই থাক। জিজ্ঞেস করলাম মজিদ কি ডাকাতি করছে এখনও?

উনি কি সেই বাইঘো মজিদ? গাবুরা’র মজিদের কথা বলছো তো? এনামুল বললো, জ্বি মামা। গাবুরার সেই মজিদ। মানে মান্নান ডাকাতের ছোট ভাই। আগে জাল ধরতো, কাঁকড়া ধরতো। বাঘে ধরছিলো তখন। মরতে মরতে বেঁচে গেছে। মুখে বাঘের থাবার গভীর দাগের কারণে বাইঘো মজিদ নামে পরিচিত সে। বললাম, মজিদ তো ডাকাতি ছেড়ে উঠে গেছে বলছিলো! এনামুল বললো, পালায়ে থাকার চেষ্টা করেছে, পারেনি। আবার কয়টা মেশিন নিয়ে নেমে পড়ছে।

এতো মেশিন পাও কই তোমরা? জোনাব, আলিফ, মজিদেরা চাইলেই অবৈধ অস্ত্রগুলো পায় কী করে? কারা দেয়? কী ভাবে জঙ্গলে নামায় অস্ত্রগুলো? প্রশ্নগুলো সরল। কিন্তু উত্তর সহজ না। আমি জানি এনামুল এর উত্তর দিবে না।

গল্প করছি, চা খাচ্ছি। বেশ হাল্কা মেজাজে আছি। কারণ একটা বড় বিপদ কেটে গেছে। বিপদ মানে কিছুক্ষণ আগে যে দৌড়াদৌড়ি করলাম, তার কথা বলছি। শরীরটা ক্ষত-বিক্ষত হলেও ভাবছিলাম, মজনু বাহিনীর সারেন্ডার নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রাথমিক কাজ শেষ করেছি। তাদের আবেদনটি এখন পৌঁঁছে দিতে হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। তারপর দ্রুততম সময়ের মধ্যে এদের নিয়ে উঠে যাবো। RAB-এর হেফাজতে যাবে তারা। তারপর হবে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ। পূর্ব সুন্দরবনের ত্রাশ মাস্টার বাহিনী বিলুপ্ত হয়েছে। এই নামে আর কোনো চাঁদাবাজি হয় না। মাস্টার বাহিনী নামে কাউকে অপহরণ করা হচ্ছে না, বিরাট স্বস্তির ব্যাপার।

এখন মজনু বাহিনীকে নিয়ে কাজ করছি। এই দস্যুদলটি বিলুপ্ত হলে আমার কাজের ধারাবাহিকতা শুরু হবে। আর মজনু সারেন্ডার করলে তার প্রভাব পড়বে পশ্চিম সুন্দরবনে। অন্যরাও এগিয়ে আসবে। ভাবছিলাম, এই কাজটি চালিয়ে যেতে পারলে সুন্দরবন একদিন দস্যুমুক্ত হতেও পারে। যদিও শুভাকাঙ্খীরা বলতেন, সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হবে, সেই চিন্তা পাগলেও করবে না। আর আমি বলি, পাগলামি করতে করতে একটা কাজ হলেও হতে পারে। অসম্ভব ধরে নিয়ে কাজ বন্ধ করে বসে থাকার মানুষ আমি না।

কিছুক্ষণ আগে জঙ্গল থেকে ধরে আনা তিন কাঁকড়ার জেলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন লুঙ্গি পড়া, অন্য দুইজন শর্টস পড়া। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন সাঁটানো টি শার্টগুলো বেশ পুরনো, ছেঁড়া। স্যান্ডো গেঞ্জিগুলোও ছেঁড়া, মলিন। মানুষগুলোর চেহারাও মলিন হয়ে আছে। যদিও চোখগুলো একটু হিংশ্র প্রকৃতির। সুন্দরবনে থাকতে থাকতে এই মানুষগুলোর চেহারা এমন হয়ে যায়। মন খারাপ করে কথা বলে সবাই। কিন্তু চোখে পানি নাই। তখনও এঁদের মনোস্তত্ব খুব একটা বুঝি না। কিন্তু এটুকু বুঝি, বৈরী পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষেরা একটু রূক্ষ হয়।

কেমন আছেন আপনারা? মজনুর সাথে দেন দরবার শেষ হলো? এসময় পিছনে এসে দাঁড়ালো দস্যুদলের ম্যানেজার বা মুহুরি- রহমত। বললো, এরা শুরু থেকে এক টাকাও দেয়নি ভাই। এবার লোকটি বললো, রহমত আমার ভাগনে হয়। তারপরও দেখেন ধরে নিয়ে আসলো। আরেকটু হলে লাঠির বাড়িও দিছিলো। বললাম, কেমন ভাগ্নে আপনার? বললেন, আপন ভাগ্নে। আমার চোখ কপালে!

রহমতের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার নাম রহমত। কিন্তু মনের ভিতরে কোনো রহমত নাই। নিজের মামাকে ধরে আনছো? রহমত বললো, “জঙ্গলে ডাহাতি করতি আইসি বোলো! ওসব মামা টামা চিনি নে”! ছেলে বলে কী? লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখছেন সাহেব? আপন বোনের ছেলে যদি একথা বলে তাহলে যাবো কোথায়? করবো কী? জঙ্গল ছাড়া আমাদের তো আর যাওয়ার জায়গা নাই।

ও রহমত। তোমরা যে লোকগুলোকে ধরে আনলে, এটা তো অপহরণ! এ তো মহা অপরাধ! তাও আবার আমি এখানে আছি। আমার সামনে জেলেদের অপহরণ করলা? রহমত বললো, জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালে তো কেউ খেতে দিবে না ভাই। বরং সুযোগ পেলেই ধরিয়ে দিবে, পিটায়ে মেরে ফেলবে। এই যে আপন মামা আমার। বাড়ি গেলে সে আমাকে থাকতে দিবে? জিজ্ঞেস করেন তো?

এক রাতের জন্য লুকিয়ে বাড়ি গেছিলাম মায়ের সাথে দেখা করতে। এই মামাই তখন আমাকে ধরায়ে দেওয়ার জন্য পুলিশে ফোন দিছিলো। বললাম, এটা কি হয়? নিজের মামা তোমার! বললো, মামাকেই জিজ্ঞেস করেন ভাই। কথা সত্যি বললাম না মিথ্যা? কম কষ্টে ডাকাত হইনি ভাই। ভালো হওয়ার চেষ্টা করলে, নিজের লোকজনই হতে দেয় না। জঙ্গলের পাশে আমরা যারা থাকি, তাদের জীবনটাই এমন।

মাথা নিচু করে কথা বললেও বেশ উত্তেজিত রহমত। এই জঙ্গলে কেউ এমনি এমনি কিছু দেয় না ভাই। জোর করেই নিতে হয়। তাহলে তোমার মামাদের নিয়ে কী করবে এখন? অপহরণ তো করলে! বললো, এমনিতে গোনে দুই/তিন হাজার টাকা দেওয়ার কথা। এবার নামার পর এরা আমাদের টিকেট নেয়নি। এখন পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে তাদের। না দেওয়া পর্যন্ত আটকে রাখবো তাদের। বললাম, এতোগুলো টাকা দিবে কোত্থেকে?

লোকটি আবারও বললো, দেখছেন ভাই, কতো খারাপ এরা। আপন মামাকেও ছাড় দিবে না। রহমত বললো, তোমাকে ছাড়লে অন্যরাও টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিবে। আমরা খাবো কী তখন? চলবো কী করে? বললাম, কয়দিন পরেই তো সারেন্ডার করবে। এ দফায় ছেড়ে দাও উনাদের। রহমত বললো লিডার ছাড়া এই কাজ আমি করতে পারবো না। মজনু ভাইকে বললাম, এদের ছেড়ে দিয়েন ভাই। কয়দিন পর তো উঠেই যাবেন। দস্যুনেতা বললো, এই তোমরা নৌকায় যাও। ভাই যখন বলছে তখন ছাড়বো। কিন্তু এখনই না। এক/দুই দিন পর ছাড়বো। আর তোমরা বলবে, পঞ্চাশ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাইছো। তা না হলে কেউ আমাদের গোনের টাকা দিবে না। জেলে তিনজন হাঁটা দিলো তাদের নৌকার দিকে। জানি না ওরা কী মনে করলো আমাকে। পরিচয় তো দেওয়া হয়নি।

জোয়ার ততোক্ষণে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। গোন শুরু হয়েছে বলে পানির চাপও একটু বেশি। মজনুকে বললাম, এই জোয়ারেই উঠতে চাই। রাত হয়ে গেলে আবার ভাটা হয়ে যাবে। তখন নৌকা বেয়ে যেতে কষ্ট হয়ে যাবে। সহকর্মীদের বললাম গোছগাছ করে রাখেন। সবকিছু আমাদের ওই নৌকায় তুলে রাখেন। উনারা গ্রিন সিগন্যাল দিলেই রওনা হবো।

আলমগীর ভাই কই? তাকে দেখছি না যে? দেখি নৌকার ভিতরে শুয়ে আছে। দস্যুনেতার নৌকায় দেখি এনামুলও ঘুমাচ্ছে। ওইটুকু জায়গার মধ্যেই হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে আছে। আমাদের মাঝিও বিশ্রাম নিচ্ছে তার নৌকায়। ডাক দিতে গিয়ে ভাবলাম, আরেকটু ঘুমাক। আমাদের রওনা হতে হতে আরও কয়েক ঘন্টা লেগে যাবে। সম্ভবত দস্যুরা রাতের ভাটায় ছাড়বে আমাদের। সুন্দরবনের এই দস্যু জগতে ইচ্ছা মতো কিছুই করা যায় না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top