রূপান্তরের গল্প ১৫৮ | Rupantorer Golpo 158

গোপন পথ ধরে ফিরলাম লোকালয়ে | রূপান্তরের গল্প ১৫৮

গোপন পথ ধরে ফিরলাম লোকালয়ে | রূপান্তরের গল্প ১৫৮ | Rupantorer Golpo 158 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৫৮ : মনে পড়লো গুলির শব্দের কথা! বললাম, কোথায় গেছিলা তোমরা? কোন খালে? কী নিতে গেছো বলো তো? ওরা অকপটে বলে ফেললো, শিকারে গেছিলাম মামা। হরিণ খাবে আগে বললে হতো। জোয়ার হয়ে গেলে ওরা থাকে? এসময় শিকার করা যায়? বললাম, হরিণ মারতে পারোনি? তাহলে গুলি করলে কীসে? পাশ থেকে একজন বললো, যে জায়গায় গেলাম মামা! ওখানে বাদাটা উঁচু। বড় জোয়ারেও পানি ওঠে না। কেওড়া বাগান। জোয়ার ভাটা লাগে না। ওখানে হরিণ দেখা যায় সারা বছর।

তাহলে গুলি কি ড্যাম ছিলো? না কি ভিতরে স্প্লিন্টার ছিলো না! বলছি, গুলি যখন করলে, লাগাতে পারলে না কেন? ওরা বললো, আজকে কী যে হইছে মামা! অন্য সময় হরিণ মুখের সামনে এসে ঘুরে বেড়ায়। আজকে কোথাও দেখলাম না। দেখেন না গতকাল খেকে হরিণের একটা ডাকও শুনলাম না! বললাম, কিছু পায়ের ছাপ ছাড়া তো কিছুই দেখলাম না! এই জঙ্গলে হরিণ নাই কেন? এনামুল বললো, পুরো জঙ্গল এপাশ ওপাশ ডোয়া পাতানো। ডোয়া মানে হরিণ ধরার ফাঁদ। দড়ি দিয়ে বানানো হয়। লম্বা করে জঙ্গলের ভিতরে টানিয়ে দেয় চোরা শিকারীরা।

হরিণের চলার পথেই বসানো থাকে ফাঁদ। হাঁটার সময় ধোঁকা খেয়ে ফাঁসে আটকা পড়ে তারা। বললো, আগে শিকারীদেরও ধর্ম ছিলো। এখন ওরাও খারাপ হয়ে গেছে। বললাম, ধর্ম তো সবারই আছে! শিকারীদের ধর্মটা কী রকম? বললো, জীবনে অনেক শিকারী দেখছি! তারা কিছু নিয়ম মেনে চলে। মাদী হরিণ মারে না। বাচ্চা হরিণ ধরে না। পোয়াতি হরিণের গায়ে হাত দেয় না। ডোয়া পাতলেও শিকার শেষে সেটা উঠিয়ে ফেলে!

এখনকার শিকারীরা সারা বছর জঙ্গলে ডোয়া পেতে রাখে। প্রতিদিন বা একদিন পর পর এসে চেক করে। আটকা পড়া মাল খুলে নিয়ে যায়, বিক্রি করে। কিন্তু মাঝে মাঝে কোনো কারণে এক সপ্তাহ না আসলে কী অবস্থা হয় বোঝেন? বললাম, কী হয়? এনামুল বললো, ধরেন একটানা তিনশ’ ফাঁশ। তাতে আটকা পড়ে যায় ২০/৩০টা হরিণ, কখনও আরও বেশি। ওই অবস্থায় মারা যায় তারা। পঁচে গলে জঙ্গলটা নষ্ট হয়ে যায়। সুন্দরবনের পেশাদার হরিণ শিকারীরা বন্দুক ব্যবহার করে না। শখের শিকারীরা গুলি করে হরিণ মারে মাঝে মাঝে। আর আমরা নিজেদের খাওয়ার জন্য মারি।

এবার বলো, হরিণ মারতে পাঠালো কে তোমাদের? আমি তো বার বার না করছিলাম। নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলো দুইজন। বন্দুকের চেম্বার থেকে গুলি বের করতে করতে বললো, সাথে মাছ নাই তো ভাই। তাই খাওয়ার জন্য শিকারে গেলাম। দস্যুনেতা মজনুকে বললাম, কাজটা ঠিক করেননি ভাই।

আসলে হরিণ শিকার, পাখি শিকার এই জঙ্গলে মাছ শিকারের মতো সাধারণ বিষয়। দৈনন্দিন ব্যাপার। বললাম, ভাগ্যিস বাঘ শিকার এখানে দৈনন্দিন ব্যাপার না! আলমগীর ভাইকে বললাম, নৌকায় ডাল আছে না? রাতের জন্য খিচুরি রান্না করেন। দেখি, আপনার রান্নার হাত কেমন! উনি বললেন, মসলা রেডি করছিলাম হরিণের মাংস রান্না করবো বলে। বললাম, সেই মসলা দিয়ে খিচুরি করেন।

কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছেন মজনু। বললেন, পুরো জোয়ার হয়েছে। বড় খালের মাঝখানে গেলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে। দস্যুনেতার নৌকাটি নিয়ে রওনা হলাম। বড় খালে বের হয়ে জায়গা মতো পৌঁছাতে মিনিট পনেরো লাগবে। নামার দিকে প্রথম বাঁকটা পার হয়েই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।

ফোন খুলতেই নেটওয়ার্ক পেলাম। দস্যুনেতাকে বললাম, আমাদের ফিরার পথে RAB বসা। তার মানে ওরা আমাদের অনুসরণ করছে। তাহলে আপনার আমার ফোন ট্র্যাক করা অসম্ভব না। যার সাথেই কথা বলেন, সতর্ক থাকবেন। আমাদের লোকেশনের ধারণাও যেন কেউ না পায়।

একটার পর একটা ফোন চলছে। এর মধ্যে ঢুকলো নোয়া মিয়ার ফোন। আমার সাথে কথা বলতে চান। ফোনটি হাতে নিয়ে লাউড স্পিকারে দিলাম। আমি কোনো গ্যাপ রাখতে চাই না। স্পর্শ্বকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলবো। সেটা মজনুরও শোনা দরকার।

দস্যুনেতা নোয়া মিয়া বলছিলেন, ভালো নাই তারা। বললাম, তাহলে মজনুর সাথে সারেন্ডার করে ফেলেন। নতুন করে দস্যুদল বড় করার দরকার নাই। অবৈধ অস্ত্র কেনাকাটার জন্য আপনি এতো দৌড়ঝাঁপ করছেন কেন বুঝলাম না। যদি সারেন্ডারই করবেন তাহলে সাথে যা আছে তাই নিয়ে চলে আসবেন। বললেন, কিছু খরচ আছে না ভাই? সারেন্ডারে গেলে অন্তত পঞ্চাশ লাখ টাকা লাগবে। আমাদের সবকিছু তো মাস্টার খেয়ে দিলো। আর সারেন্ডার কি খালি হাতে করবো? মানে কাছে কয়েকটা অস্ত্র আছে। বেশি কিছু নাই। সেজন্য মজনু ভাইয়ের এক্সট্রা মেশিনগুলো কিনতে চাচ্ছিলাম। এখন আমাদের যে কয়টা অস্ত্র আছে সেগুলোও তার কাছ থেকে নেওয়া। বললাম, আপনারা এই অবৈধ অস্ত্র-গুলি কেনা বন্ধ করেন। আর একটা অস্ত্রও কেনা-বেচা হবে না। ঠিক আছে মজনু ভাই?

মজনু সায় দিলেন। দুজনকেই বললাম, টাকা পয়সার বিষয়টা একটু বুঝান আমাকে। এই যে বলছেন, ২০ লাখ ৫০ লাখ টাকা লাগবে সারেন্ডার করতে। টাকাটা কোথায় লাগবে? নোয়া মিয়া বলছেন, আপনাদের একটু খরচ দিতে হবে না ভাই? আমি আকাশ থেকে পড়লাম! আমার খরচ লাগবে কে বললো আপনাকে? মজনুকে বললাম, আপনিও কি আমার জন্য খরচ রেখেছেন? বললেন, বেশি কিছু করতে পারবো না ভাই। ১৫/২০ লাখ ব্যবস্থা করবো আমরা। এবার মেজাজটাও একটু গরম হয়ে গেলো।

বললাম, আপনারা এতো কিছুর খবর রাখেন, সারেন্ডার করতে টাকা লাগে না এই খবরটা রাখেন না? উনারা বললেন, এটা অন্য ভাবে নিবেন না ভাই। আপনি এতো কষ্ট করছেন আমাদের জন্য, সেজন্য উপহার হিসাবে এটা দিতে চাই। বললাম, আপনাদের জন্য কাজটি করছি না আমি। করছি এই জঙ্গল আর সাগরের জেলেদের জন্য। আপনাদের কারণে কেউ শান্তিতে নাই। ফোন রাখতে রাখতে বললাম, আপনারা সারেন্ডার করলে করবেন, না করলে নাই। বাড়ি ফিরার ইচ্ছা থাকলে সারেন্ডার করবেন। আর জঙ্গলে গুলি খেয়ে মরতে চাইলে থেকে যান।

মজনু বললেন, রাগ করেন না ভাই। আসলে আমাদের সাথে যারাই যোগাযোগ করে, তারাই কিছু চায়। না চাইলেও আমরা দেই। বললাম, এই যে আমাকে নিয়ে আসলেন, বাজার সদা করলেন, এটাও আমার খাওয়া উচিৎ না। জেলেদের কাছ থেকে জুলুম করে নেওয়া টাকার খাবার খেতে ভালো লাগে না। কিন্তু এই জঙ্গলে আর কিছু করারও নাই। তাই এখন থেকে আমার জন্য কিছু করার চিন্তা করবেন না।

আরেকটা নাম্বারে ডায়াল করলেন মজনু। ফোন ধরে ওপাশ থেকে একজন বললো, সারাদিন ফোন বন্ধ কেন সাহেব? এদিক তো পুরাই গরম। স্যারেরা রাতেও থাকবে নদীতে। আপনাকে বাজার দিতে গেছে যে নৌকা সেটা ধরবেই আজকে। মজনু বললেন, সে খবর পাইছি আমরা। তুমি সারা রাত নজর রাখো, খবর রাখো। স্যারেরা নদী থেকে উঠলে খবর দিবে। ফোনে মেসেজ দিয়ে রাখবে।

শেষ ফোনটি ছিলো ইয়াকুব সাংবাদিকের। দুপুরের ভাটার মাছ নিয়ে রাতের জোয়ারে উঠেছেন তিনি। বললেন, প্রশাসন খুব তৎপর। মোহসীন ভাই নেমেছেন সেই খবর মনে হয় পেয়ে গেছে সবাই। উনাকে আটকানোর জন্য পুরো নদীতে পাহাড়ায় বসেছে। মনে মনে ভাবছি যারা আমাকে ধরতে পাহাড়ায় বসেছে, তাদের শীর্ষ কর্তাদের সাথে কথা বলেই তো নামলাম। তারপরও কেন এমন হচ্ছে? ঠিক বুঝতে পারছি না।

মনের কথা মনেই রাখলাম। মজনুকে বললাম, চলেন ভাই খালের ভিতরে যাই। খিচুরি রান্না হলো। খেতে খেতে বললাম, এই রাতেই রওনা দিবো আমরা। আলমগীর ভাই লাফ দিয়ে উঠলেন। ভাবলাম না করবেন। উনি বললেন, জঙ্গলে প্রশাসনের সাথে লুকোচুরি করতে খুব মজা লাগে ভাই। বললাম, আমারও মজা লাগে। সিদ্ধান্ত হলো, খেয়ে বিদায় নিবো আমরা।

কথা বার্তা চুড়ান্ত। আপনাদের প্রস্তাব পৌঁছে দিবো সরকারের কাছে। বেশি দিন সময় লাগবে না। আপনারা প্রস্তুত হন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিন-ক্ষণ ঠিক করেই চলে আসবো। আপনাদের নিয়ে যাবো। সারেন্ডার করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন আপনারা।

নৌকা ভাসলো। সামনে বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। সবার চোখ এড়িয়ে আমাদের ফিরতে হবে লোকালয়ে। নৌকার সামনে আলমগীর ভাই। তারপর বসলাম আমি। মাঝে সহকর্মী তিনজন। পিছনে নৌকার মাঝি। ছোট ছোট খাল আর ভাড়ানী পেরিয়ে চলছি আমরা। মাঝি ভাই বললেন, এমন জায়গা দিয়ে বের হবো আমরা, প্রশাসন চিন্তাও করতে পারবে না। প্রায় চার ঘন্টার পথ পেরিয়ে ওই রাতেই ফিরলাম লোকালয়ে। পুরোটা সময় সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ দিলাম আলমগীর (ছদ্মনাম) ভাইকে, ধন্যবাদ জানালাম ওই নৌকার মাঝি ভাইকে।

তখন শেষ ভাটা। কাঁদা পেরিয়ে সোজা উঠলাম সড়কে রাখা অফিসের গাড়িতে। গাড়ি ছাড়লো, একটানে ঢাকা ফিরবো। ভাবছিলাম, এ দফায় নিরাপদে ফিরলাম ঠিকই। কিন্তু সামনের কাজগুলো সহজ হবে না। যাদের নিয়ে কাজগুলো এগিয়ে নিবো, মাঠ পর্যায়ে তাদের অসহযোগিতার বিষয়টি ভাবাচ্ছে খুব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top