দুটি দস্যুদল একসাথে সারেন্ডার করবে, শুরু হলো মধ্যস্ততা | রূপান্তরের গল্প ১৫৯ | Rupantorer Golpo 159 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৫৯ : মজনু বাহিনীর সাথে দেখা হওয়াটা নির্ধারিত ছিলো না। হঠাৎ করেই হয়ে গেলো সবকিছু। দস্যু বাহিনীর সঙ্গে কাটানো সময়টুকু ছিলো ঘটনাবহুল। ঝুঁকিও ছিলো বাঁকে বাঁকে। তবে ভাগ্য সহায় ছিলো বলে বিপদে পড়িনি। আসলে সুন্দরবনটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এখনও। জটিল সব সমীকরণ মিলিয়ে চলতে জানতে হবে অনেক কিছু। এছাড়া চেনা জানা মানুষেরা কে কোন পক্ষ্যের তাও বুঝতে হবে। অচেনা শত্রুদেরও চিনতে হবে। আর এসব না জেনে কাজ করতে গেলে বিপদ হবে নিশ্চিত। আর কিছু না হলেও কাজটি ব্যর্থ হবে। ভেস্তে যাবে এতো বছরের চেষ্টা। আর বড় বিপদ বলতে প্রাণটাও চলে যেতে পারে।
মুন্সিগঞ্জ বাজার পার হয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। সঙ্গে আলমগীর ভাইও রওনা হয়েছেন। এই মুহুর্তে তাঁর জন্য বাড়ি যাওয়া, এলাকায় থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকের খেলাধূলাগুলো অস্পষ্ট বলে ঝুঁকি নিবো না। যদিও উনি বলছিলেন সমস্যা নাই। তবুও বললাম, কয়েক দিন একটু দূরে থাকেন। বললেন, আমি না হয় দূরে থেকে বাঁচবো। কিন্তু নৌকার মাঝির তো সরে থাকার সুযোগ নাই। পেট চালানোর জন্য তাকে জঙ্গলে যেতে হবে, থাকতে হবে বাড়িতে। বললাম, দুইজনকে বিপদে ফেলে তো লাভ নাই। আপনি সরে থাকেন। মাঝি ভাইয়ের কোনো বিপদ হলে দেখবো আমি।
রাস্তা বেশি খারাপ। ঝাঁকি খেতে খেতে শ্যামনগর পৌঁছালাম। ততোক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে। বাস স্ট্যান্ডের পাশেই একটি ছোট্ট রেস্তোঁরা খুলেছে। তার পাশেই চায়ের দোকান। গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে কড়া লিকারের চা পাওয়া যায় এখানে। ভেবেছিলাম কালীগঞ্জে বিরতি নিবো। কিন্তু দুথ চায়ের লোভ সামলাতে পারলাম না। নেমে পড়লাম। চা-নাস্তা সেরে রওনা দিলাম। সাতক্ষীরায় নেমে গেলেন রাজীব ও আলমগীর ভাই। নিজাম উদ্দীনকে নামিয়ে দিলাম বাগেরহাটের কাঁটাখালীতে। এবার ঘুমের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।
ঘুম ভাঙ্গলো বাংলাবাজার ফেরি ঘাটে এসে। ভীড় ঠেলে ফেরিতে উঠতে সময় লাগলো প্রায় দুই ঘন্টা। এর মধ্যে ফোনে কথা হলো সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। RAB-এর গোয়েন্দা প্রধানকে জানালাম বিস্তারিত। বললাম, খুলনাতেই সারেন্ডার করতে চায় মজনু বাহিনী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সময় দিলেই ওরা সারেন্ডার করবে। আপনারা আলাপ করেন। দস্যুদলটির সদস্য সংখ্যা ও অস্ত্র-গুলির আনুমানিক সংখ্যাও জানিয়ে রাখলাম।
দুপুরের দিকে আসলো ইলিয়াসের ফোন। মজনু সত্যি সারেন্ডার করবে ভাই? বললাম, সে যা করে করুক। আপনার খবর বলেন। সে বললো, স্ত্রী সন্তান নিয়ে আত্মগোপনে থাকা খুব কঠিন ভাই। কাজ করে তো খেতে হবে। এখন ভ্যান চালিয়ে কি ফেরারি জীবন কাটানো যায়? জঙ্গল ছেড়েছি কিন্তু ডাকাত নামটা তো নিয়ে আসছি। সুন্দরবনের দস্যুনেতা ইলিয়াস আমি। এই নাম নিয়ে লুকিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব। বললাম, কোথায় আছেন জানতে চাই না। কিন্তু ডাক দিলেই হাজির হবেন। সুন্দরবনে আপনার লুকিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো বের করবেন। তারপর সারেন্ডার করবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে।
অনেকে প্রশ্ন করবেন, দস্যুতা ছেড়ে দেওয়া একজনকে কেন আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হবে? তার উত্তর হলো, ফেরারি অপরাধীকে ফেরারি অবস্থায় রেখে তাকে অপরাধ জীবন থেকে ফিরানো যায় না। বিশেষ করে সুন্দরবনের দস্যুদের ক্ষেত্রে এই সূত্র শতভাগ সত্য। ইলিয়াস আপাতত ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়। দৈনিক রোজগার তিনশ’ থেকে বড়জোর পাঁচশ’ টাকা। এই টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকা খুব কঠিন।
মাথার ওপর পাঁচটি মামলা ঝুলছে। পলাতক থেকে সেগুলো চালিয়ে নিতে খরচ হচ্ছে দ্বিগুন। ভ্যান চালিয়ে সেই খরচ মিটানো কি সম্ভব ভাই? শশুর বাড়ির দিকে কিছু জমি আছে। সেগুলোও বেদখল। এখন বউ বাচ্চাদের সেখানে পাঠিয়ে দিলেও জমি ফেরত নিতে পারবে না। বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না ভাই। সুন্দরবনে কোটি টাকার লোভ ছেড়ে আসছি একটু সুন্দর করে বাঁচবো বলে। জমানো টাকাগুলো সব দালালেরা খেয়ে ফেলছে। এখন আবার জঙ্গলে নামা ছাড়া উপায় নাই।
এটাই ইলিয়াসকে সারেন্ডার করতে দেওয়ার কারণ। পলাতক বনদস্যুরা ঘুরেফিরে সুন্দরবনে ফিরে আসে। ডাকাতি ছেড়ে ভালো হওয়ার অনেক চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। ইলিয়াসের বিষয়ে আগেই RAB-এর গোয়েন্দা প্রধান লে কর্নেল আজাদের সাথে কথা হয়েছে। তিনি উর্ধতনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাকে সারেন্ডার করানোর বিষয়ে কাজ এগুনোর পরামর্শ দিয়েছেন। বিষয়টি ইলিয়াসকে জানালাম। বললাম শর্ত একটাই, জঙ্গলে চাপানো আপনার অস্ত্র-গুলিগুলো বের করে দিতে হবে।
ইলিয়াস বললো, অস্ত্রগুলো অন্য কেউ তুলে না নিলে পেয়ে যাবো। শিবসার বাওনে আছে। জায়গা মতো পৌঁছে গেলেই বের করে দিতে পারবো। বললো, জায়গাটা ম্যাপ করে দিলে আপনি গিয়ে বের করতে পারবেন না? বললাম, হয়তো পারবো। কিন্তু আপনাকে নিয়েই যাবো সেখানে। আসলে সাংবাদিক হিসাবে আমি কতোটুকু কী করতে পারবো এবিষয়ে এখনও পরিস্কার না। তবে নাগরিক হিসাবে আমি অনেক কিছুই করতে পারি। আবার আইন কানুন ভেঙ্গে কিছু করা নাগরিক হিসাবেই অনুচিৎ। আবার ভাবছি, মানুষের ভালোর জন্য কিছু আইনকে পাশ কাটানো ছাড়া পুরো কাজটি শেষ করা সম্ভব না। সংকোচ আর সংশয় নিয়েই এগুতে হবে আমাকে।
অফিসে ফোন দিলাম। জানালাম কাজের অগ্রগতির কথা। বললাম, নতুন এক্সক্লুসিভ আমার হাতে। আমার প্রধান বার্তা সম্পাদক ফাহিম আহমেদকে জানিয়ে রাখলাম। বললেন, আপনি তো অন্য একটা কাজ করতে গেলেন! এর মধ্যে সুন্দরবনেও ঢুকেছেন? আদ্যোপান্ত জানালাম তাঁকে। বললেন, তাহলে মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডারের খবর পেয়েছে তারা। লেগে থাকেন। মন দিয়ে কাজ করেন। অফিসের পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে। বললাম, ঢাকা ফিরে বিস্তারিত কথা হবে।
একদিন বিশ্রাম নিয়ে অফিস শুরু করলাম। পরদিন গেলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায়। কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে আমাকে কাজ এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। একই সঙ্গে RAB মহাপরিচালককে ফোনে জানালেন সেই সিদ্ধান্তের কথা। ব্যাস। আমাকে আর পায় কে? বের হয়ে প্রথমে ফোন দিলাম মজনুকে। তারপর জানালাম ইলিয়াসকে। দুজনকেই প্রস্তুত হতে বললাম।
কী ভাবে হবে সারেন্ডার? মানে কার মাধ্যমে সারেন্ডার করবো আমরা? বললাম, RAB-এর মাধ্যমে হবে। মাস্টার বাহিনী যেভাবে সারেন্ডার করেছে, হুবুহু একই পদ্ধতিতে সারেন্ডার করবেন আপনারা। বললাম, গেলোবার বরিশাল RAB করেছিলো পুরো কাজ। এবার করবে খুলনা। মজনুও চায় খুলনা RAB-এর মাধ্যমে সারেন্ডার করতে। কিন্তু ইলিয়াস চায় বরিশালের মাধ্যমে। মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডারের পর পর মেজর আদনান কবীরের সাথে ইলিয়াসের যোগাযোগ করিয়েছিলাম আমি। তখন থেকে যোগাযোগে তারা। ইলিয়াসকে বললাম, আমি যে ভাবে বলবো সেভাবে চলতে হবে আপনাকে। আমি সদর দফতরের সাথে আলোচনা করে যা করার করছি। আসলে বিষয়টি বেশ জটিল। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর অভ্যন্তরীন বিষয়গুলো নিয়ে আমার কথা বলা অনুচিৎ। আমি তো শুধু দূতিয়ালী করছি, মধ্যস্ততা করছি।
ইলিয়াস ও মজনু, দুইজনই জঙ্গলের ডাকসাইটে দস্যুনেতা। একসাথে এদের সারেন্ডার আলোড়ন তুলবে সুন্দরবনের দস্যু জগতে। আগে থেকে পরিকল্পনা করা ছিলো না এসব। কেমন করে জানি একসাথে মিলছে সবকিছু। মজনুর সাথে যোগাযোগ শুরু হলো। হঠাৎ করেই দেখা হলো তার সাথে। একই সময় অজ্ঞাতবাস থেকে আরেক দস্যুনেতা ইলিয়াসের এগিয়ে আসাটা কাকতালীয়। সব মিলিয়ে একটি কথাই মনে হচ্ছে। সামনে অনেক কঠিন পথ। তবে লেগে থাকতে পারলে সবগুলো দস্যুদল আত্মসমর্পণ করবে। তবে সেই কাজ করতে গেলে জীবন-মরণ বিপদও আসবে। তাই নিজেকে বাঁচিয়ে কাজ এগিয়ে নেওয়াটা শিখতে হবে এখন।