ইলিয়াস- বনদস্যু হয়ে ওঠার গল্প | রূপান্তরের গল্প ১৬৩ | Rupantorer Golpo 163 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৬৩ : ২০১১ পরবর্তী সময়ে সুন্দরবনের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ দস্যুবাহিনীটির নাম ছিলো ‘ইলিয়াস বাহিনী’। শুধু বনের ভেতরেই নয়, বঙ্গোপসাগরজুড়ে এই দস্যুদলের তান্ডবের কথা জেলে বাওয়ালীরা ভোলেনি। উপকূলের জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীরা “ইলিয়াস” নামে কাঁপতো। অথচ এই ইলিয়াস ছিলো জেলে নৌকার সামান্য এক সহকারী। ট্রলিরের কেবিনের ভিতরে বসে শুনছিলাম তার বনদস্যু হয়ে ওঠার গল্প।
কয়রায় জা বক্স নামের এক মাছ ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর ভরের নৌকায় মাসিক বেতনে কাজ করতো ইলিয়াস। কাজ বলতে ট্রলারে জমে থাকা পানি ফেলা, নোঙ্গর ফেলা-উঠানো, নৌকা বাঁধাসহ টুকটাক অনেক কিছু। এসব করতে করতে ট্রলারে ইঞ্জিন সম্পর্কেও ভালো ধারণা নিয়ে ফেলে সে। ভালো ইঞ্জিন মেকানিক হয়ে ওঠে সে। চিনে ফেলে গহীন বনের এমাথা ওমাথা।
পশ্চিম সুন্দরবনের এক খালে আক্রমণ করে বনদস্যুরা। জেলেদের অপহরণ করে, ট্রলার সহকারী ইলিয়াসকেও তুলে নেয়। এরপর মুক্তিপণ চায় দস্যুরা। জন প্রতি ২০ হাজার টাকা দাবি ছিলো। সঙ্গী সাথীরা একে একে মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু ইলিয়াস নামের সেই কিশোরের জন্য মুক্তিপণ তো দূরের কথা, একটা ফোনও আসেনি কোথাও থেকে। বাড়ি থেকেও কেউ ফোন দেয়নি। এভাবে দিন পেরিয়ে সপ্তাহ, তারপর মাস পেরিয়ে যায়। কেউ খোঁজও নিচ্ছিলো না।
কেউ খোঁজ না নিলেও খবর ছড়িয়ে যায় চারপাশে। খবরটি ছিলো যে ইলিয়াস ডাকাত দলে যোগ দিয়েছে। মহেশ্বরীপুরে তার বাড়ি। সেদিকেও ছড়িয়ে যায় সে খবর। ওই অবস্থায় এলাকায় ফিরলে গণপিটুনি হতে পারে, আইন শৃংখলা বাহিনী গ্রেফতার করে ফেলতে পারে, আবার ক্রস ফায়ারও হতে পারে। কী করবে ভাবছিলো সে। দস্যুনেতা মুক্তিপণ ছাড়াই ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু এই ডাকাত পরিচয় নিয়ে উঠলো না সে। ভাবতে ভাবতে সময় গড়ায়। দস্যুদলের অন্যদের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। থেকে যায় সে। তবে বয়স অল্প বলে ইলিয়াসের হাতে অস্ত্র দেয়নি দস্যুনেতা।
একবার সাগরে ডাকাতি করে ফেরার পথে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। কী করবে এখন? সাগরে এভাবে ভেসে থাকলে তো মহা বিপদ! জেলেরা যদি জানতে পারে যে দস্যুদের ট্রলার নষ্ট! পাল্টা আক্রমন করবে, পিটিয়ে মারবে। এসময় অল্প সময়ের মধ্যে ইঞ্জিন ঠিক করে ফেললো ইলিয়াস। বেঁচে গেলো তারা। ব্যস। এই একটি কারণে ইলিয়াসকে পছন্দ করে ফেলে দস্যুনেতা। সদস্য করে নেওয়া হয় তাকে। কৈশোরেই শুরু হলো ইলিয়াসের দস্যু জীবন। শুরুতে জাহাঙ্গীর বাহিনীতে দস্যুতা করে সে। এর পর পরই যোগ দেয় রাজু বাহিনীতে।
ট্রলার কোন দিকে যাচ্ছে? আলমগীর ভাই পাশে এসে বসতেই প্রশ্নটি করলাম। জানালেন, আমরা যাচ্ছি চুনা নদী দিয়ে। পশুরতলা থেকে কালির খাল, এর মধ্যে কোথাও আছে মজনুরা। বললাম, ভিতরে আছি আমি। আপনি বাইরের সবকিছু খেয়াল রাখেন। আর পিছনে আসা RAB-এর ট্রলারের দিকে খেয়াল রাখেন। ওরা যেন চোখের আড়াল না হয়। ইলিয়াসকে সঙ্গ দেওয়াটা এখন জরুরি। আমি সেখানেই বসলাম। গল্প চলছে ইলিয়াসের সাথে।
আমার সঙ্গে ইলিয়াসের প্রথম দেখা রাজুর আস্তানায়, ২০১০ সালে। দস্যু দলটিতে প্রায় একশ’ সদস্য ছিলো। তাদের মধ্যে থেকে ইলিয়াসের কথা মনে থাকার কথা কী? আমরা যখন নিউজের জন্য চিত্রধারণ করছিলাম, তখন তাদের সকলেই সতর্ক ছিলো যাতে কারও চেহারা না আসে। ব্যতিক্রম ছিলো শুধু ইলিয়াস।
সেদিন হাতে থ্রি নট থ্রি বন্দুক নিয়ে একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসেছিলো ইলিয়াস। বাম হাতে সিগারেট। আমাদের দেখে নিজে থেকেই ছবি নিতে বললো সে। রাজু বাহিনীর শ্যুটিং করার সময় একমাত্র এই দস্যুর ছবিই তুলেছিলাম সেদিন। কাজ শেষ করে ঢাকা ফিরেছি। তারপর অনেকের সঙ্গে কথা হলেও ইলিয়াসের সঙ্গে কথা হয়নি কোনোদিন।
সামান্য এক দস্যু থেকে ধীরে ধীরে দস্যুনেতা রাজুর আস্থা অর্জন করেছে ইলিয়াস। আকৃতিতে ছোটখাটো হলেও বনের ভেতরে চলাফেরা, আত্মরক্ষা, অন্য বাহিনীর উপর আক্রমণে ক্ষিপ্রতাসহ নানা কারণে দস্যুদলের অতিপ্রয়োজনীয় একজনে পরিণত হয় সে। ডাকাত নেতা রাজুর বিশ্বস্ততা অর্জনের পর তাকে মূল ট্রলারটি চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এভাবেই চলছিলো।
এরই মধ্যে রাজুর আস্তানায় আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযান হয়। কয়েক দিনের মাথায় পালিয়ে আত্মগোপণে যায় রাজু।
এরপর শহীদুলকে দেওয়া হয় দলের দায়িত্ব। নানা কারণে সেই নেতৃত্ব মানতে পারেনি রাজুর ভাইসহ অন্য দস্যুরা। বিশেষ করে যখন আত্মসমর্পণের কথা শুরু হয়, তখনই তাকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে রাজু। পালিয়ে থাকলেও সেখান থেকে দস্যুদল পরিচালনা করতো সে। এরপর শহীদুলকে ধরিয়ে দেয় তারা। পরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় সেই দস্যুনেতা। সেই সময় স্বজনদের কাউকে প্রধান করা হবে, সেই চিন্তা করলেও সবাইকে অবাক করিয়ে দিয়ে ইলিয়াসকে দস্যুনেতা বানায় রাজু। সেদিন থেকে জন্ম ইলিয়াস বাহিনীর। সুন্দরবন আর বঙ্গোপসাগরে ত্রাস সৃষ্টি করে সে। চলে একের পর এক আক্রমণ, অপহরণ।
ইলিয়াস ছিলো চতুর। সতর্কতার সঙ্গে দস্যুতা করার পাশাপাশি একেবারে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্তদের নিয়ে দলটিকে সাজায়। দুর্ধর্ষ সব দস্যুদের নিয়ে গড়ে তোলে শতাধিক সদস্যের বিশাল জলদস্যু দল। ২০১১ পরবর্তী সময় ইলিয়াস বাহিনীর দাপটে কোণঠাসা ছিলো বাঁকী দস্যুদলগুলো। জেলেরা কাঁপতে এই নামে।
বছর খানেকের মধ্যে পালিয়ে থাকা রাজুর সঙ্গে হিসাব নিকাশ নিয়ে দ্বন্দ্ব বাঁধে ইলিয়াসের। প্রাণে বাঁচতে সেখান থেকে পালিয়ে যায় ইলিয়াস। যাওয়ার সময় কয়েকটি অস্ত্র ও কিছু গুলি সুন্দরবনের ভেতরে লুকিয়ে রেখে যায়। এরপর মাঝে মাঝে ফোন দিতো। তবে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর যোগাযোগ বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সরকারের কাছে সারেন্ডারের উদ্দেশ্যে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা সেই অস্ত্রগুলো আজ বের করে আনা হলো।
মাত্র বছর দুই আগে যখন তাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন আত্মসমর্পনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলো ইলিয়াস। সেই লোকটিই এখন উদগ্রীব আত্মসমর্পনে।
সেই ইলিয়াস অস্ত্রসহ আমাদের পাশে বসা। একসাথে যাচ্ছি বনের ভিতরে। রাতেই দেখা হবে আরেক দস্যুদল মজনু বাহিনীর সাথে। এই সফরে আমার সহযাত্রী হলেন বেলায়েত সরদার।
(ছবি: পিছনে লুঙ্গি পড়ে দাঁড়ানো ইলিয়াস)