রূপান্তরের গল্প ১৬৪ | Rupantorer Golpo 164

সামনে আমরা! পিছনে RAB-এর ট্রলার! | রূপান্তরের গল্প ১৬৪

সামনে আমরা! পিছনে RAB-এর ট্রলার! | রূপান্তরের গল্প ১৬৪ | Rupantorer Golpo 164 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৬৪ : মালঞ্চ নদীর মুখে আমরা। ট্রলারের গলুই-এ দাঁড়িয়ে আমি। বাঁক ঘুরে ঢুকে পড়বো বড় নদীতে। ঠিক এই সময় টর্চ জ্বললো ডান পাশ থেকে। ঘন ঘন ইশারা দিচ্ছে। থামতে বলছে, ফরেস্ট অফিসের ঘাটের দিকে যেতে বলছে। এটি কদমতলা ফরেস্ট স্টেশন। সুন্দরবনের এই অঞ্চলে সাধারণত ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলে না। তাই মনে হয় ভড়কে গেছেন উনারা। আলমগীর ভাই বললেন, সিগন্যাল দেখার দরকার নাই। সুকানিকে চালিয়ে যেতে বললেন। দ্রুত গতিতে বাঁক নিলো ট্রলার। ওদিক থেকে এবার চিৎকার শুরু করলেন বনরক্ষীরা।

আমরা না দেখার ভান করে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের পিছনে RAB সদস্যদের নিয়ে আরেকটি ট্রলার আসছে। সেখান থেকে বড় সার্চলাইট জ্বালিয়ে পাল্টা সিগন্যাল দেওয়া হলো। তারপর আমাদের অনুসরণ করে বামে বাঁক নিলো তারা। দুটি ট্রলার চললো দক্ষিণে। এই সফরে বেলায়েত সরদার যোগ দিয়েছিলেন শেষ মুহুর্তে।

প্রথমবার মজনু বাহিনী ছিলো কালির খালে। আমরা গেছি ডিঙ্গি নৌকায়। কিন্তু এবার ট্রলারে যাচ্ছি। তাই সময় লাগছে না। মালঞ্চ নদীর বাম পাশ ঘেঁষে যেতে বলেছে তারা। গলুই-এ দাঁড়ানো আলমগীর আর আমি। ধারণা করছিলাম এভাবে ঘন্টা খানেক চলতে হবে আমাদের। কিন্তু কিছু দূর আগাতেই একটি ডিঙ্গি নৌকা থেকে ছোট করে আলোর ইশারা দিলো কেউ। আমি না বুঝলেও আলমগীর ভাই সেই ইশারা বুঝে গেছেন। কথা থামিয়ে আমাকেও চুপ করালেন। কান খাড়া করে কিছু একটা বুঝার চেষ্টা করছেন তিনি।

আমাদের ট্রলারগুলো শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ থেকে ভাড়া করা। তবে সুকানিতে আছেন বেলায়েত সরদার। ক্যাপ্টেন বলে কথা। এদিকটা ভালো না চিনলেও বনদস্যুদের সাথে দেখা করতে গেলে কী ভাবে ট্রলার চালাতে হয় জানেন তিনি। এক হাতে সুকানি আর অন্য হাতে গতি নিয়ন্ত্রণের দড়ি। অন্ধকারের মধ্যেও আমাদের চোখাচোখি হচ্ছে। হাত তুলে ইশারা দিতেই গতি কমালেন। বললাম, একদম বাম পাশ ঘেঁষে আগাতে থাকেন।

কিছুদিন আগে মজনু বাহিনীর ডেরায় এসেছিলাম। সেবার নৌকায় করে আসি। ঘটনাবহুল সেই সফরের ফলাফল পেতে যাচ্ছি আজ। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা হয়ে যাবে দস্যুদলের সঙ্গে। আমাদের সাথে সকাল থেকে আছে আরেক দস্যুনেতা- ইলিয়াস। ভাবছি, ২০০৯ সাল থেকে কাজ শুরু। এক একটি দস্যুদলের সঙ্গে শুধু দেখা করার জন্য বছরের পর বছর কেটে গেছে। শত চেষ্টা করেও মজনুর দেখা পাইনি। পশ্চিম সুন্দরবনের কোনো ডাকাত সরদার দেখা দেয়নি। ফোনেও কথা বলতে চাইতো না কেউ কেউ। এড়িয়ে চলেছে মজনু, ইলিয়াসও। অথচ সেই ভয়ঙ্কর দুই দস্যুনেতা মুখোমুখি হবে আজ আমার সামনে। বন্দুক যুদ্ধ করতে না, সারেন্ডার করবে দুইটি দস্যুবাহিনী একসাথে।

ভরা জোয়ার তখন। গতি কমেছে বলে ইঞ্জিনের শব্দ কম। সামনে দাঁড়িয়ে মালঞ্চের পানি সরার শব্দ পাচ্ছি শুধু। আলমগীর ভাই তাকিয়ে জঙ্গলের দিকে। আমি তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে। এভাবে চললো কয়েক মিনিট। ছোট ছোট খাল পার করছি। একটু পর পর নদীর মধ্যে নেমে আসা গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগছে, কখনও গুঁতো খাচ্ছে পানির নিচের গাছের গুঁড়ির সাথে। পিছনের ট্রলারটিকে মাঝ নদী দিয়ে চালাতে বললাম। কাছাকাছি থাকলে ওই ট্রলারে থাকা RAB সদস্যদের দেখে দস্যুরা ভয় পেতে পারে।

আরও কতোক্ষণ এভাবে যাবো ঠিক নাই। সামনে আলমগীর ভাইকে রেখে পিছনে চলে আসলাম। সুকানির পাশে দাঁড়িয়ে সরদারকে বললাম, গতি বাড়াবেন না। মনে হয় আশেপাশের কোনো খালে আছে মজনুরা। ট্রলারের মূল মাঝি পাশে দাঁড়ানো। বললাম, চায়ের ব্যবস্থা আছে? সাথে সাথে ছোট্ট রান্নাঘরটির দরজা খুলে বসলেন তিনি। চুলা জ্বালানো হলো। চড়ানো হলো চায়ের পানি। বললাম, কড়া করে চা বানান। কাঁধের ব্যাগ থেকে দুধের প্যাকেট বের করে বললাম, দুধ চা-এ নেশা আমার। বেলায়েত সরদার বললেন, জায়গা মতো পৌঁছে নেই ভাই। তারপর রান্নাঘরের দায়িত্ব আমার। বলতে বলতে চুপ করে গেলেন বেলায়েত সরদার।

হাত তুলে থেমে যাওয়ার ইশারা করলেন আলমগীর ভাই। থামাতে থামাতে জঙ্গলের সাথে বেশ জোরেজোরে ধাক্কা খেলো ট্রলার। কোনো রকমে সামলে নিয়ে পিছনে সরলো ট্রলার। পাশে ছোট্ট এক খাল। তার ভিতর থেকে ছোট টর্চ লাইট দিয়ে ইশারা করলো। জানালো, সামনের খালে ঢুকতে হবে আমাদের।

খালের নাম পালোকাটি। ভিতর থেকে সিগন্যাল আসলো। RAB-এর ট্রলারটিকে মাঝ নদীতে নোঙ্গর করলো। বনদস্যু মজনুকে না আনা পর্যন্ত মালঞ্চের মাঝখানেই থাকবেন তাঁরা।

ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে পালোকাটি খাল ধরে। কিছু দূর যাওয়ার পর একটি নৌকা এসে ভিড়লো। দুইজন সশস্ত্র বনদস্যু লাফ দিয়ে উঠলো। সুকানিতে এসে দাঁড়ালো একজন। আরেকজন গলুই-এ। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মজনু বাহিনীর আস্তানায়। এই রাত ও কাল সারাদিন এখানেই থাকবো, হাতে অনেক কাজ। দস্যুদের লুকানো অস্ত্রতুলো বের করে আনতে হবে।

ট্রলার খামলো। নৌকা গুলো পাশে বেঁধে ফেললো তারা। এবার আর কোনো লুকাছাপা নাই। সোলার দিয়ে জ্বলছে বাতি। সশস্ত্র আরেকটি দস্যুদল মজনু সারেন্ডারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে ট্রলারের কেবিন থেকে বের করে আনলাম ইলিয়াসবে। বললো, আমাকে কী ক্রসে দিবেন ভাই? বললাম, আমার সঙ্গে হাঁটলে ভরসা করে হাঁটতে হবে! নৌকা থেকে মজনু ডাক দিলেন- উত্তর আসলো ভিতর থেকে! তারপর দুই দস্যুনেতা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। বললেন, তোমরা বাঁচে আছো?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top