রূপান্তরের গল্প ১৬৫ | Rupantorer Golpo 165

পালোকাটি খালে কাটবে রাত, মজনু বাহিনীর এবারের ডেরা | রূপান্তরের গল্প ১৬৫

পালোকাটি খালে কাটবে রাত, মজনু বাহিনীর এবারের ডেরা | রূপান্তরের গল্প ১৬৫ | Rupantorer Golpo 165 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৬৫ : দোর্দন্ড প্রতাপশালী দুই দস্যুনেতা হাত মিলাচ্ছেন, কোলাকুলি করছেন। আমরা কয়েকজন সেই দৃশ্যের সাক্ষী। অন্য সহযাত্রীরা হয়তো বিষয়টি সেভাবে বুঝবেন না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, কতোটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেলো সুন্দরবনে! অথচ জঙ্গলে থাকতে এরা কেউ কারও বন্ধু ছিলো না। গত কয়েক বছরে এরা কেউ কারও ছায়াও মাড়ায়নি।

ইলিয়াস ছিলো দারুণ সাহসী। কোনো কিছুকে পরোয়া করতো না। দস্যুতা করার সময় নিজের বাহিনীকে বিশাল এক দস্যুদলে রূপান্তরিত করেছিলো সে। ইলিয়াসের দস্যুদলে দলবল নিয়ে যোগ দিয়েছিলো জাহাঙ্গীর ও আলিফ বাহিনী। পুরো সুন্দরবনে তখন ইলিয়াসের নামেই চাঁদা উঠতো কোটি কোটি টাকা। মজনুরও দাপট ছিলো পশ্চিম সুন্দরবনে। তবে ইলিয়াসের তুলনায় অনেক কম।

ঘটনাচক্রে দস্যুনেতা হয়েছেন মজনু। অস্ত্র চালানো, সুন্দরবনে চলাফেরার অভিজ্ঞতা ছিলো না তেমন। কয়েকজন বিশ্বস্ত বনদস্যু পুরো কার্যক্রম তদারকি করতো। তবে সুন্দরবনের দস্যুদল হিসাবে তার বাহিনীটি ছিলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল। তাই ইলিয়াস যতোদিন জঙ্গলে ছিলো, ততোদিন এক রকম পালিয়ে, এড়িয়ে ও সমঝোতা করে টিকে ছিলো তার দস্যুদল।

পুরো দিন জঙ্গলের গহীনতম খালের ভিতরে থাকতো ইলিয়াস। তবে রাত হলেই বেরিয়ে পড়তো। দাপিয়ে বেড়াতো সুন্দরবনের এপাশ-ওপাশ। সে বলতো, দিনের সুন্দরবন প্রশাসনের। আর রাতের সুন্দরবন আমাদের। বন আর সাগরের জেলেরা ধরাও পড়তো রাতের বেলা। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের জেলেরা পুরো রাত জেগে থাকতো দুরু দুরু বুকে। সন্ধ্যার পর কেউ আলো জ্বালতো না। দূর থেকে দেখা যাবে বলে দিনের আলো থাকতে থাকতে খেয়ে নিতো তারা। সন্ধ্যার পর চুলা জ্বলতো না, সিগন্যাল বাতিও থাকতো নেভানো। ট্রলারের খোলে ঢুকে বিড়ি-সিগারেট খেতো তারা, যাতে দূর থেকে তাদের দেখে না ফেলে দস্যুরা।

ইলিয়াস বেশ কয়েকটি বন্দুকযুদ্ধ করেছে। যখন রাজু বাহিনীর সাধারণ সদস্য ছিলো তখন হাতে থাকতো থ্রি নট থ্রি বন্দুক। সুন্দরবনের দস্যুদের কাছে থ্রি নট থ্রি সবচেয়ে বেশি বিশ্বস্ত ও কার্যকর। দূর থেকে প্রতিপক্ষের ট্রলার ডুবিয়ে দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র এটি। আর সেই অস্ত্র থাকতো ইলিয়াসের হাতে।

হাত মিলিয়ে, বুক মিলিয়ে পাশাপাশি বসেছে মজনু ও ইলিয়াস। পাশে বসলাম। সারা রাত কাটবে এখানে। কিছুক্ষণের মধ্যে মজনু বাহিনীর বাবুর্চি এসে দাঁড়ালো সামনে। হাতে চায়ের কাপ, দুধ চা। রাত বাজে প্রায় বারোটা। কালকের দিনটি এখানে পার করবো আমরা। দস্যুরা তাদের কাজ গুছিয়ে নিবে। কিছু অস্ত্র জঙ্গলে লুকানো আছে, সেগুলো বের করবে মজনুরা। এছাড়া আমার কাজগুলোও সারতে হবে সুবিধা মতো সময়ে।

আপনার বাঁকী অস্ত্রগুলো কোথায়? জিজ্ঞেস করলাম মজনুকে। জানালেন, ঘন্টা খানেক নৌকা বেয়ে দক্ষিণে যেতে হবে। অস্ত্রগুলো পাওয়া নিয়ে কোনো অনিশ্চিয়তা নাই তো? বললেন, নিশ্চিত পাবেন ভাই। বললাম, রাতের মধ্যে নিয়ে আসবেন? বললেন, রাতে যাওয়া ঠিক হবে না।

পালোকাটি খালটিকে বর্ণনা করে বুঝানো সম্ভব না। পূর্ব দিক থেকে পশুরতলা খালের একটি ভাড়ানী এসে মিশেছে এখানে। ছোট ছোট খালের অভাব নাই। যেখানে নোঙ্গর করেছি সেখানটা বেশ চওড়া, লেক এর মতো। তারপর পশ্চিমে আরেকটু এগুলেই মালঞ্চ নদী। আমরা এসেছি এ পথেই। মালঞ্চের ঠিক মাঝ বরাবর RAB-এর ট্রলার নোঙ্গর করা। এই রাত ও পরের দিন থাকবেন তাঁরা। মেজর আদনান কবীর আসবেন। দস্যুদের নিয়ে জঙ্গল থেকে উঠবে RAB।

একটা বিপত্তি হলো সেই রাতে। মালঞ্চ দিয়ে চলাচল করা মাছ-কাঁকড়ার নৌকাগুলো পড়েছে বিপদে। মাঝ নদীতে RAB-এর ট্রলার দেখে ভঢ পাচ্ছে তারা। নদী ধরে সোজা না গিয়ে ঢুকে পড়ছে পাশ খালে। পালোকাটি খাল ধরেও কিছু নৌকা চলে এসেছে আমাদের সামনে। আমরা একটু লুকিয়ে থাকতে চাইছিলাম। কিন্তু বেশ কয়েকটি নৌকা হাজির হয়ে গেছে। তারা দেখে ফেলেছে আমাদের অবস্থান। এখন ছেড়ে দিলে লোকালয়ে জানিয়ে দিবে তারা। মজনু বাহিনীর অবস্থান কেউ জানতে পারলে ঝামেলা বাড়বে। কী করা উচিৎ? মজনু বললেন, এদের এখানেই রাখতে হবে। আগামী কাল আমরা জঙ্গল ছাড়ার আগে তাদের ছাড়া যাবে না। তারা সারা দুনিয়ায় খবর ছড়িয়ে দিবে। বলতে বলতে নৌকাগুলোকে কাছে আনা হলো। গুটগুটে বাবুসহ কয়েকজন দস্যু নেমে গেলো। জেলেদের কাছে থেকে মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে নিলো।

বললাম, আর কোনো বিছুতে হাত দিও না বাবু। রাতের মধ্যে পশুরতলা ভাড়ানী দিয়ে আরও কয়েকটি নৌকা এলো। সবাইকে পালোকাটি খালের ভিতরে নোঙ্গর করতে বললাম। তাদের ক্ষতি হবে জেনেও আটকে রাখলো দস্যুরা। আমি বললাম, রাতটা আমাদের সাথে থেকে যান আপনারা। বলেই বেলায়েত সরদারকে বললাম, সবার জন্য একটু রান্না করা দরকার না? উনি বললেন, এই কথাটাই শুনতে চাচ্ছিলাম ভাই। একটু রান্নাবান্না করতে না পারলে হাতটা নিশপিশ করে। রান্নাঘরে না ঢুকলে ভালোই লাগে না।

মজনু বাহিনীর বাবুর্চিকে ডাকলাম। বললাম, তোমাদের কাছে বড় হাঁড়ি আছে তো? বললো, গতবার যেসব দেখে গেছেন সেগুলোই আছে। চলবে না? সরদার বললেন, আজকে ভাগে ভাগে রান্না হবে। কারণ মানুষ আমরা সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন। হাঁড়িতে এতো জনের ভাত হবে না। সরদার বললেন, জেলে নৌকাদের চুলায় চুলায় ভাত চড়াতে হবে। আর তরকারি করবো ট্রলারের চুলায় ওই বড় হাঁড়িতে। ব্যাস। কাজ শুরু হয়ে গেলো।

কয়েক বেলা খেতে হবে। তাই ট্রলারে একটু বেশি করে খাবার দাবার মজুত করা ছিলো। আলমগীর ভাইকে দিয়েছিলাম বাজার ও ট্রলারের দায়িত্ব। গত কয়েক দিনের যোগাযোগে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উনি ট্রলার থেকে বাজারগুলো বের করলেন। রান্নার কাজে হাত দিলেন বেলায়েত সরদার। রাতের খাবারে থাকবে ভাত, ডাল আর আলু ভর্তা। কোমড়ে গামছা বেঁধে নেমে পড়লেন বেলায়েত সরদার।

এই সফরটি আগেরগুলোর থেকে নিরাপদ। RAB-এর ট্রলার আছে বলে বড় নদী দিয়ে কোনো আক্রমণ আসার সুযোগ নাই। তবে ছোট খালগুলো নিরাপদ না। নৌকা নিয়ে তাই পশুরতলার ভাড়ানীতে পাহাড়ায় বসলো দুই’জন সশস্ত্র বনদস্যু।

ঘন্টা খানেকের মধ্যে রান্না শেষ হলো। সরদার বলে কথা। ঝাল করে বানানো আলু ভর্তা, পাতলা ডাল আর গরম ভাত। সবাইকে নিয়ে খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে রাত তিনটা। ততোক্ষণে অর্ধেক ভাটা পেরিয়ে গেছে। পানি সরে গেছে অনেকটা। ছোট খাল আর ভাড়ানীগুলো শুকিয়ে গেছে। এদিন দিয়ে আগামী ছয় ঘন্টায়ও কেউ আসতে পারবে না। বনদস্যুরা সারা রাত পালা করে পাহাড়া দিবে। আমরা একটু বিশ্রাম নিবো।

বেলায়েত সরদার ছাড়াও এ সফরে সাথে আছেন ভিডিওগ্রাফার বায়েজীদ ইসলাম পলিন। আছেন আহসান রাজীব ও নিজাম উদ্দীন। ট্রলারে ইলিয়াসের অস্ত্রগুলো আছে। আর ট্রলারটি ভাড়া করা, মাঝিরাও অপরিচিত। সহকর্মীদের তাই ট্রলারে থাকতে বললাম। ইলিয়াসের অস্ত্রগুলো সামলে রাখার নির্দেশ দিলাম। ট্রলার থেকে নেমে দস্যুনেতা মজনু’র নৌকায় গিয়ে বসলাম আমি ও ইলিয়াস। গল্পে গল্পে রাত পার হলো। জানলাম দস্যুদের অবৈধ অস্ত্রের চালান কোত্থেকে আসে, কী ভাবে আসে! জানলাম, দস্যুদের কোটি কোটি টাকা কোথায় যায়!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top