রূপান্তরের গল্প ১৬৬ | Rupantorer Golpo 166

দস্যুদের ডেরায় নির্ঘুম আরেক রাত | রূপান্তরের গল্প ১৬৬

দস্যুদের ডেরায় নির্ঘুম আরেক রাত | রূপান্তরের গল্প ১৬৬ | Rupantorer Golpo 166 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ১৬৬ : একদম জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে আছে কয়েকটি নৌকা। শেষ ভাটায় ঠেকে গেছে কাঁদায়। জেলেরা ঘুমে শেষ। আসলে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় তাদের! তাই ঘুমিয়ে পড়তে সময় লাগে না। রাতে সরদারের হাতের ডাল-ভর্তা-ভাত খেয়ে শরীরটা মনে হয় ছেড়ে দিয়েছে। বিরক্ত করিনি। কিন্তু এভাবে জঙ্গলের সঙ্গে লেগে থাকলে বাঘ কখন টেনে নিয়ে যাবে কে জানে? ঘুমন্ত মানুষকে নৌকা থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা অনেক ঘটেছে। তালপট্টীর ওদিকে নাকী কুমিরেও নিয়ে যায় ঘুমন্ত মানুষদের। নৌকার পর নৌকায় ঠেকানো। তার উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেলাম শেষ নৌকায়। মানুষগুলো ঘুমাচ্ছে। মৃত্যু হতে পারে জেনেও তারা নৌকাতে ঘুমিয়ে পড়ে। কী কঠিন জীবন!

ইলিয়াস বলছে, ওরা তো তাও ঘুমায়। আমাদের তো ঘুম হয় না। কখনও বসে বসে একটু ঘুমায়ে পড়ি। ধ্বক করে ওঠে বুক। মনে হয় পাশের সঙ্গীই আমার দিকে বন্দুক তাক করেছে। মৃত্যু ঝুঁকি জেলেদেরও আছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ঝুঁকি আমাদের। তাই সব ছেড়ে চলে গেলাম। কিন্তু থাকতে পারলাম কই? শুধু বাঘ-কুমির না, আমাদের আরও মেলা ধরনের ঝুঁকি আছে।

আমাদের গল্পে জেলেদের ঘুম ভাঙ্গেনি। কিন্তু বিভিন্ন নৌকায় থাকা দস্যুদের ঘুম ভেঙ্গেছে ঠিকই। ওই যে! কখন কী হয়ে যায়!

পাশে এসে দাঁড়ালো অপরিচিত এক দস্যু। আগে দেখিনি। একদম সাতক্ষীরার ভাষায় কথা বলে। দোনলা বন্দুক হাতে বেশ অভ্যস্ত মনে হলো। বললাম, কী খবর আপনাদের? নাম কী? বাড়ী কোথায়? বললেন, বাড়ি কালিঞ্চিতে। খবর ভালো ভাই। কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে চিন্তার মধ্যে আছি। সারেন্ডার করে বাড়ি থাকতে পারবো তো? বললাম, মাস্টার বাহিনীর লোকজন তো বাড়িতেই আছে। উনি বললেন, এদিকের লোকজন তো ভাই ভালো না। আমাদের বিপদে ফেলবে। দেখবেন আপনাকেও বিপদে ফেলবে। বললাম, বিপদ মাথায় নিয়ে হাঁটতে হবে অনেক দিন। এই কাজে অনেক বিপদ জানি। তাই বলে কাজ বন্ধ করে দিবো? পাশ থেকে ইলিয়াস বললো, মরবো বলে করবো না, বাঁচলে খাবো কী? মানে ভয় পাবেন না। চেষ্টা চালায়ে যেতে হবে।

নামটা কিন্তু বললেন না আপনার। নাম বলতে সয়কোচ লাগছে। বললেন, আমাকে চিনবেন আপনি? বলেই নিজের নামটি বললেন। আমি বললাম, আপনার হাতের অস্ত্রটা কার? মজনু সাহেবের, নাকী জোনাবের? সাথে সাথে নিজের নাম বলে বসলেন তিনি। মানে এই সেই দস্যু যাকে জোনাবের কাছে পাঠিয়েছিলেন মজনু। দস্যুনেতা জোনাব ও তার সঙ্গীদের ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলো সে। অচেতন করে কেড়ে এনেছিলো অস্ত্রগুলো। বললাম, আপনি যা করেন, যেভাবে প্রতারণা করেনন, তাতে শত্রু হবেই হবে। সারেন্ডার করেন। সমস্যা হবে না। আমি তো আছি।

এই বনদস্যুর নাম রবিউল। অন্যের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া, অন্য দস্যু দলের বিকাশ নাম্বার কৌশলে হাতিয়ে নেওয়া ছিলো তার কাছে সহজ কাজ। বললাম, গেলো বার তো আপনাকে দেখলা না যে? কবে আসলেন জঙ্গলে? বললেন, গতকাল আসছি ভাই। সুন্দরবনে দৌড়ে বেড়ানোর মতো দস্যু রবিউল না। তবে অন্য কয়েকটি অপরাধে জড়িত ছিলো সে। বন্য প্রাণিদের যখন তখন ধরে ফেলাটা ছিলো তার কাছে সহজ একাটি কাজ। বিষধর সাপ, কচ্ছপ, তক্ষকসহ অনেক কিছুরই ব্যবসা চলতে সুন্দরবনের এদিকে। সম্ভবত তেমন একটি সিন্ডিকেটেের সক্রিয় সদস্য সে।

ভোরবেলার সুন্দরবনটা মোহনীয় হয়। বর্ষায় বেশি বেশি সুন্দর লাগে সকাল বেলাটা। হঠাৎ বুক কাঁপিয়ে ডেকে উঠলো কুকু পাখি। মানে ভাটা শেষ। জোয়ার শুরু হবে এখন। সূর্য উঠবে আরও আধা ঘন্টা পর। হঠাৎ একটা গুঁইসাপ তেড়ে আসলো খালের চর ধরে।

নৌকার কাছাকাছি এসে থেমে গেলো সে। এমনিতেই সাপ জাতীয় প্রাণি আমা ভয় পাই। তার ওপর এতো বিশাল গুঁইসাপটি! রবিউল বললেন, ভায় পাইয়েন না ভাই। ও কোনো একটা শিকার তাড়া করছিলো। নৌকার এখানে এসে থেমে গেছে। আমাদের দেখে থামছে। লাফ দিয়ে পাশের নৌকায় গিয়ে পড়লাম। তারপর যা হওয়ার হলো।

নৌকার পাটাতন ভেঙ্গে পা ঢুকে পড়লো। মানে নৌকাটি এক রকম ভেঙ্গেই গেলো। না ভাঙ্গলেও পা-এ বেশ ব্যাথা পেলাম। এই বিকট শব্দের মধ্যে দিয়ে ঘুম ভাঙ্গলো সবগুলো নৌকার মানুষদের। যে নৌকায় পড়েছি সেই নৌকার জেলেরা উঠে বসেছে। কাঁদায় নেমে কয়েকজন মিলে আমাকে নিয়ে গেলো ট্রলারে। দেখি বেলায়েত সরদারও ঘুম থেকে উঠে বসেছেন। মনে হচ্ছে পুরো সুন্দনবনের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বললাম, নেতারা কই? ঘুম না কি?

ট্রলারের ছাদ থেকে জবাব দিলেন তাঁরা। তাকিয়ে দেখি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা মজনু ও ইলিয়াস। মজনুর হাতে একটু দোনলা বন্দুক। ইলিয়াসের হাত খালি। পিছনে বসা গুটগুটে বাবু ও রহমত। একটু খুঁড়িয়ে হেঁটে উঠে পড়লাম ছাদে। বেলায়েত সরদার হাতমুখ ধুয়ে চলে গেলেন রান্নাঘরে।

ট্রলারের ছাদে বসে গল্প করছেন দুজন। আমাকে দেখে নড়েচড়ে বসলেন। সামনে রাখা একটি ফাঁকা চেয়ার টেনে বসলাম। পিছনে বসা এক ডাকাতকে বললেন বিস্কিটের প্যাকেট আনতে। আরেকজন গেলো মধু আনতে। খলিশা ফুলের মধু। অদ্ভুত সুন্দর স্বাদ! বিস্কিটে মধু মাখিয়ে খাবো। তারপর খাবো চা। আবার মজনু ইশারা করলেন দু’জনকে। তারা নেমে গেলো। তারপর নিচু স্বরে আমাকে বললেন, ত্রিশে কি হবে ভাই? বললাম…!!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top